খড়্গহস্ত সামরিক জান্তা

মিয়ানমারে অন্তত ১৮ বিক্ষোভকারীর মৃত্যু

বণিক বার্তা ডেস্ক

মিয়ানমারে গতকাল জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে অন্তত ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে আরো অনেকে। এমন তথ্য জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা। এটিই চলমান বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা। খবর রয়টার্স।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর জানিয়েছে, পুলিশ সামরিক বাহিনী মিয়ানমারে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র প্রয়োগ করেছে। এতে অন্তত ১৮ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়। আহত হয়েছে কমপক্ষে ৩০ জন।

বর্মি সামরিক বাহিনী মিয়ানমারে অভ্যুত্থান ঘটায় গত ফেব্রুয়ারি। সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ তুলে নেপিদোর ক্ষমতা দখল করে তাতমাদো (মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর আনুষ্ঠানিক নাম) গ্রেফতার করা হয় স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চিকে। এরপর থেকেই উত্তপ্ত রয়েছে মিয়ানমারের পরিস্থিতি। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির প্রথম ক্যাথলিক কার্ডিনাল চার্লস মং বোর ভাষ্যমতে, মিয়ানমার বর্তমানে একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

মিয়ানমারে পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত ইয়াঙ্গুনে। সেখানকার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষুব্ধ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ ফাঁকা গুলি, টিয়ারগ্যাস স্টান গ্রেনেডের পাশাপাশি গুলিও চালিয়েছে। বিক্ষোভ দমনে সেখানে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীকেও কাজে লাগাচ্ছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা।

ইয়াঙ্গুনে গতকাল নিহতদের মধ্যে একজন শিক্ষিকাও রয়েছেন। শিক্ষকদের এক বিক্ষোভ মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ স্টান গ্রেনেড ছুড়ে মারলে ওই শিক্ষিকা হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান।

এদিকে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এক চিকিৎসক জানিয়েছেন, গতকাল এক বিক্ষোভকারীকে বুকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নিয়ে আসা হলে হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।

বিক্ষোভে নিরাপত্তারক্ষীদের হামলায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ইয়াঙ্গুনের বাইরেও। বর্মি সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, মান্দালয়েও পুলিশের গুলিতে দুই বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। সময় চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে এক নারী বিক্ষোভকারী মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা সাই তুন।

কিউ মিন টাইক নামে এক রাজনীতিবিদ জানিয়েছেন, মিয়ানমারের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর দাওইতে পুলিশের গুলিতে তিন বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া আহত হয়েছে আরো অনেকে।

এর বাইরে উত্তরাঞ্চলের লাসিও দক্ষিণের মেইক শহরে পুলিশ হামলা চালিয়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে বলেও দেশটির গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে।

তবে এসব ঘটনা নিয়ে মিয়ানমারের পুলিশ সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে জান্তা শাসক সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের দাবি, গত সপ্তাহে বিক্ষোভ তুঙ্গে ওঠার পরেও কর্তৃপক্ষ বিক্ষোভকারীদের মোকাবেলা করতে সর্বনিম্ন ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে।

যদিও স্থানীয় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, এমন টালমাটাল পরিস্থিতিতে অন্তত ২১ জন মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। একই সঙ্গে একজন পুলিশ সদস্যেরও মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে বর্মি সেনাবাহিনী।

ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভের কারণে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এখন বেসামরিক প্রশাসনের পাশাপাশি দেশটির বিভিন্ন স্থানের পৌর কর্তৃপক্ষ, বিচার বিভাগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ গণমাধ্যমের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালাচ্ছে বলে নানা মাধ্যমে অভিযোগ উঠে এসেছে।

এদিকে চলমান বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে বলে অভিযোগ তুলেছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। এক বিবৃতিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক পিল রবার্টসন বলেন, বিভিন্ন শহরে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী স্পষ্টতই প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

অন্যদিকে, ক্রমবর্ধমান সহিংসতা বিক্ষোভকারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর শক্তি প্রয়োগের মাত্রা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছে মিয়ানমারের কানাডীয় দূতাবাস। একই সঙ্গে, বর্তমান পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি সংকট সমাধানে চেষ্টা চালানোর কথা জানিয়েছে বর্তমানে আসিয়ান জোটের নেতৃত্ব দানকারী দেশ ইন্দোনেশিয়া।

ইয়াঙ্গুনে বিক্ষোভকারীরা গতকাল বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড দিয়ে পুলিশের চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে। সময় ইয়ান উইন শেইন নামে এক বিক্ষোভকারী বলেন, যদি তারা আক্রমণ করে, আমরা প্রতিহত করব। আমরা কখনই সামরিক বুটের সামনে নত হব না।

মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল এমআরটিভি জানিয়েছে, শনিবার দেশব্যাপী অভিযান চালিয়ে ৪৭০ জনের বেশি লোককে গ্রেফতার করেছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। তবে গতকাল কতজনকে আটক করা হয়েছে, সে সম্পর্কে এখনো কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

এছাড়া চ্যানেলটিতে মিয়ানমার জাতিসংঘে নিয়োজিত বিশেষ দূতকে বরখাস্ত করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ এনেছে সামরিক জান্তা। জাতিসংঘে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান করায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে নেপিদো। এর জবাবে শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জাতিসংঘে মিয়ানমারের বরখাস্তকৃত দূত কিউ মেও তুন।

এদিকে নির্বাচিত সরকার উত্খাত করে ক্ষমতা দখলের জন্য মিয়ানমারের ওপর কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। একই সঙ্গে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে  জেনারেলদের ওপরও। সেনাবাহিনী এরই মধ্যে দেশটিতে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। তবে কবে নাগাদ এটি অনুষ্ঠিত হবে সে-সংক্রান্ত নির্দিষ্ট কোনো দিনক্ষণ ঘোষণা করা হয়নি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন