বিশ্ববাজারে এলএনজির অস্বাভাবিক দাম

জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে দেশীয় উৎসকে গুরুত্ব দিতে হবে

বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনায় ২০৪১ সাল নাগাদ ৬০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। সক্ষমতার ৩৫ শতাংশই আসার কথা আমদানিনির্ভর গ্যাস এলএনজিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। বিদ্যুতের একটি বড় অংশ আসবে আমদানিনির্ভর কয়লা জ্বালানি তেল থেকে। নবায়নযোগ্য উৎস বা দেশীয় উৎস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চিন্তা পরিকল্পনায় তেমন জোর লক্ষ করা যায়নি। টার্মিনাল নির্মাণ, পাইপলাইন স্থাপনসসহ এলএনজি ঘিরে পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়, বিপুল বিনিয়োগ পরিকল্পনাও রয়েছে। পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় এলএনজির দাম কম থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে তাতে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে বড় রফতানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্র। তালিকায় যোগ দিয়েছে মালয়েশিয়া অস্ট্রেলিয়া। ফলে ছয় মাসের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দর বেড়েছে ১৮ গুণ। দর বৃদ্ধির অস্থির প্রবণতায় এলএনজি আমদানির দরপত্রও বাতিল করেছে বাংলাদেশ। ফলে এলএনজি নিয়ে সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

আমদানিনির্ভর জ্বালানির ওপর নির্ভর করে পরিকল্পনা প্রণয়নের নানামুখী ঝুঁকি থাকে। আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি, উৎপাদন দাম নিয়ে কারসাজিসহ বিভিন্ন কারণে জ্বালানির বাজার সারা বছরই দোদুল্যমান থাকে। মাঝে মাঝেই দাম বেড়ে রেকর্ড করে। ফলে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারের ওপর নির্ভর করে পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা কঠিন। বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের সময় বিশেষজ্ঞরা এলএনজির ওপর অতিনির্ভরতার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। এক্ষেত্রে তাদের পরামর্শ ছিল নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণের। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, এলএনজি, জ্বালানি তেল প্রভৃতির বাজার অস্থিতিশীল। এর দাম দ্রুত ওঠানামা করে। কোনো কারণে এলএনজির দাম বেড়ে গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে শিল্প উৎপাদনের ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বেন উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিবৃদ্ধি শিল্পায়নের ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এর পেছনে রয়েছে সাশ্রয়ী মূল্যের গ্যাসের সরবরাহ। স্থানীয় উৎস থেকে গ্যাসের জোগান আসায় স্বল্প মূল্যে শিল্প বিদ্যুৎ খাতে এটি প্রদান করা গেছে। এতে করে স্বল্প মূল্যে পণ্য উৎপাদন করা গেছে, যা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। জ্বালানি তেলের সঙ্গে এলএনজির দামও বাড়ছে। আগামীতে আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে শিল্পে গ্যাসের সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্ধারিত সময়ে চালু করা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হবে।

আন্তর্জাতিক জ্বালানির বাজার সব সময়ই দোদুল্যমান। ফলে কোনো পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় বিষয়টি বিবেচনায় রেখে একক জ্বালানিনির্ভরতা এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। বাংলাদেশে জল স্থলভাগে আরো গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটিকে কাজে লাগাতে হবে। জ্বালানি ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা নিশ্চিত করতে হলে গ্যাস অনুসন্ধান উত্তোলনের কাজ বেগবান করতে হবে। বাস্তবতা হলো, দেশে গ্যাস অনুসন্ধান এখনো পরিপক্ব হয়নি, বরং প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। দেশের ভূখণ্ডের অনেক অংশই এখনো অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়নি; বিশাল সমুদ্র এলাকায় অনুসন্ধান ন্যূনতম পর্যায়ে রয়ে গেছে। জলসীমার আইনি মীমাংসার পর থেকে মিয়ানমার ভারত বঙ্গোপসাগরে ব্যাপকভাবে অনুসন্ধান কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। অথচ অনেকটা সময় পেরোলেও আমাদের দেশে এটি করা হয়নি। এটি দ্রুত শুরু করতে হবে। এজন্য বিনিয়োগ জাতীয় সক্ষমতা উভয়ই বাড়াতে হবে। দেশের সব গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে ধারণা থেকে জ্বালানি আমদানির ওপর সর্বতোভাবে ঝুঁকে পড়া ঠিক নয়। জ্বালানিনির্ভরতা কমাতে গ্যাসসহ নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান আহরণকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন ব্যবহার বাড়াতেও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। দেশীয় উৎস থেকে প্রাপ্ত জ্বালানি ব্যয়সাশ্রয়ী হয়ে থাকে।

বৈশ্বিক তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ দেশীয় উৎস থেকে জ্বালানি জোগানোতেই বেশি দৃষ্টি দিয়েছে। ভিয়েতনাম বর্তমানে নিজস্ব প্রাকৃতিক গ্যাস কয়লা ব্যবহারের মাধ্যমে মোট বিদ্যুতের যথাক্রমে ৩১ ২৬ শতাংশ উৎপাদন করছে। দেশটিতে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে জলবিদ্যুতের অবদান ৪১ শতাংশ। বাকি শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে খুব সামান্য পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি করে। এখন দেশটি নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন ব্যবহারে আরো বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। একইভাবে কম্বোডিয়াও গতানুগতিক দেশীয় জ্বালানি উেসর পাশাপাশি সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ জলবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে শিল্প খাতের জ্বালানি চাহিদা মেটাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ায়ও সমরূপ অবস্থা। দেশটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস কয়লার প্রাধান্য থাকলেও ধীরে ধীরে জলবিদ্যুৎ জিওথার্মালের ব্যবহার বাড়ছে। এসব ক্ষেত্রে তারা দেশীয় উৎসনির্ভর। ফলে সেসব দেশে জ্বালানি ব্যয় আপেক্ষিকভাবে কম। এসব দেশের অভিজ্ঞতা অনুসরণ করে আমাদেরও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে মনোযোগ দিতে হবে। দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা কেমন, তা নিয়ে তেমন কোনো সমীক্ষা হয়নি, গবেষণা হয়নি। ধরনের  গবেষণা বিনিয়োগ বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা সংশোধনপূর্বক দেশীয় উৎসনির্ভর করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লাসহ অন্যান্য সম্পদ ব্যবহারে টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন