গ্রামীণ অর্থনীতির গতিপথ পরিবর্তনে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ

ড. এফএইচ আনসারী

গত কয়েক দশকের ব্যবধানে কৃষি বিশেষ করে শস্য, মৎস্য প্রাণীসম্পদ খাতের নানা ক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণের ছোঁয়া লেগেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি প্রায় শতভাগ আবার কিছু ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে রয়েছি। জমি চাষ ধানকেন্দ্রিক যান্ত্রিকীকরণের অগ্রগতি বেশ আশা জাগাচ্ছে। জমি চাষের জন্য ৯৫ শতাংশ জমি এখন পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে আবাদ করা যাচ্ছে। সেচের ক্ষেত্রে ৮৫ শতাংশের বেশি সেচ এখন যন্ত্রের মাধ্যমে হচ্ছে। কিন্তু ধান লাগানোর ক্ষেত্রে - শতাংশ হয়েছে। এছাড়া ধান ছাড়া অনান্য শস্যের ক্ষেত্রে এখনো সেভাবে যন্ত্রের ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। পিছিয়ে থাকা মৎস্য খাতে প্রাণীসম্পদ খাতের নানা ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার করা সম্ভব। কিছু ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার এসেছে। তবে সেটা এখনো পর্যাপ্ত নয়। ফলে কৃষি বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতির বিরাট পরিবর্তনে সহায়ক হতে পারে কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ। কেননা এখন পর্যন্ত কৃষির যেসব ক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণের ছোঁয়া লেগেছে সেটি গ্রামীণ অর্থনীতির গতি পরিবর্তনে বড় সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। সামনের দিনে যন্ত্র প্রযুক্তির ছোঁয়াই হবে গ্রামীণ অর্থনীতির গতি পরিবর্তনে অন্যতম হাতিয়ার।

কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ এখন শুধুই উৎপাদনকেন্দ্রিক আলোচনার বিষয় বস্তু নয়। কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার এখন বহুমুখী বিষয়কে কেন্দ্র করে এগিয়ে নিতে হবে। বিশেষ করে যন্ত্রের মাধ্যমে কীভাবে তরুণ কর্মসংস্থানকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব, শস্যের নিবিড়তা বাড়ানোর মধ্যেমে কৃষকের আয় বাড়তে পারে বা শস্যের মধ্যে ইন্টার ক্রপিং গ্যাপ কমিয়ে এনে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে। এসব বিষয়ই এখন মুখ্য। কৃষিতে যন্ত্রের  ব্যবহার হলে গ্রামের শ্রমিক বেকার হবে কিনা সেটিও ভাবনার মধ্যে আনতে হবে। আবার এটাও প্রমাণিত যে বর্তমান সময়ে কৃষিতে শ্রমিকের সংকট রয়েছে। ফলে শ্রমিক সংকট মোবাবেলায় যন্ত্রের করণীয় কার্যকর পদক্ষেপ কী হতে পারে। যন্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকের পণ্য সঠিক পরিমাণে ঘরে তুলতে পারলে তার মুনাফায় কোনো ধরনের ব্যত্যয় হবে না। এতে কৃষক যদি বাড়তি আয় করতে পারে, তাহলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে তার একটি বহুমুখী প্রভাব আমরা দেখতো পারব। গত কয়েক দশকে শহর গ্রামের আয়বৈষম্য দ্রুত বেড়েছে। শহরের ধনী পরিবারগুলোর মধ্যে আয় আরো বেশি কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। কৃষককে যন্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে সমৃদ্ধিশালী করতে পারলে শহর গ্রামের বৈষম্য অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির গতিপথ কীভাবে পরিবর্তন হতে পারে সেটিই আলোচনা করব।

দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ ১৯৭০-এর দশকে শুরু হয়। প্রধানত সেচ পাম্প দিয়ে যাত্রাটা শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে কৃষির নানা ক্ষেতেই যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। যদিও তা এখনো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার পর পরই সরকার একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছিল যে আড়াই হাজার টাকা জমা দিলে একটি পাম্প দেয়া হতো। সেচের পানির জন্য ব্যাপক চাহিদা ছিল। অনেক ক্ষেত্রে পানির অভাবে ভরা ফসলও মারা যেত। সেই সেচ পাম্প আসার মাধ্যমে কৃষির প্রায় ৮৫ শতাংশ জমিতে সেচ সুবিধা পৌঁছে গেছে। ম্যানুয়ালি যে গভীরতা থেকে পানি আনা সম্ভব নয়, পাম্প দিয়ে সেখান থেকে পানি আনা সম্ভব। বাংলাদেশে পাম্পের ব্যবহার নিয়ে নেতিবাচক অনেক প্রচারণা হয়েছে। ডিজেল যাচ্ছে, দূষণ হচ্ছে। বিদ্যুতে যথেষ্ট ছাড় দিয়ে পাম্পকে জনপ্রিয় করা হচ্ছে। অনেকে বলে যে ভূগর্ভস্থ পানি কমে যাচ্ছে। তবে শুধু পাম্প দিয়ে পানি তোলার কারণে পানির তলদেশ খালি হচ্ছে বিষয়টি এমন নয়। বিভিন্ন সেডিমেন্ট দিয়ে নদীর তলদেশ ভরে যাওয়ার কারণেও খালি হচ্ছে নদীর তলদেশ। কারণ দক্ষিণে সমুদ্র হওয়ার কারণে এবং উত্তরাঞ্চলের ভূপৃষ্ঠ উঁচু হওয়ার কারণে সব পানি নেমে যায়। নদী পানি ধারণ করতে না পারলে কীভাবে ভূগর্ভস্থ পানি ভরবে? সেখানে পানি নেমে যাওয়াটা স্বাভাবিক।

পরবর্তী সময়ে পাওয়ার টিলারের প্রবর্তন ঘটেছে। যদিও ষাটের দশকে এটি দেশে আসে, তবে গরু-মহিষ দিয়ে হালচাষের অভ্যাস ছিল এবং কিছুটা সুবিধাজনক থাকার কারণে কৃষক সেই অভ্যাস ছাড়তে পারেনি। কিন্তু ব্যাপক আকারে পাওয়ার টিলারের ব্যবহার শুরু হয় আশির দশকে। গত ১০ বছরে ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করা ব্যাপক হারে বেড়েছে। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ট্রাক্টর পাওয়ার টিলার মিলে আমাদের দেশের আবাদযোগ্য জমির প্রায় ৯৫ শতাংশ যন্ত্রের ব্যবহার হয়ে গেছে। অর্জন নেপাল ভারতের তুলনায় অনেক বেশি। ওইসব দেশে গরুর লাঙল আছে। প্রায় ৬০ শতাংশ পর্যায়ে আছে। এক্ষেত্রে আমাদের দেশে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এখানে সরকার যথেষ্ট সাপোর্ট দিয়েছে। ব্যক্তিখাতের কোম্পানিগুলো চাষে ট্রাক্টর প্রচলনের জন্য আগ্রাসীভাবে যথেষ্ট কাজ করেছে। এতে দ্রুত চাষ করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে উৎপাদন ব্যয় কমে এসেছে। পাওয়ার টিলার ট্রাক্টর মিলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে একটি চমত্কার সাফল্য এসেছে।

কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ফসলের নিবিড়তা ফলন বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয়সহ ফসল কর্তনজনিত ক্ষতি অনেকাংশে কম হয়। কৃষি উপকরণের ব্যবহার কমায়, কৃষকদের সময় এবং শ্রম বাঁচায়, খাদ্যমান যোগ করতে সাহায্য করে এবং দীর্ঘ সময় ধরে শস্য গুদামজাত করতেও সহায়তা করে। প্রত্যেকটি যন্ত্রেরই স্বতন্ত্র সুবিধা রয়েছে, যার ব্যবহার কৃষকের বর্তমান প্রচলিত সনাতন পদ্ধতির চেয়ে অধিক লাভজনক।

ফসলের মৌসুমে এখন ৩৫-৪০ শতাংশ শ্রমিকের সংকট থাকে। সামনের দিনে আরো সংকট ঘনীভূত হবে। কেননা দেশে আরো শিল্পায়ন হবে সেক্ষেত্রে এসব শিল্পে শ্রমিক কৃষি খাত থেকে স্থানান্তরিত হবে। সম্ভাবনা রয়েছে প্রচুর। কৃষি যন্ত্রপাতি দিয়ে যদি ধান আবাদ করা যায়, তাহলে ৩০ শতাংশ খরচ কমানো সম্ভব। শহর গ্রামের আয়বৈষম্য কমাতে অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে কৃষিযন্ত্র। ধান কাটার ক্ষেত্রে কৃষি যন্ত্রপাতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ধান যদি ক্ষেতে পড়ে থাকে, তাহলে ঝরে যাবে না। হয় ইঁদুরে খাবে। সরকার ভর্তুকি দেয়ার কারণে কৃষক ধান কাটার জন্য কম্বাইন হারভেস্টর বা রিপার ব্যবহার করছে। ধীরে ধীরে আমাদের দেশে আরো শিল্পায়ন হবে, আরো শ্রমিক দরকার হবে। ফলে গার্মেন্ট কৃষি শ্রকিমের ভারসাম্য থাকতে হবে। তা না হলেও খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।

সরকার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। এসডিজি বলেছে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো মানুষের আয় বাড়তে। যন্ত্রের ব্যবহার ছাড়া সেটি মোটেও সম্ভব নয়। যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে ফলন বেড়ে গেলে কম মূল্যে কৃষক ধান বিক্রি করে লাভবান হতে পারত। যারা ধান ক্রয় করে চাল করে খায় তারাও সহনীয় মূল্যে ক্রয় করতে পারত। গ্রামীণ অর্থনীতি বাংলাদেশ অর্থনীতিতে একটা ভারসাম্য তৈরি হতো। জাতীয় আয়ে অবদান অনেক বেড়ে যেত।

আমরা জানি ২০০৩-০৪ সালে বাংলাদেশে কৃষিতে শ্রমিকের প্রাপ্যতা ছিল ৫১ দশমিক শতাংশ, যা ২০১৮-১৯ সালে কমে হয় ৪০ দশমিক শতাংশ। সেজন্য কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার এখন সময়ের দাবি। যে দেশ যত উন্নত সে দেশের একক আয়তনের কৃষিজমিতে যান্ত্রিক শক্তির ব্যবহার তত বেশি। তাই কৃষি উৎপাদন বাড়াতে কৃষিজমিতে যান্ত্রিক শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা দরকার।

তবে যন্ত্রের চাহিদা প্রয়োজনীয় সুবিধা থাকা সত্ত্বেও কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহারে কৃষক উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে এলেও এখনো ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়নি। এর প্রধান কারণ হলো প্রাথমিক বিনিয়োগের পরিমাণ বেশি প্রয়োজন হয়। আবার যন্ত্রটি ব্যবহার করা সম্ভব হয় মাত্র দুই-তিন মাস। তাই এসব যন্ত্রের বিকল্প বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে কম্বাইন হারভেস্টারের মতো ভারী কৃষিযন্ত্র গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে তরুণদের কৃষিতে নিয়োজিত করতে হলে যন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। কারণ এখনকার গ্রামের তরুণ বা কৃষকের সন্তানরা অনেকটাই শিক্ষিত বেশ পরিপাটি থাকতে পছন্দ করে। তাই তাদের কাদামাটি কিংবা প্রচণ্ড রোদের মধ্যে কাজে নিয়োজিত করা সম্ভব নয়। এজন্য তাদের কাছে উন্নত যন্ত্র পৌঁছাতে না পারলে কৃষিতে তরুণদের আগ্রহী করা সম্ভব হবে না। কৃষিযন্ত্রের মাধ্যমে গ্রামীণ অঞ্চলে সার্ভিস প্রভাইডার হয়ে তরুণরা বিকল্প কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারে।

আমাদের দেশে কৃষি খাতে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানার কোম্পানির আধিপত্য রয়েছে। কৃষিযন্ত্রের সবই আবার আমদানীকৃত প্রযুক্তি। ইদানীং ব্যক্তি খাতের বেশকিছু প্রতিষ্ঠান সবজিতে নতুন নতুন যন্ত্র ব্যবহার বাড়াতে কাজ করছে। ভুট্টায় যথেষ্ট প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে। আরেকটি বিষয় ধান, আলু সবজিতে উৎপাদন ব্যয় বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বেশি। যেহেতু বিশ্ব এখন একটি গ্রাম, সেহেতু কেউ বসে থাকে না। কোনো না কোনোভাবে কৃষিপণ্যগুলো আমদানি হয় এবং দেশের মধ্যে চলে আসে। ফলে প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতিটা চলে যায়। আবার আমাদের বাজ্যিক বাজারেও প্রতিযোগিতা করতে হয়। সেক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যয় কমাতে না পারলে প্রতিযোগিতা করা খুব কঠিন হয়ে যায়। এজন্যই কিন্তু কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ দরকার।

ধানই একমাত্র ফসল যেখানে তার ব্যক্তিগত পরিবারের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়। আর জমিকে কাজে লাগাতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতি বেগবান হয় যদি কৃষক ধানের দাম ভালো পায়। অথবা ধানে যদি মুনাফা করতে পারে। কাজেই লাভজনকভাবে ধান উৎপাদন করতে হলে যান্ত্রিকীকরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে হারভেস্টারের বিস্তার ঘটাতে হবে। এতে কৃষি শ্রমিকের মজুরি বাবদ কৃষকের ব্যয় কমে আসবে এবং যথাসময়ে কৃষককে ধান কাটতে হবে। হারভেস্টারের প্রচলন ঘটালে কৃষি শ্রমিকেরও ক্ষতি হবে না। কেননা এখানে শ্রমিকের ঘাটতি আছে। আবার ধানের অপচয় কমে যাবে, ঝরে পড়ার হার ১৫ থেকে শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। এতে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হলো, গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা থাকল এবং নিম্ন ব্যয়ে ধান উৎপাদন করতে পারলাম, ধান চাষে মানুষের আগ্রহও ধরে রাখতে পারলাম।

শস্যের নিবিড়তা বাড়াতে কার্যকর হবে যন্ত্রের ব্যবহার। সেহেতু ইন্টার ক্রপিং গ্যাপটা আমাদের দেশে খুব গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিক সংকটের কারণে অনেকেই ধীরে ধীরে ধান রোপণ বপন করে। ফলে এক শস্য থেকে আরেকটি শস্যের ইন্টার ক্রপিং গ্যাপটা ছোট হয়ে যায়। গ্যাপ ছোট হলে অনেক ভালো ফসলের জো থাকে না। যার কারণে ফসলটা ভালো করতে পারে না। সমস্যার সমাধানে আমাদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জমিতে ধান লাগানোর যন্ত্রটি প্রবর্তন করতে হবে। যন্ত্র দিয়ে ধান লাগালে ব্যয় অনেক কম। একদিকে ব্যয় সাশ্রয় হলো, অন্যদিকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ধান লাগানো গেল। অতএব লাভজনকভাবে, উৎপাদনশীলভাবে ধান উৎপাদন করতে হলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কোনো বিকল্প নেই।

সেচের জন্য যন্ত্র ব্যবহার পরিপক্ব হয়ে গেছে। এটিতে দক্ষতা আনতে হবে, একটু পরিবেশবান্ধব করতে হবে। সেটি আলাদা একটি উন্নয়ন। সেটি ধীরে ধীরে শুরু হচ্ছে এবং হয়ে যাবে। আমাদের জমি চাষের ব্যাপার আছে। সেখানে পাওয়ার টিলার ট্রাক্টর দিয়ে যথেষ্ট পেনিট্রেশন হয়েছে। এখন সারা পৃথিবীতে ট্রিলেজের একটি বিষয় বলছে। অতিরিক্ত ট্রিলেজ করলে ভূমি ক্ষয় হয়, মাটি দেবে যায়। সেটিতেও ধীরে ধীরে প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটছে। ধান কাটাই গল্পের শেষ নয়। ধান সংরক্ষণ করতে হবে, মজুদ করতে হবে। আমাদের দেশে এক্ষেত্রে বড্ড তাড়াহুড়ো দৃশ্যমান। প্রান্তিক কৃষকের অল্প ধান কোথায় মজুদ করবে, সেটি একটা সমস্যা আছে। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় পিপির মাধ্যমে সরকারের স্টোরেজ সার্ভিস ডেভেলপ করতে হবে, কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করে তুলতে হবে, যাতে তারা স্টোরের ব্যবস্থা করতে পারে। এখন যেমন আলু রাখে। তেমনটি হলে যার যখন দরকার, তখন বিক্রি করতে পারবে।

প্রসেসিংয়ে কিন্তু যান্ত্রিকীকরণ এগিয়ে নিতে হবে। ধান শুকানো, সেদ্ধ করা, ধান থেকে চাল ছাড়ানো প্যাকেজিং করা পর্যন্ত যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে। চালের রিকভারি রেট বাড়েতে হবে। এখানে বিনিয়োগ করতে হবে, নিম্ন ব্যয়ে তহবিলের জোগান দিতে হবে, যাতে ভালো ভালো রাইস মিল হয়, যেখানে কমপ্লিট ইন্টিগ্রেশন থাকবে। ধান উৎপাদনের মাধ্যমে আমাদের কষ্টার্জিত টাকার সর্বোচ্চ সুফল নিশ্চিত করা যায়। আলুতে যান্ত্রিকীকরণ খুব দরকার। কারণ আলু হলো ইন্টার ক্রপ। আমন বোরোর মাঝখানে। যদি মজুর সংকটে আলু লাগাতে দেরিতে হয়ে যায়, যদি তুলতে দেরি হয়ে যায়, যত্ন নিতে দেরি হয়ে যায়, তাহলে স্বাভাবিক বোরো দেরি হয়ে যায়। দেরি হওয়ার মানে হলো এপ্রিল-মের সময়ে বর্ষায় পড়ে যাবে, বন্যায় পড়ে যাবে। এখান থেকে বাঁচতে হলে যথাসময়ে লাগাতে হবে এবং যথাসময়ে তুলতে হবে। এখানে অনেক কিছু করার আছে। পাওয়ার টিলার ট্রাক্টরভিত্তিক ডিভাইস বা অ্যাপ্লায়ান্সগুলো সংযোজন করা গেলে অনেক সফলভাবে আলু লাগানো কাটা যাবে। ইদানীং আমাদের দেশে বাণিজ্যিকভাবে সবজি উৎপাদন হচ্ছে। এখানে যান্ত্রিকীকরণের প্রচলন করা গেলে অনেক কম খরচে উৎপাদন করার সুবিধা হবে। আবার মানও নিশ্চিত করা যাবে। ভুট্টায় যান্ত্রিকীকরণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভুট্টা এমন এক ফসল যেখানে খোসা ছড়ানো থেকে শুরু করে ভুট্টা তুলে আনা খুবই ব্যয়বহুল কাজ। এখানেও কিছু করার আছে। কারণ আমাদের দেশে ভুট্টার উৎপাদন যথেষ্ট ভালো হচ্ছে ভারতের তুলনায়। সেক্ষেত্রে সেচ লাগানো থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ পর্যন্ত যদি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ব্যয় কমাতে পারি, তাহলে অনেক ভালো কিছু করা সম্ভব। একইভাবে গমের ক্ষেত্রেও সমস্যা বিদ্যমান। আমাদের দেশে গম উৎপাদন অনেকেই করে না। এর হারভেস্টিং কস্ট অনেক বেশি। এক্ষেত্রে শ্রমিক পাওয়া কঠিন। কারণ গমের কাঁটা মানুষের গায়ে লাগলে চুলকায় বা ঘা হয়। সেক্ষেত্রে গম লাগানো তোলার ক্ষেত্রেও যান্ত্রিকীকরণের যথেষ্ট প্রয়োজন আছে।

মাছের প্রক্রিয়াকরণেও যান্ত্রিকীরণের সুযোগ আছে। এক্ষেত্রে যদি যান্ত্রিকীকরণ করতে পারি, তাহলে মাছের আঁশ বা নাড়িভুঁড়ি ওষুধ শিল্পে ব্যবহার করা যায় এবং রফতানি করতে পারব। মুরগি পালনে যথেষ্ট যান্ত্রিকীকরণ প্রবর্তিত হয়ে গেছে। বিশেষ করে ব্রিডিং হাউজগুলোয় নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ব্রিডিং করা হচ্ছে। লেয়ার হাউজগুলোয় সুন্দর সুন্দর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, যেখানে খাবার দেয়া হচ্ছে। রোবটের ব্যবহার করা হচ্ছে। সেগুলোর ব্যবহার যত বাড়বে তত দূষণ কমাতে পারব। হ্যাচারিগুলোও এখন অনেকটাই ম্যাকানাইজড। মুরগির খামারে রোবট প্রবর্তন করার চেষ্টা করছে। সেক্ষেত্রে যথেষ্ট সুযোগ আছে।

গবাদি পশুতে যান্ত্রিকীকরণ খুব প্রাথমিক ধাপে আছে। বিশেষ করে এক্ষেত্রে মিল্কিংয়ের জন্য যান্ত্রিকীকরণ খুবই দরকার। দুধ পরিবহনেও যান্ত্রিকীকরণের সুযোগ আছে। অন্যদিকে স্লটার হাউজগুলোতে যদি যান্ত্রিকভাবে মাংস প্রসেস করা হয় তাহলে একদিকে ব্লাডগুলো যথেষ্ট মূল্যবান আমিষ। সেটা ড্রাই করে অ্যানিমেল ফিড হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। হার্ড পার্টগুলোও কাজে লাগানো যায়। যেহেতু স্থানীয় বিশ্ববাজারে বাই প্রডাক্টের যথেষ্ট দাম আছে, সেক্ষেত্রেও কিন্তু আমাদের জন্য লাভজনক হয় ক্যাটল প্রডাকশন। আর ফিডটা যদি ম্যাকানিক্যালি তৈরি করতে পারি, তাহলে গরুর উৎপাদন বেড়ে যাবে এবং অপচয় অনেক কমে যাবে।

দেশের কৃষিকে এগিয়ে নিতে যান্ত্রিকীকরণে অর্থায়ন বাধা দূর করতে হবে। ব্যাংকগুলো সরাসরি কৃষককে ঋণ দিচ্ছে না বিধায় কোম্পানিগুলো ঋণ প্রদান করতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ব্যাংকগুলো কৃষককে ঋণ দেয় এবং তারাই সেটি রিকভারি করে। তাই কার্যকর সমন্বিত একটি নীতিমালা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। যান্ত্রিকীকরণের কার্যক্রমকে আরো এগিয়ে নিতে হলে ভর্তুকি কার্যক্রম আরো জোরদার করতে হবে।

বাংলাদেশে এসএমই ফাউন্ডেশন পিকেএসএফ ভালো কাজ করছে। ছোট ছোট উদ্যোগে ঋণ দিচ্ছে, যদিও সুদ বেশি। একইভাবে আমি মনে করি কৃষিতেও একটি এগ্রিবিজনেস ফাউন্ডেশন করা উচিত। তার কারণ হলো এটি করলে যদি তরুণরা এসব জায়গা থেকে ঋণ নিতে পারে, তাহলে যান্ত্রিকীকরণে বিনিয়োগ বাড়বে এবং তাতে সার্বিকভাবে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ প্রক্রিয়াটি অনেক দ্রুততার সঙ্গে ঘটবে। একটি কার্যকর সঠিক নীতিমালা প্রয়োজন, যে নীতিমালায় কৃষিযন্ত্র কেনায় কৃষকদের উৎসাহিত করতে সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, এনজিও অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সহজে কৃষিঋণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে। বছরে স্বল্প সময়ে ব্যবহার্য বপন, রোপণ, কর্তন, শুকানো, সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকরণ বিষয়ক কৃষিযন্ত্র কেনার ক্ষেত্রে ন্যূনতম সুদ কিংবা বিশেষ ক্ষেত্রে সুদবিহীন ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা থাকবে। আর যান্ত্রিকীকরণে তরুণদের উৎসাহিত করতে সহজ পদক্ষেপ থাকতে হবে। পাশাপাশি কৃষিযন্ত্র সেবা প্রদানকারী উদ্যোক্তা, কৃষক, মেকানিক, মেরামতকারী কারখানা শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। গ্রামের যুবশক্তিকে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরির মাধ্যম হবে কৃষিযন্ত্র। ফলে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণে যুব সম্প্রদায়কে অধিক অংশগ্রহণের নিশ্চিত করতে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট করতে হবে। সঠিক কার্যকর পরিকল্পনা নীতির মাধ্যমে কৃষিতে শতভাগ যান্ত্রিকীকরণ করতে পারলে গ্রামীণ অর্থনীতি আরো বেগবান হবে। জাতীয় অর্থনীতি হবে টেকসই সমৃদ্ধিশালী।

 

. এফএইচ আনসারী: সিন্ডিকেট সদস্য, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়; ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এসিআই এগ্রিবিজনেসেস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন