ভ্যাকসিন সহায়তা : এশিয়া-আফ্রিকায় মিত্রতা বাড়াতে চাইছে চীন

বণিক বার্তা ডেস্ক

চীন কোনো কভিড-১৯ প্রতিষেধকের গণ-উৎপাদনে গেলে ফিলিপাইন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেই ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে পারবে। লাতিন আমেরিকা ক্যারিবীয় দেশগুলোকে ভ্যাকসিন কেনার জন্য ১০০ কোটি ডলারের ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। বেইজিংভিত্তিক ভ্যাকসিন উৎপাদক সিনোভ্যাক বায়োটেকের সম্ভাব্য প্রতিষেধকের লাখ ১০ হাজারের বেশি ডোজ বিনা মূল্যে পাবে বাংলাদেশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, নভেল করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেইজিং আসলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তাদের ক্ষীয়মাণ দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক আবার জোরালো করতে চাইছে এবং সেসব দেশে নিজেদের সম্পৃক্ততা সুসংহত করতে চাইছে। খবর নিউইয়র্ক টাইমস।

মানবশরীরের জন্য নিরাপদ কভিড-১৯ প্রতিষেধকের গণ-উৎপাদনে যেতে চীনের এখনো বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। তবে সম্ভাব্য সেই প্রতিষেধক নিয়ে কূটনৈতিক তত্পরতা এখনই শুরু করে দিয়েছে বেইজিং। নিজেদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, এমন অঞ্চলে কূটনৈতিক সুসম্পর্ক স্থাপনের জন্য করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারকে প্রধান হাতিয়ার বানিয়েছে চীন।

ইন্দোনেশিয়ার কথাই ধরা যাক। বেইজিংয়ের সঙ্গে জাকার্তার সম্পর্ক যে খুব উষ্ণ তা বলা যাবে না। তবে ইন্দোনেশিয়া অনেকদিন ধরেই চীনের প্রভাব বিস্তারের আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে। করোনা মহামারী শি জিনপিং প্রশাসনকে সে লক্ষ্য পূরণের সুযোগ করে দিয়েছে। গত সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডোকে কল করে জিনপিং জানিয়েছেন, করোনা নিয়ে দেশটির উদ্বেগ প্রতিষেধকের চাহিদার বিষয়টিকে চীন বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। তিনি কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইন্দোনেশিয়ার পাশে থাকার প্রতিশ্রুতিও ব্যক্ত করেছেন।

বৈশ্বিক নেতৃত্ব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনের মধ্যে অনেকদিন ধরেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে আসছে। বিভিন্ন দেশকে ভ্যাকসিন সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি প্রদানের মাধ্যমে বেইজিং লড়াইয়ে ওয়াশিংটনের চেয়ে এগিয়ে যেতে চাইছে। এছাড়া করোনা ছড়িয়ে পড়ার কারণে চীনকে দায়ী করছে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র দেশগুলো। তাদের দাবি, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতার কারণেই উহান থেকে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা মহামারী। দোষারোপের রাজনীতিতে নিজেদের ভাবমূর্তি কিছুটা ফিরিয়ে আনতে চীনকে সহায়তা করবে তাদের করোনা ভ্যাকসিন কৌশল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন দ্রুত প্রতিষেধক উৎপাদন তা দরিদ্র দেশগুলোর কাছে সরবরাহ করতে পারলে তা সায়েন্টিফিক লিডার হিসেবে দেশটির অবস্থান তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোও চীনের ভ্যাকসিন সহায়তা নিতে প্রস্তুত। পাকিস্তানের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আমাদের জনগণ চীনের ভ্যাকসিন নেয়ার পক্ষে। আসলে তারা আমাদের বলেছে, যত দ্রুত সম্ভব ভ্যাকসিন সহজলভ্য করার ব্যবস্থা করতে।

প্রতিষেধক নিয়ে নিজেদের কূটকৌশল বাস্তবায়নে অন্যদের তুলনায় কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে চীন। মুহূর্তে তাদের চারটি সম্ভাব্য ভ্যাকসিন রয়েছে, যেগুলো ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে সংখ্যা বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট রয়েছে, যেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে ফাইজার বলছে, তারা অক্টোবরের মধ্যে জরুরি অনুমোদনের জন্য আবেদন করবে। আর মডার্না জানিয়েছে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ একটি প্রতিষেধক বাজারে আনতে পারবে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে ভ্যাকসিন উৎপাদনের তহবিল সহায়তা পেয়েছে ব্রিটিশ-সুইডিশ কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা। একজন স্বেচ্ছাসেবীর শরীরে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ায় গত সপ্তাহে তারা তাদের শেষ পর্যায়ের গ্লোবাল ট্রায়াল স্থগিত করেছে।

এদিকে চীন অন্তত দুটি পরীক্ষামূলক প্রতিষেধককে জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। এছাড়া এর প্রতিষেধক উৎপাদনকারী চীনা কোম্পানিগুলো এরই মধ্যে কারখানা তৈরির মাধ্যমে প্রস্তুতি সেরে রেখেছে, যেখানে লাখ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন উৎপাদন তৈরি করা সম্ভব হবে। শি জিনপিং ঘোষণা দিয়েছেন, চীন তাদের উৎপাদিত প্রতিষেধক বৈশ্বিক জনস্বার্থের কাজে লাগাবে।

চীনের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। চীনের বাইরে এসব প্রতিষেধকের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল নিয়ে সমালোচনাও হচ্ছে ঢের। তবে অনিশ্চয়তা সমালোচনাকে পাশ কাটিয়ে বেইজিং তাদের সম্ভাব্য ভ্যাকসিন দিয়ে বিশ্বমঞ্চে নেতা হিসেবে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।

গত মাসে থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া ভিয়েতনামের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং। সময় তিনি এসব দেশকে ভ্যাকসিন দিয়ে সহযোগিতার প্রস্তাব দেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রস্তাবকে বেশ ভালোভাবেই গ্রহণ করেছেন।

ফিলিপাইনে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় রয়েছে চীন। সেই ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতার্তে গত জুলাইয়ে নিজ দেশের আইনপ্রণেতাদের জানান, তিনি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন ভ্যাকসিন সহায়তার বিষয়ে। ওই সময় তিনি আরো জানান, তার দেশ দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের দাবির বিরোধিতা করবে না। অর্থাৎ ভ্যাকসিনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জিনপিং একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক বিরোধে নিজেদের পক্ষে ফিলিপাইনের সমর্থন আদায় করে নিয়েছে।

কেবল ইন্দোনেশিয়া বা ফিলিপাইন নয়, ভ্যাকসিন সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চীনা নেতারা আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবীয়, মধ্যপ্রাচ্য দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশকে পাশে টানার চেষ্টা করছে। এসব অঞ্চলে অনেকদিন ধরেই নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় রয়েছে বেইজিং।

চীনের বাইরে প্রতিষেধকের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানোর মাধ্যমে বেইজিং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোয় কোনো স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি করছে কিনা, সে বিষয়ে সমালোচনা হচ্ছে অনেক। বিষয়ে ইন্দোনেশিয়ার একজন শিক্ষাবিদ বলেছেন, চীনের ভ্যাকসিন সহায়তার বিষয়ে আমাদের সন্দেহ করা উচিত নাকি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত? আমি মনে করি দুটোই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন