দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রেনের আধুনিকায়নে অনাগ্রহী রেলওয়ে!

সুজিত সাহা, চট্টগ্রাম ব্যুরো

১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ রেলওয়েতে সর্বশেষ দ্বিতীয় শ্রেণীর কোচ সংযোজন হয়। এরপর আশির দশকে আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিস চালু হওয়ার পর মেইল-লোকাল-এক্সপ্রেস ট্রেনের জন্য কোনো কোচ আমদানি করেনি রেলওয়ে। বছর বছর আন্তঃনগর ট্রেনের কোচ আমদানি হলেও দ্বিতীয় শ্রেণীর কোচ আমদানি না হওয়ায় স্বল্প দূরত্ব ও কম দামে রেল সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নিম্নবিত্ত মানুষ। 

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে মেইল, এক্সপ্রেস ও কমিউটার ট্রেনের সংখ্যা ৩৯ জোড়া। এসব ট্রেনের জন্য  মোট কোচের চাহিদা প্রায় ৬০০টি। কিন্তু বর্তমানে চাহিদার তুলনায় ৫৬টি কোচ কম নিয়ে চলাচল করছে দ্বিতীয় শ্রেণীর এসব ট্রেন। করোনাকালে চট্টগ্রাম-সিলেট রুটের (১৩/১৪ নং ট্রেন) জালালাবাদ এক্সপ্রেস ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়। জুলাইয়ে কয়েকদিন চলার পর ইঞ্জিনস্বল্পতার অজুহাত দেখিয়ে চাহিদাসম্পন্ন এক্সপ্রেস ট্রেনটি আর চলাচল করেনি। অন্যদিকে একই অজুহাতে সিলেট-আখাউড়া রুটের কুশিয়ারা (১৭/১৮) ট্রেনটির চলাচল বন্ধ করে দেয় রেলওয়ে। তাছাড়া চলাচলরত অন্য দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রেনগুলোও স্ট্যান্ডার্ড কম্পোজিশনের প্রায় অর্ধেক কোচ নিয়ে চলাচল করায় স্বল্প দূরত্বের সাধারণ মানুষ ট্রেন সেবা পেতে ভোগান্তির মধ্যে পড়েছে। 

রেলওয়ে দেশব্যাপী আন্তঃনগর ট্রেনে সার্ভিস বাড়িয়েছে। বিদ্যমান ট্রেনগুলোর কোচ বৃদ্ধি ছাড়াও পুরনো কোচ বাদ দিয়ে আমদানীকৃত নতুন কোচের সমন্বয়ে বেশি দূরত্বের যাত্রীদের জন্য বড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন রুটে এক বছরের ব্যবধানে পাঁচটি নতুন আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিস চালু করেছে। কিন্তু প্রায় ৩০০টি মিটার গেজ কোচ আমদানি সত্ত্বেও দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রেনের জন্য অবমুক্তকৃত কোচগুলো সংযোজনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না রেলওয়ে। রেলের পরিবহন বিভাগের এ-সংক্রান্ত কোচ পরিকল্পনা না থাকায় আন্তঃনগর ট্রেনের অবমুক্ত হওয়া কোচগুলোও দেশের বিভিন্ন সেকশনে অলস পড়ে আছে। 

জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক সরদার সাহাদাত আলী বণিক বার্তাকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে রেলের কোচ ও ইঞ্জিন আমদানি বন্ধ ছিল। বর্তমান সরকার রেলের উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ ছাড়াও রেল সেবার মান বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে। এরই  মধ্যে বেশকিছু আন্তঃনগর কোচ আসায় নতুন সার্ভিস ছাড়াও আন্তঃনগর ট্রেনের বিভিন্ন জরাজীর্ণ রেক প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রেনের কোচ বাড়ানো বা নতুন কোচ সংযোজনের বিষয়ে এ মুহূর্তে কোনো পরিকল্পনা নেই বলে দাবি করেন তিনি। 

রেলের সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি হওয়া আন্তঃনগর ট্রেনের কোচের রেক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি হওয়া ৩০০ কোচ সংযোজন ছাড়াও নতুন ট্রেন সার্ভিস চালু করা হয়েছে। গত এক বছরে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস, বনলতা এক্সপ্রেস, পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, বেনাপোল এক্সপ্রেস এবং জামালপুর এক্সপ্রেস নামের পাঁচটি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। অপর দিকে পারাবত এক্সপ্রেস, মহানগর এক্সপ্রেস, রংপুর এক্সপ্রেস, লালমণি এক্সপ্রেস, কালনী এক্সপ্রেস, তিস্তা এক্সপ্রেস, পাহাড়িকা ও উদয়ন এক্সপ্রেস, সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনে নতুন করে কোচ ও ভালো মানের অবমুক্ত করা কোচ লাগানো হয়েছে। তবে অবমুক্ত হয়ে অলস বসে থাকা কোচগুলো দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রেনে সংযোজনের সুযোগ থাকলেও রেলওয়ে কোনো উদ্যোগই নিচ্ছে না। 

এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে উপবন, জয়ন্তিকা ও বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেন থেকে অবমুক্ত হওয়া ৪৫টি কোচ নিয়েও বড় কোনো পরিকল্পনা নেই রেলের পরিবহন বিভাগের। এছাড়া প্রতিটি ট্রেনের জন্য স্পেয়ার হিসেবে ২৫ শতাংশ কোচ মজুদ রাখা হয়। এসব স্পেয়ার কোচ দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রেনে সংযোজনের সুযোগ থাকলেও উদ্যোগ নিচ্ছে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। রেলওয়ের ওয়ার্কিং টাইম টেবিল-৫২-এ দেখা গেছে, গড়ে ৬/১২ লোড নিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রেন পরিচালনার ঘোষণা থাকলেও গড়ে দুই-তিনটি কোচ দিয়েও দ্বিতীয় শ্রেণীর বিভিন্ন ট্রেন চলাচল করছে। 

পরিবহন বিভাগ বলছে, চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ-বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব রুটের ময়মনসিংহ এক্সপ্রেস (৩৭/৩৮), ঢাকা-নোয়াখালী-ঢাকা রুটের ঢাকা এক্সপ্রেস ও নোয়াখালী এক্সপ্রেস (১১ ও ১২ নং ট্রেন), ঢাকা-সিলেট-ঢাকা রুটের সুরমা এক্সপ্রেস (৯ ও ১০ নং ট্রেন), ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ বাজার-ঢাকা রুটের ভাওয়াল এক্সপ্রেস (১৭/১৮) লোকাল ট্রেনগুলো স্ট্যান্ডার্ড কম্পোজিশনের অর্ধেকেরও কম কোচ নিয়ে চলাচল করছে। যদিও এ চারটি দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রেনের পর্যাপ্ত যাত্রী চাহিদা রয়েছে। 

জানা গেছে, স্বাধীনতার পরপর রেলওয়ে রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীর কোচ আমদানি করেছিল। পরবর্তী সময়ে আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিস চালু হওয়ার পর রেলওয়ে ইরান, চীন, ইন্দোনেশিয়া ও ইন্ডিয়া থেকে কোচ আমদানি শুরু করে। প্রায় ৪০-৫০ বছর আগে আমদানি করা দ্বিতীয় শ্রেণীর কোচগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও এখনো রেলওয়েকে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। অথচ মাত্র দেড় বছর আগে আমদানি করা ইন্দোনেশীয় কোচগুলোর ত্রুটি আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। এর পরও রেলওয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর কোচ আমদানি না করে আন্তঃনগর ট্রেনের কোচ আমদানি ও আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিস বাড়ানোর দিকেই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকছে। 

রেলের পরিবহনসংক্রান্ত উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, বাংলাদেশের মতো একটি দেশে সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের মধ্যে থাকা ট্রেনগুলো একে একে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। প্রায় চার যুগ ধরে দ্বিতীয় শ্রেণীর কোচ আমদানি করেনি রেলওয়ে। ফলে দেশের প্রান্তিক মানুষ অতিরিক্ত ভাড়ায় আন্তঃনগর ট্রেনে ভ্রমণ করতে বাধ্য হচ্ছে। স্বল্প দূরত্ব ও উৎপাদিত পণ্য পরিবহনের জন্য নিয়োজিত বেশ কয়েকটি লোকাল ট্রেনের কোচ সংখ্যা কমিয়ে ট্রেনগুলোকে বন্ধের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামসহ সিলেট, ঢাকার বেশ কয়েকটি লোকাল ট্রেন দিয়ে সাধারণ মানুষ প্রতিদিন কৃষিজ পণ্য নিয়ে শহরে চলাচল করত। কিন্তু কোচ কমে যাওয়া ও ট্রেন সার্ভিস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কৃষকরা পণ্য নিয়ে শহরে আসতে পারছে না। এতে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন তিনি। 

তবে পূর্বাঞ্চল রেলের প্রকৌশল বিভাগ বলছে, রেলের কোচ সংকট মোকাবেলায় বিভিন্ন সময়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর কোচকেও মেরামত করে আন্তঃনগর ট্রেনে সংযোজন করা হয়েছে। এখন নতুন করে আরো আন্তঃনগর ট্রেন আমদানি হলে পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয় শ্রেণীর কোচে সংযোজন সম্ভব হবে। তাছাড়া সম্প্রতি ১০০টি কোচ মেরামতে একটি প্রকল্পও হাতে নিয়েছে রেলওয়ে। তবে দেশের রেলসেবাকে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে দ্বিতীয় শ্রেণীর কোচ আমদানি ছাড়া উপায় নেই বলে মনে করছেন প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারা। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন