বেসরকারি খাত

ব্যাংকঋণ কেন্দ্রীভূত বড় করপোরেটে

হাছান আদনান

এক দশকে দেশের ব্যাংকিং খাতের বিস্তৃতি বেড়েছে বহুগুণ। ব্যাংকগুলোর আমানতের হিসাব সংখ্যাই বেড়েছে ১৫৬ শতাংশ। নতুন করে যুক্ত হয়েছে প্রায় সাত কোটি ব্যাংক হিসাব। আর ব্যাংকঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৩৪৮ শতাংশ। বিপরীতে হতাশাজনক চিত্র কেবল ব্যাংকঋণ গ্রহীতার প্রবৃদ্ধিতে। গত এক দশকে ব্যাংকঋণ গ্রহীতার হিসাব সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ২১ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানই বলছে, সম্পদের মতোই দেশের ব্যাংকঋণও অল্প কিছু মানুষের কাছে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে।

ব্যাংকঋণের বৈষম্য প্রকট করে তুলছে ধনী-গরিবের সম্পদের ব্যবধান। একই সঙ্গে সম্প্রসারণের তুলনায় নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে দেশের ব্যাংকিং খাত ব্যর্থ হয়েছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকার বিপুল বিনিয়োগ করলেও তার সুফল মিলছে না নতুন উদ্যোক্তা তৈরি না হওয়ায়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১০ সালের শুরুতে দেশের ব্যাংকগুলো থেকে ঋণগ্রহীতা হিসাব সংখ্যা ছিল ৮৯ লাখ হাজার ৬৮৭। এক দশক পেরিয়ে ২০২০ সালের জুন শেষে ঋণগ্রহীতার হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে কোটি লাখ ৮০ হাজার ২৭৬-এ। হিসাবে গত এক দশকে ব্যাংকিং খাতে ঋণগ্রহীতার হিসাব বেড়েছে মাত্র ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৫৮৯টি, যা একই সময়ে ব্যাংকগুলোয় যুক্ত হওয়া আমানতকারী হিসাবের শতাংশেরও কম। এসব ঋণগ্রহীতার তালিকায় দেশের শীর্ষ করপোরেট যেমন আছে, তেমনি আছে দেশের প্রান্তিক কোনো কৃষকের নেয়া -১০ হাজার টাকার ঋণ গ্রহীতাও। একইভাবে ক্রেডিট কার্ডসহ রিটেইল প্রডাক্টের ছোট ছোট ঋণগ্রহীতাও তালিকার রয়েছেন। ছোট অংকের এসব ঋণগ্রহীতাকে বাদ দিলে গত এক দশকে বড় করপোরেটগুলোর ঋণ বহুগুণ বেড়েছে।

গত এক দশকে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের বড় অংশ কেন্দ্রীভূত হয়েছে দেশের বড় করপোরেটের পকেটে। ২০০৯ সালে ৩০ কোটি টাকার বেশি এমন ঋণের হিসাব সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৬৩। এসব হিসাবে ব্যাংকগুলোর ঋণ ছিল মাত্র ২৪ হাজার ৮৬ কোটি টাকা। কিন্তু ১০ বছর পর ৩০ কোটি টাকার বেশি এমন ঋণ হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে হাজার ২৯৯। ব্যাংক হিসাবগুলোতে ঋণ গিয়েছে লাখ ২৯ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ, দেশে বেসরকারি খাতের মোট ব্যাংকঋণের এক-তৃতীয়াংশ মাত্র হাজার ২৯৯টি হিসাবের মাধ্যমে বিতরণ হয়েছে। শুধু ৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে এমন ২৪৩টি ব্যাংক হিসাবে লাখ ৫০ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ২০০৯ সালে ৫০ কোটি টাকার বেশি এমন ১৩৮টি ব্যাংক হিসাবে ঋণ ছিল মাত্র ১১ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। একই করপোরেটের অনেক হিসাব থাকার পরিসংখ্যান তৈরি করলে বিপুল অংকের ঋণের গ্রাহক ১০০টির বেশি হবে না বলেই মনে করছেন ব্যাংকাররা।

বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ৫৭ শতাংশই বিতরণ হয়েছে চারটি থানার আওতাধীন ব্যাংক শাখার মাধ্যমে। এর মধ্যে শুধু রাজধানীর মতিঝিলের শাখাগুলোর মাধ্যমেই বিতরণ হয়েছে লাখ ৭৭ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকার ঋণ। দেশের মোট ব্যাংকঋণের এক-চতুর্থাংশের বেশি তথা ২৬ দশমিক ৫১ শতাংশ মতিঝিলের শাখাগুলোর মাধ্যমে বিতরণ হয়েছে। এর বাইরে রাজধানীর গুলশান থানার ব্যাংক শাখাগুলোর মাধ্যমে বিতরণ হয়েছে লাখ ৮৬ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকার ঋণ। মোট ব্যাংকঋণের ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ থানার শাখাগুলোর মাধ্যমে বিতরণ হয়েছে। চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার ব্যাংক শাখাগুলোর মাধ্যমে ৭৭ হাজার ৭৯ কোটি এবং ডবলমুরিং থানার শাখাগুলোর মাধ্যমে ৬২ হাজার ১২৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে। বন্দর নগরীর দুটি থানার ব্যাংক শাখাগুলোর মাধ্যমে বিতরণ হয়েছে মোট ঋণের ১৩ দশমিক ২৭ শতাংশ।

দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী একজন বড় শিল্প উদ্যোক্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যাংকারদের উদার মনোভাব সহযোগিতায় নব্বইয়ের দশকের শুরুতে চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হয়েছিলাম। এক্ষেত্রে ব্যাংকারদের সহযোগিতা পেয়েছিলাম উদারহস্তে। কিন্তু এখন নিজে একটি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হওয়ার পরও মনে হয়, আমি অসহায়। নতুন করে উদ্যোক্তা সৃষ্টির কোনো কাজ আমরা করতে পারছি না। বর্তমান সময়ে যদি আমি চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, তাহলে সবকিছুই পণ্ডশ্রম হতো।

গত এক দশকে ঋণগ্রহীতাদের ব্যাংক হিসাব বেড়েছে মাত্র ২০ দশমিক ৯৯ শতাংশ। অথচ সময়ে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ৩৪৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেড়েছে। ২০১০ সালের শুরুতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল লাখ ২৯ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। এক দশক পর চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১০ লাখ ২৯ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। দেশের বেসরকারি খাতে নতুন করে যুক্ত হওয়া লাখ ৯৯ হাজার ২১৯ কোটি টাকার ব্যাংকঋণের সুবিধাভোগী কারা, সে প্রশ্নও উঠছে এখন।

মূলত বড় করপোরেটগুলোর ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ-তিন গুণ বাড়ায় দেশের ব্যাংকঋণ কিছু মানুষের কাছে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে বলে মনে করেন ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের (ডিএসসিই) উদ্যোক্তা অর্থনীতি বিভাগের কো-অর্ডিনেটর প্রফেসর . মুহম্মদ মাহবুব আলী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশের ব্যাংকগুলো প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তা তৈরিতে এগিয়ে এসেছিল। এতে কিছু ঋণ খেলাপি হলেও নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেই ধারা বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে নেই বললেই চলে। দেশের ব্যাংকঋণ বর্তমানে চিহ্নিত কিছু শিল্পগোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত। এতে সমাজে সম্পদের বৈষম্য দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা নীতিমালা তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের জোরালো ভূমিকাই দেশের ব্যাংকিং খাতের ঋণবৈষম্য দূর করতে পারে।

বৃহৎ শিল্প গ্রুপ গ্রাহকদের কাছে ব্যাংকঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে যাওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও। প্রতি তিন মাস অন্তর দেশের ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক চিত্র নিয়ে ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিবেদনে উল্লেখিত স্ট্রেস টেস্টের ফলাফল বলছে, দেশের ব্যাংকগুলোর শীর্ষ তিন গ্রাহক খেলাপি হলে ২১টি ব্যাংক প্রয়োজনীয় মূলধন সক্ষমতা হারাবে। একইভাবে শীর্ষ সাত গ্রাহক খেলাপি হলে মূলধন সক্ষমতা হারাবে ৩৫টি ব্যাংক। শীর্ষ গ্রাহকদের ওপর ব্যাংকগুলোর অতিমাত্রায় জিম্মি হয়ে যাওয়া ঠেকাতে বিভিন্ন সময়েই নির্দেশনা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও বেশির ভাগ ব্যাংকই সে নির্দেশনা আমলে নিচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে।

চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট বেসরকারি আমানত হিসাব ছিল ১১ কোটি ১১ লাখ ৬৭ হাজার ১৪। হিসাবগুলোতে জমা আছে গ্রাহকদের ১০ লাখ ২৩ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। বিপুল জনগোষ্ঠীর আমানতকৃত অর্থ থেকে কোটি লাখ ৮০ হাজার ২৭৬টি ব্যাংক হিসাবে ঋণ দেয়া হয়েছে। বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ পেয়েছে ১০ কোটি ২৯ লাখ ১৪৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১১ কোটির বেশি আমানত হিসাবের অর্থ মাত্র এক কোটি হিসাবের বিপরীতে ঋণ দেয়া হয়েছে।

ব্যাংকঋণে বৈষম্যের চিত্র বৈশ্বিক হলেও বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি বলে মনে করেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান . আহসান এইচ মনসুর। অর্থনীতিবিদের মতে, বিশ্বের যেকোনো দেশের বড় ব্যবসায়ীরা বন্ড পুঁজিবাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহ করেন। কিন্তু আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা পুরোপুরি ব্যাংকনির্ভর। কারণে ব্যাংকিং খাতের ঋণের সিংহভাগ বড়দের কাছে কেন্দ্রীভূত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে। দেশের বড় ব্যবসায়ীরা এখন ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে বিদেশী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কম সুদে ঋণ নিচ্ছেন।

দেশের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব কমিয়ে আনার জন্য এসএমই খাত সম্প্রসারণের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। তার মতে, আমাদের দেশে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার পথটি অত্যন্ত কঠিন। এসএমই খাতের উদ্যোক্তা ঋণ বাড়ানোর জন্য ব্যাংকগুলোকে ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগ নেয়া দরকার। ব্র্যাক ব্যাংকের ঋণ পোর্টফোলিওর ৫০ শতাংশ এসএমই খাতে বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের অন্য ব্যাংকগুলোকেও এসএমই খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে হবে। নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি ব্যাংকঋণ প্রাপ্তিতে সরকার জেলাভিত্তিক চেম্বার সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসা দরকার।

বাংলাদেশের মোট কর্মসংস্থানের ৩৫ দশমিক ৪৯ শতাংশের সংস্থান করছে এসএমই খাত। দেশের মোট জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ২০ দশমিক ২৫ শতাংশ। তবে প্রতিবেশী দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় এর পরিমাণ খুবই কম। ভারতের জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ৮০ শতাংশ এবং চীনে ৬০ শতাংশ। দ্য ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন ফর স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজেস ইন এশিয়া পরিচালিত একটি গবেষণায় দেশের এসএমই খাতের দুর্বলতাগুলো তুলে ধরে এটি সম্প্রসারণে জোর দেয়া হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশের এসএমই খাতে ব্যাংকঋণের পরিমাণ ছিল লাখ ১৮ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা। নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি চাহিদার তুলনায় দেশের এসএমই খাতে ব্যাংকঋণের পরিমাণ খুবই কম বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নতুন উদ্যোক্তা গড়ে তোলা পরিচর্যার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতি আছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি ইভেন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ। তিনি বলেন, শিল্প উন্নত দেশগুলোতে এসএমই খাতের ভূমিকা ৭৫ শতাংশের বেশি। এক্ষেত্রে আমরা এখনো বহু পথ পিছিয়ে আছি। নতুন উদ্যোক্তা তৈরি কঠিন হলেও অসাধ্য নয়। সরকার, ব্যবসায়ী সংগঠন ব্যাংকগুলোর সমন্বিত সহযোগিতায় নতুন নতুন উদ্যোক্তা গড়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু জায়গাটিতে আমাদের বড় ঘাটতি রয়েছে। নতুনদের উঠিয়ে আনার জন্য কোনো না কোনো সংগঠনকে বিশেষ দায়িত্ব দিতে হবে। চেম্বার হিসেবে আমরা কিছু কাজ হয়তো করছি, কিন্তু তা প্রয়োজনের নিরিখে যথেষ্ট নয়। এসএমই খাতের নীতিমালায় সংস্কার আনা দরকার। একই সঙ্গে নতুন উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দরকার। সরকার চেম্বারগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলো নিরসন সম্ভব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন