সিএসআর ব্যয়ের ৯৬ শতাংশই বেসরকারি ব্যাংকের

হাছান আদনান

করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) খাতে চলতি বছরের প্রথমার্ধে ৫১৭ কোটি টাকা ব্যয় করেছে দেশের ৫৯টি ব্যাংক। বিপুল ব্যয়ের ৯৬ দশমিক ২১ শতাংশই দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর। সিএসআর খাতে ব্যয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ শতাংশেরও অনেক কম। আর বিদেশী ব্যাংকগুলোর ব্যয়ও নামমাত্র। সরকারি-বেসরকারি বিদেশী আটটি ব্যাংক চলতি বছর সিএসআর খাতে কোনো অর্থই ব্যয় করেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স বিভাগের সিএসআর ব্যয়সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথমার্ধে সিএসআর খাতে ব্যয়ে সবার শীর্ষে আছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। দেশের বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংকটি সিএসআর খাতে ব্যয় করেছে ৫১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। সিএসআর খাতে ব্যয়ের দিক থেকে শীর্ষ পাঁচে থাকা অন্য ব্যাংকগুলো হলো ডাচ্-বাংলা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, এক্সিম মার্কেন্টাইল ব্যাংক। পাঁচটি ব্যাংক সিএসআর খাতে ব্যয় করেছে ১৯১ কোটি টাকা। এছাড়া সিএসআর ব্যয়ের দিক থেকে শীর্ষ ১০- রয়েছে প্রাইম, আল-আরাফাহ্ ইসলামী, শাহজালাল ইসলামী, স্ট্যান্ডার্ড যমুনা ব্যাংক। ব্যয়ের দিক থেকে শীর্ষ ১০টি ব্যাংক ব্যয় করেছে ২৯০ কোটি টাকা। দেশের তফসিলভুক্ত ৫৯টি ব্যাংকের সিএসআরে মোট ব্যয়ের ৫৬ শতাংশই শীর্ষ ১০টি ব্যাংক ব্যয় করেছে।

দেশের ব্যাংকিং খাতের ২৫ শতাংশের বেশি এখনো রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণে। যদিও সিএসআর খাতে ব্যাংকগুলোর ব্যয় প্রায় শূন্য। রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংক সিএসআর খাতে চলতি বছরের প্রথমার্ধে ব্যয় করেছে মাত্র কোটি লাখ টাকা, যা তফসিলি ব্যাংকগুলোর মোট সিএসআর ব্যয়ের শূন্য দশমিক ৩৯ শতাংশ। করোনা মহামারীর মতো দুর্যোগে দেশের সবচেয়ে বড় সোনালী ব্যাংক সিএসআর খাতে ব্যয় করেছে মাত্র ৫১ লাখ টাকা। চলতি বছরের প্রথমার্ধে জনতা ব্যাংক ৮৮ লাখ রূপালী ব্যাংক ৫৩ লাখ টাকা সিএসআর ব্যয় করেছে। সময়ে বেসিক ব্যাংকের ব্যয় লাখ টাকা। আর অগ্রণী ব্যাংক ছয় মাসে সিএসআর খাতে মাত্র লাখ টাকা ব্যয় করতে পেরেছে।

বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) চলতি বছরে সিএসআর খাতে কোনো অর্থই ব্যয় করতে পারেনি। বিডিবিএলের মতোই চলতি বছরের প্রথমার্ধে সিএসআর খাতে এক পয়সাও ব্যয় করেনি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) চলতি বছরের প্রথমার্ধে সিএসআর খাতে এক পয়সাও ব্যয় করতে না পারা অন্য ব্যাংকগুলো হলো আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, সীমান্ত ব্যাংক, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান।

সিএসআর খাতে নামমাত্র ব্যয় করেছে দেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী বিদেশী ব্যাংকগুলোও। বাংলাদেশ ব্যাংকের তফসিলভুক্ত নয়টি বিদেশী ব্যাংক সিএসআর খাতে ব্যয় করেছে মাত্র ১৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক একাই ১৫ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। অন্য বিদেশী ব্যাংকগুলোর সিএসআর ব্যয় একেবারেই যৎসামান্য বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

সিএসআর হলো এক ধরনের ব্যবসায়িক শিষ্টাচার বা রীতি, যা সমাজের প্রতি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনকে নিয়মের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত কার্যক্রমের ফলে উদ্ভূত বিভিন্ন ধরনের পরিবেশগত বিরূপ প্রভাব দূর করা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিদ্যমান ক্ষোভ, অসমতা দারিদ্র্য কমানোর উদ্দেশ্যেই সিএসআরের প্রবর্তন। বর্তমানে সারা বিশ্বেই সিএসআর খাতে ব্যয়কে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের অন্যতম দায়িত্ব হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো প্রজ্ঞাপন জারি করে সিএসআর খাতে ব্যয় করার জন্য ব্যাংকগুলোকে দিকনির্দেশনা দেয়। তারপর একাধিকবার প্রজ্ঞাপন জারি করে সিএসআর ব্যয়ের খাত বিধিমালা দেয়া হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ, আয় উৎসারী কার্যক্রম, অবকাঠামো, সংস্কৃতি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে সিএসআরের অর্থ ব্যয় করতে নির্দেশনা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্প্রতি করোনা মহামারীতে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভঙ্গুর পরিস্থিতি উন্মোচিত হলে স্বাস্থ্য খাতে সিএসআর ব্যয় বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্দেশনা জারি করা হয়। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর মোট সিএসআর ব্যয়ের ৬০ শতাংশই স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের নির্দেশনা রয়েছে।

ব্যাংকগুলোর সিএসআর খাতের ব্যয়ের দিকটি দেখাশোনা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স বিভাগ। বিভাগটির মহাব্যবস্থাপক খন্দকার মোরশেদ মিল্লাত বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যাংকগুলোর কর-পরবর্তী নিট মুনাফা থেকে সিএসআর খাতে ব্যয়ের নির্দেশনা রয়েছে। তবে সিএসআর খাতে ব্যয় করতেই হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যেসব ব্যাংক বিধি অনুযায়ী সিএসআর খাতে ব্যয় করে, সেসব ব্যাংকের ক্যামেলস রেটিং সমৃদ্ধ হয়। ব্যাংকগুলো কোন খাতে সিএসআরের কত শতাংশ ব্যয় করবে, তার দিকনির্দেশনা কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখভাল করে।

দেশের বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর সিএসআর খাতের ব্যয়ে শৃঙ্খলা আনা দরকার বলে মনে করেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস খান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, সিএসআর খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করলে শেয়ারহোল্ডাররা বঞ্চিত হন। আবার অনেক ক্ষেত্রেই সিএসআর খাতে ব্যয়ে স্বচ্ছতা শৃঙ্খলা থাকে না। ব্যাংকগুলো নিজেদের উদ্যোগে সিএসআরের অর্থে ছোট ছোট হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ তৈরি করছে। কিন্তু সেগুলো কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক শীর্ষ নির্বাহী বলেন, একসময় ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিশ্বমানের একটি হাসপাতাল তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে উদ্যোগ থেমে গেছে। একাধিক ব্যাংক বা বেসরকারি ব্যাংকগুলো সম্মিলিতভাবে একটি বিশ্বমানের হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নিলে দেশের স্বাস্থ্য খাত সমৃদ্ধ হতো। ব্যাংকগুলোর সিএসআরের অর্থের সদ্ব্যবহারও সম্ভব হতো।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন