গণমানুষের ভাগ্যোন্নয়নের রাষ্ট্রনায়ক

এইচ টি ইমাম

আমি নেতা নই, সাধারণ মেয়ে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠার একজন কর্মী। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য আপনাদের নিয়ে আমি নিরলস সংগ্রাম চালিয়ে যাব। আসুন আমরা এক হই। জয় আমাদের অনিবার্য...

জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রায় তিন দশক আগে ১৯৮১ সালে শেরেবাংলা নগরে তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন। নেত্রীর সেই ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং উল্লিখিত সংবর্ধনা আয়োজনের পটভূমি তুলে ধরা প্রয়োজন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার জীবনসঙ্গিনী ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, পুত্র শেখ রাসেল, শেখ জামাল, শেখ কামাল উপস্থিত আত্মীয়স্বজনসহ স্বাধীনতাবিরোধী দেশদ্রোহী ষড়যন্ত্রকারীরা নৃশংসভাবে হত্যা করে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট কালরাতে। বর্বর জঘন্যতম পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা শেখ রেহানা সুদূর পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করায় তাদের জীবন রক্ষা পায়। আজও তারা জীবিত আছেন বটে, কিন্তু অন্তরের গহিনে বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই ভয়াল কালরাতের দুঃসহ স্মৃতি।

সংগ্রামের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জননেত্রী শেখ হাসিনার আবির্ভাব। বৃহত্তর ফরিদপুর-গোপালগঞ্জ এলাকাধীন টুঙ্গিপাড়ার বিখ্যাত শেখ পরিবারের উজ্জ্বল নক্ষত্র, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বেড়ে উঠেছেন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে। জন্ম মধুমতি তীরবর্তী টুঙ্গিপাড়ায়, শেখ বাড়িতে। শৈশব-কৈশোরের অধিকাংশ সময় গ্রামের দুঃখী মানুষের জীবনপ্রণালির সঙ্গে একাত্ম করে রেখেছিলেন নিজেকে। সুবাদে পিতার মতো শেখ হাসিনার মাঝেও গড়ে ওঠে এক জনদরদি হূদয়। মনে, মানসিকতায় তিনি সেভাবেই গঠন করেছেন নিজেকে। তার শিক্ষাজীবন কেটেছে ঢাকায়। শিক্ষার্থী থাকাকালে পিতার রাজনৈতিক জীবনধারা শুধু শেখ হাসিনাকেই নয়, তাদের সমগ্র পরিবারকে প্রভাবিত করেছিল।

মোগল ভারতবর্ষে টুঙ্গিপাড়ায় শেখ পরিবারের প্রথম আগমন ঘটে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শেখ পরিবারের প্রসার ঘটলেও জননেত্রী শেখ হাসিনার পিতা বিশ্ববরেণ্য অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে, একটি জাতির জনক হিসেবে এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি হিসেবে। এমন এক পিতার সুযোগ্য সন্তান দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা। দেশী-বিদেশী একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক উপাধিপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত শেখ হাসিনা বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী। পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির হাল ধরেছেন তিনি।

১৯৯৬ ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে পিতার সুযোগ্য উত্তরসূরিরূপে দৃঢ়চিত্তে তার নেতৃত্বাধীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে তিনি প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। সরকার গঠনের পর মুহূর্ত থেকে নির্বাচনী ইশতেহারে বর্ণিত সব প্রতিশ্রুতি পালনে একে একে তিনি ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। মন্ত্রিসভায় নতুন মুখের অন্তর্ভুক্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টির পরিচয় এরই মধ্যে ফুটে উঠেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষ করে তোলার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি যেসব কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন, সেগুলো ক্রমেই সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক বিচক্ষণতার আলোকে দক্ষ প্রশাসকের মতো প্রত্যেক সমস্যার সমাধান ছাড়াও তিনি নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। এসব কর্মসূচি দেশ জনগণের কল্যাণে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থেই গৃহীত হচ্ছে, এমন আভাস সরকার গঠনের কয়েক মাসের মধ্যেই ফুটে উঠেছে।

১৯৭৫ সালের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে রাজনৈতিক আশ্রয়ে প্রায় অর্ধযুগ বিদেশে অবস্থান করতে হয়েছিল। সে সময় পশ্চিম জার্মানিতে কিছুকাল অবস্থান করে শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্য গমন করেন। দলের সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ১৯৮১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি ঐক্যের প্রতীক হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন। ঢাকার ইডেন হোটেলে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সেই ঐতিহাসিক কাউন্সিল সভায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন সর্বসম্মতিক্রমে। জাতির এক ক্রান্তিকালে দেশের বৃহত্তম ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি মনোনীত হয়ে সেদিন একটি কথাই তিনি বলেছিলেন:

আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা, আমার আর কী চাওয়ার আছে?

বিশ্বাস জননেত্রীর মনে আজও বদ্ধমূল দেখতে পাই। পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের মতোই অতি বড় হূদয়ের অধিকারি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে দেশের জন্য, জনগণের কল্যাণের জন্য যে অঙ্গীকারের কথা তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েও তিনি একই মনোভাব ব্যক্ত করে চলেছেন সেই একই সারল্য সাবলীলতায়, কিন্তু দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে, অবিচল আস্থার সাথে। বঙ্গবন্ধুর মতো জননেত্রী শেখ হাসিনাও বাংলাদেশের মানুষের জন্য তার মন-প্রাণ উত্সর্গ করে দিয়েছেন।

১৯৮১-তে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর নিরলস সংগ্রামী জীবনই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ললাট লিখন হয়ে যায়। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে স্বৈরাচারের অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্য বাংলার জনগণের আন্দোলন সংগ্রাম তীব্রতর হয়। গণতন্ত্রের মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বারবার কারাভোগ করেছেন, গৃহবন্দিত্বকেও বরণ করেছেন হাসি মুখে। সংগ্রামী দুঃসাহসিক নেতৃত্ব প্রদানের এই কণ্টকাকীর্ণ পথে জননেত্রীর জীবনের ওপর ঝুঁকি এসেছে বারবার। তার শান্তিপূর্ণ মিছিলে, জনসভায় গ্রেনেড পর্যন্ত নিক্ষেপ করেছে গণতন্ত্রের শত্রুরা। হত্যা করা হয়েছে তার দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে। সব বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসকের পতন ঘটিয়ে সংসদে বিরোধী দলের নেতারূপে অনন্য অবদান রাখেন তিনি। বাংলাদেশের মানুষের জন্য তার গভীরতম ভালোবাসা মমত্বের নিদর্শনস্বরূপ জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীনতার সূতিকাগার জাতির পিতার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক বাসভবনটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তর করে তা দেশবাসীর উদ্দেশে উত্সর্গ করেন। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের জন্য জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে তিনি নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধিবিধান সংবিধানে সংযুক্ত করার আন্দোলনে সফল হন। ১৯৯৬ সালে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে এবং একই বছরের ২৩ জুন প্রথমবারের মতো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন জননেত্রী শেখ হাসিনা।

প্রথমবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর নেত্রীর দূরদর্শী নীতিমালার কারণে খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সাথে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদিত হয়। স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে বাংলাদেশ। এসব জনকল্যাণমুখী কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ইউনিভার্সিটি তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি, যুক্তরাজ্যের ডান্ডি ইউনিভার্সিটি ডক্টর অব লিবারেল আর্টস জাপানের ওয়াসেদা ইউনিভার্সিটি সম্মানসূচক ডক্টর অব লজ ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৯৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে দেশিকোত্তম উপাধি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডক্টর অব লজ ডিগ্রি প্রদান করে। পরবর্তী বছর ব্রাসেলসের ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি তাকে ডক্টর অব লজ, অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ডক্টর অব যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিজপোর্ট ইউনিভার্সিটি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। এছাড়া জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক ফেলিক্স হুফো বোইনি শান্তি পুরস্কার- ভূষিত হন। জাতিসংঘের খাদ্য কৃষি সংস্থা ১৯৯৯ সালে তাকে সেরেস পদকে ভূষিত করে। এছাড়া ১৯৯৭ সালে তিনি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র পদক পান এবং রোটারি ফাউন্ডেশন কর্তৃক পল হ্যারিস ফেলো হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি মাদার তেরেসা পদক গান্ধী পদকে ভূষিত হয়েছিলেন।

বাংলাদেশে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে জননেত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহ তার প্রযুক্তিবান্ধব মনমানসিকতার পরিচয়কেই তুলে ধরে। মানবসভ্যতা কৃষ্টি বিকাশের ধারায় বর্তমানে যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার সুফল আমাদের নেত্রী বাংলাদেশের ঘরে ঘরে নিয়ে গেছেন। সবার জন্য সুষম উন্নয়ন নিশ্চিতে তার শাসনামলেই প্রথম মুঠোফোন (মোবাইল) প্রযুক্তির বাজার উন্মুক্ত করে দেয়া হয় এবং উল্লেখযোগ্য হারে কর সুবিধা প্রদান করা হয়, যা এর আগে কেবল একটি বিশেষ কোম্পানিই ভোগ করত। মুক্তবাজার অর্থনীতির সুবিধা গ্রহণ করে অবারিত দুয়ার। বেসরকারি খাতে টেলিভিশন চ্যানেল অপারেটর করার অনুমতি প্রদান করে আকাশ সংস্কৃতিকে তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কম্পিউটার আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক হ্রাসকরণের দ্বারা সাধারণের হাতে হাতে আজ বিশ্বায়নের মাধ্যম পৌঁছে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত কোনো গ্রামাঞ্চলের তরুণ-যুবা-বৃদ্ধ-শিশু যেকোনো সময় অনায়াসে চলে যেতে পারছেন আমেরিকার ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের ওয়েব পেজে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য মহাসড়কে বিচরণ করতে পারছেন অবিরত। তথ্যপ্রযুক্তির এই যে সুফল আজ বাংলার ঘরে ঘরে, সবই আমাদের জননেত্রীর জনকল্যাণমুখী নীতিমালার ফসল।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ এই পাঁচ বছর রাষ্ট্র পরিচালনাকালে বাংলাদেশের উন্নয়ন, জনকল্যাণ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে প্রভূত অবদান রেখেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র সরকারপ্রধান এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে মতবিনিময় করে দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে দাবি পেশ বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য তুলে ধরেছেন নিঃশঙ্কচিত্তে। এতে বাংলাদেশের সঙ্গে পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রের বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর সমাধানেও বিশেষ মনোযোগী ছিলেন জননেত্রী। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অপ্রত্যাশিত পরাজয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো জনসমক্ষে নগ্নভাবে ধরা পড়ে। ১৯৯০ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে অতি মানবীয় গুণাগুণের ধ্যানধারণা ২০০১ সালের নির্বাচনকালে নস্যাৎ হয়ে যায়। তাই জনগণের ভোটাধিকার রক্ষায় অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবারো আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে ওঠে। দেশের প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলো বিএনপি-জামায়াতসহ চারদলীয় জোটের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। বাংলাদেশের তত্কালীন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক . ইয়াজউদ্দিন আহাম্মদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়েন। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রগতিশীল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো মহাজোট গঠন প্রবল আন্দোলন সংঘটিত করে। সংসদীয় পদ্ধতির পরিপন্থী রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সম্প্রসারণসংক্রান্ত একটি বিতর্কিত ধারা সংস্কারের দাবিও প্রচণ্ড রূপ নেয়।

অন্যদিকে সদ্য বিদায়ী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীরা মাঠে নেমে পড়ে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। এতে সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মীর ওপর অকথ্য নির্যাতন-নিপীড়ন শুরু হয়। সেনাবান্ধব তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, দাতা গোষ্ঠী বিদেশী নেতাদের চাপে বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধ্য হয়। সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্থায়িত্বকাল ৯০ দিনের জন্য নির্দিষ্ট থাকলেও সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকে। সময়ে বিরোধী মহাজোটের ৩১ দফা দাবির অন্যতম ছবিযুক্ত নির্বাচকমণ্ডলীর তালিকা প্রণয়নের দাবি প্রাধান্য পায় এবং জাতীয় পরিচয়পত্র নির্বাচকমণ্ডলীর তালিকা প্রস্তুত প্রকাশিত হয়। সেই তালিকানুযায়ী ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে মহাজোট দিনবদলের স্লোগানের ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে ২০০৯ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করে।

প্রথমেই জননেত্রীর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করেছিলাম। সেদিন বাংলাদেশের জনগণের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করে শেখ হাসিনা সবাইকে সোনার বাংলা গড়ার কজে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজই জননেত্রী শেখ হাসিনার একমাত্র আরাধ্য বিষয়। কথা তিনি বারবার ঘোষণা করছেন। রাজনৈতিক পরিবারের পরিমণ্ডলে জননেত্রী শেখ হাসিনার জীবন গড়ে উঠছে। শৈশবকাল থেকেই পিতার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে শেখ হাসিনা অন্বিত হয়ে ওঠেন। তাই ১৯৮১ সালে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তিনি যখন আওয়ামী লীগের হাল সুদৃঢ় মুষ্টিতে ধরেছিলেন, তখন থেকেই দল পরিচালিত হয়েছে সুনির্দিষ্ট নীতির পথ ধরে। দলকে কখনো বেহাল দশায় পড়তে হয়নি। জননেত্রীকে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তত্কালীন সিনিয়র নেতাদের ভাবনা যে সঠিক এবং অভ্রান্ত ছিল আজ তা প্রমাণিত হয়েছে। ক্ষমতারোহণ করেও জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশ পরিচালনা করেছেন সার্থক সফলভাবে। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় জননেত্রীর নিরলস চেষ্টা প্রমাণ করেছে তিনি প্রকৃত অর্থে ঐক্যের প্রতীক।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের ভিশন ২০২১ এক যুগান্তকারী পরিকল্পনা। প্রযুক্তিগতভাবে বাংলাদেশকে ডিজিটাল রাষ্ট্রে পরিণত করতে সরকার সর্বক্ষেত্রে সম্ভাব্য সব পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সেগুলো বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের আহ্বানে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। বাংলাদেশের অসহায় দরিদ্র জনগণের দারিদ্র্য মোচনে শিল্প-কারখানা স্থাপন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নয়নের দ্বার উন্মোচন ইত্যাদি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সদা সচেষ্ট রয়েছে। কারণ তিনি কথা যথার্থই উপলব্ধি করেন যে গণতন্ত্রের মূল চাবিকাঠিই হচ্ছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ক্ষুধা দারিদ্রমুক্তি এবং শিল্প-বাণিজ্যের প্রসার।

বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরন্তর চিন্তাভাবনার প্রতিফলন দেখতে পাই তার রাষ্ট্রনায়কোচিত কর্মকাণ্ডে। সম্প্রতি সেপ্টেম্বর, ২০০৯ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় তিনি বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে মানবজাতির জীবনপ্রবাহের ওপর বৈশ্বিক উষ্ণতার বিরূপ প্রভাব সম্বন্ধে এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন বাংলাদেশের মতো দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর ওপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এতে জলমগ্নতা প্রকট আকার ধারণ করার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অনুন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া হয়েছে অত্যন্ত বিরূপ। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে আছে আমাদের বাংলাদেশ। আর অবস্থার জন্য দায়ী পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো কথা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অকপটচিত্তে উচ্চারণ করেছেন বিশ্বসভায়। উন্নত বিশ্বকেই এর দায়ভার বহন করে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। আশার কথা, তার আহ্বান বিশ্বসভায় গৃহীত হয়েছে।

বাংলাদেশ এখন ক্ষতিগ্রস্ত অনুন্নত দেশগুলোর মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত এবং স্বীকৃত হয়েছে। এজন্য জননেত্রী শেখ হাসিনা কৃতিত্বের দাবিদার। বিশ্বপরিমণ্ডলে শেখ হাসিনা এখন একজন। বিশ্বের খাদ্যনিরাপত্তা সম্বন্ধেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের ভূমিকা বিশেষত জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশের সামরিক পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। শান্তি মিশন পরিচালনায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উত্থাপিত জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বাংলাদেশের সক্রিয় অবস্থানের দাবিও তাই বিশ্বসভায় যোগ করেছে নতুন মাত্রা। বঙ্গবন্ধুর পর এই প্রথম জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেয়ার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মর্যাদা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমুজ্জ্বল করেছেন বহুগুণে।

দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকেই দেশরত্ন শেখ হাসিনা গণমানুষের ভাগ্যোন্নয়নে নিজের জীবনকে উত্সর্গ করেছেন। রাজনীতিতে প্রবেশ করার আগে থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মত্যাগের নিদর্শন এবং দেশের জন্য তার জীবনদান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রভাবিত করেছে, তা বোঝা যায় তার সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচির তালিকা দেখে। জনকল্যাণে বিদ্যুতায়ন, নদী খনন, শিল্পায়ন, শিক্ষার মানোন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ, পরিবহন ব্যবস্থা উন্নতকরণ, জ্ঞানের তথ্যভাণ্ডার সমৃদ্ধকরণ ইত্যাদি যেকোনো দেশ এবং তার জনগণের জন্য অতি জরুরি অবশ্য প্রয়োজনীয় কর্মসূচি। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে এসব কর্মসূচি প্রণয়ন এবং সেগুলো বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করে জননেত্রী শেখ হাসিনা নিজেকে প্রকৃত দেশপ্রেমিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব কর্মসূচি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকার প্রণয়ন করেছে। এসব পরিকল্পনা শুধু প্রণয়নই নয়, এগুলোর বাস্তবায়নেও যথাযথ ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এসব কাজের অগ্রগতি তদারক করেন। তিনি প্রতি সপ্তাহে নিয়মিতভাবে দুদিন মন্ত্রিসভা একনেকের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির নির্ধারিত সভার ব্যবস্থা করেছেন। মন্ত্রিসভার প্রায় সব বৈঠকে তিনি মন্ত্রীদের কাজের অগ্রগতি, সাফল্য ইত্যাদি সম্বন্ধে অবগত হন, পর্যালোচনা করেন, প্রয়োজনে পরামর্শ দিকনির্দেশনা দেন। এভাবে তিনি সরকার ব্যবস্থাকে সদাসর্বদা সচল তত্পর করে রেখেছেন। জননেত্রীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গুণাবলি একদিনে তার মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়নি। সুদীর্ঘকালের পারিবারিক ঐতিহ্য হুমকির বেড়াজাল ছিন্ন করে আজকের জননেত্রী যেন আগুনে পুড়ে খাঁটি সোনায় পরিণত হয়েছেন।

ব্যক্তিগত জীবনে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে অতি সাধারণ সহজ-সরল জীবনযাপন করতে দেখেছি। তার ধর্মপরায়ণতা প্রশ্নাতীত। তিনি প্রতিদিন নিয়মিত নামাজ পড়েন, কোরআন তিলাওয়াত করেন এবং প্রতি রমজানে রোজা রাখেন। পবিত্র হজব্রত পালন করেছেন একাধিকবার। একজন সফল মা হিসেবে সুশিক্ষিত সন্তান গড়ে তোলা তার জীবনের অন্যতম ব্রত। বিভিন্ন বক্তৃতায় তিনি বলেন, তাদের পরিবারের পাঁচ সন্তানজয়, পুতুল এবং বোন শেখ রেহানার তিনজন ববি, টিউলিপ রূপন্তী। এদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলাই তার বিনিয়োগ সম্পদ।

যোগ্য পিতার সুযোগ্য কন্যা, দেশদরদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্মক্ষমতা কর্মতত্পরতা অব্যাহত থাকুক। বাংলাদেশ বাঙালি জাতি সংগ্রামী নেত্রীর যোগ্য নেতৃত্বের সুদৃঢ় বন্ধনে মাথা উঁচু করে সগৌরবে এগিয়ে যাক সম্মুখপানেমহান আল্লাহতাআলার দরবারে এটাই নিবন্ধকারের ঐকান্তিক প্রার্থনা। [পুনর্মুদ্রণ]

এইচ টি ইমাম: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংস্থাপন উপদেষ্টা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন