স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তৈরীকৃত এক প্রতিবেদনে নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনার কথা তুলে ধরা হয়েছে। কর্মপরিকল্পনায় স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ানোর কথা যেমন উঠে এসেছে, তেমনি সমন্বিত পরিকল্পনা ও ভাইরাস মোকাবেলায় গবেষণার ওপর জোর দেয়ার কথাও বলা হয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে স্বাস্থ্য খাত এখন পুরোপুরি প্রশ্নবিদ্ধ। এ খাতের দুর্বলতা এখন সর্বজনস্বীকৃত। এ দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হলে প্রথমেই স্বাস্থ্য খাতের যে দুর্নীতি আছে, তা দূর করতে হবে। এই দুর্নীতি দূর করার জন্য শুধু দুদক নয়, অন্য সংস্থা যেগুলো আছে, তারা এবং নিরপেক্ষ অডিটের মাধ্যমে আগে যে টেন্ডারগুলো হয়েছে, সেগুলো কীভাবে হয়েছে, এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে কারা কারা জড়িত, সে রাজনীতিবিদ হোক কিংবা রাজনৈতিক কর্মী হোক অথবা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ যেই হোক, সবাইকেই তদন্তের আওতায় এনে পুরোপুরি একটি হিসাব নেয়া উচিত। এটি করা গেলে নিশ্চিত হবে স্বাস্থ্য খাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং আমাদের পক্ষে বড় কিছু অর্জন সম্ভব হবে। অন্যথায় আমরা যে অসুবিধায় আছি, সে অসুবিধা আমাদের আরো বড় ধরনের বিপদের দিকে নিয়ে যাবে।
ভারতের কেরালা দীর্ঘদিন থেকে প্রমাণ করছে, করোনার সময় আবারো করল, সম্পদের সীমাবদ্ধতা নাগরিককে সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে খুব বড় বাধা নয়। রাষ্ট্র যদি সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তার সম্পদ কোথায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করবে এবং কীভাবে ব্যবহার করবে, সেটার মাধ্যমে সম্পদের অভাব অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা যায়। উন্নয়ন মানে শুধু কয়েক গুণ বেশি খরচ করে কতগুলো ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ নয়। উন্নয়ন মানে মানুষের শিক্ষা, চিকিৎসা ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো মৌলিক অধিকারগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। আমাদের মতো একটা দেশের স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির অন্তত ৫ শতাংশ বরাদ্দ হওয়া উচিত। গত অর্থবছরের বাজেটে হয়েছে ১ শতাংশেরও কম। জিডিপির অনুপাতে এটি প্রতি বছর কমছে। করোনা কি এ খাতে বরাদ্দ অতি দ্রুত বাড়াতে এবং দুর্নীতি কমিয়ে মানুষকে মানসম্মত চিকিৎসা দিতে সরকারকে প্রণোদনা জোগাবে?
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের ঝুঁকিগুলো মোকাবেলার জন্য সম্পদ বরাদ্দ এবং নীতিনির্ধারণ একটি মাত্র অংশ। কিন্তু এর বাইরেও এ খাতে আরো অনেক বৃহত্তর সমস্যা রয়েছে। যেমন যে ব্যয় এ খাতে করা হচ্ছে, তার গুণগত মান নিশ্চিত করা; কে কত পাচ্ছে, কত সম্পদ অপচয় হচ্ছে, মানবসম্পদ পরিস্থিতির কী অবস্থা, কী ধরনের ব্যবস্থাপনা, নিয়ন্ত্রণ কৌশল ও সুশাসনের ব্যবস্থা রয়েছে এবং এর জবাবদিহি পদ্ধতির ধরন কী। বর্তমানে সমাজের বিভিন্ন স্তরের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ফলাফল থেকে বোঝা যায় যে বিদ্যমান জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে প্রত্যেকে সমানভাবে উপকৃত হচ্ছে না। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমানের ধরন, নিরাপদ ও স্বচ্ছ পরিবেশের অভাব এবং নিম্নমানের স্বাস্থ্যসেবার কারণে আরো বেশি অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ কারণে কভিড-১৯-এর মতো স্বাস্থ্য সংকটের সময় তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কিন্তু তার পরও তারা স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অগ্রাধিকার পায় না।
স্বাস্থ্য খাতে ব্যবস্থাপনা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নার্স, মিডওয়াইফ ও মেডিকেল টেকনোলজিসের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। ১ হাজার ৫৮১ জন লোকের জন্য রয়েছেন একজন নিবন্ধিত চিকিৎসক। গ্রামীণ, প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলগুলোয় চিকিৎসকশূন্যতার হার বেশি। অনুপস্থিতিও অনেক বেশি। শুধু বেশি বেতনই চিকিৎসকদের তাদের কর্মস্থলে থাকতে আকৃষ্ট করতে পারে না। সেখানে দরকার ভালো মানের শিক্ষা ও অন্য সুযোগ-সুবিধা। এটি অবশ্য বিকেন্দ্রীভূত উন্নয়ন নীতিমালার মতো বৃহত্তর বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা বর্তমানে অনুপস্থিত। অনেক সরকারি হাসপাতালে সরঞ্জাম পাওয়া গেলেও প্রযুক্তিবিদ বা অবেদনবিদের পদ খালি রয়েছে। নিয়োগ ও তাদের ধরে রাখা দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন।
যেহেতু বরাদ্দকৃত সম্পদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, বেতন ও ভাতার জন্য যায়, তাই বাজেট বরাদ্দ থেকে রোগীদের জন্য প্রকৃত উপকারিতাও অনেক কম থাকে। স্বাস্থ্য বাজেটের অপব্যবহারের প্রচলিত একটি উৎস হলো সরঞ্জামাদি সংগ্রহ বা প্রকিউরমেন্ট ও অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বাজেট। বাংলাদেশের অর্থনীতি যেমন এগিয়ে চলছে, স্বাস্থ্যসেবার পরিষেবাগুলোও বেসরকারি খাতের মাধ্যমে প্রসারণ ঘটছে। এর গুণমান নিশ্চিত করার জন্য সরকারের উচিত কার্যকরভাবে এ খাতের নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করা। কারণ স্বাস্থ্যসেবার গুণমান ও ব্যয় অনেকটাই পরিবর্তিত হয় এসব নিয়ন্ত্রণহীন বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহকারীদের মাধ্যমে। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে সামগ্রিক জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় দ্বারা শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে ওষুধজাত পণ্যের গুণগত মানও পর্যবেক্ষণ করা দরকার।
স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় একাধিক সংস্থা জড়িত। তাদের ওপর নজরদারি করা প্রয়োজন। তাই একটি বিকেন্দ্রীভূত শাসন কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা উচিত, যা স্থানীয় পর্যায়ের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হবে এবং সব অংশীদারির কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে আরেকটি অবহেলিত দিক হচ্ছে উন্নত স্বাস্থ্য গবেষণার জন্য নগণ্য সম্পদের বরাদ্দ। স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও মেডিকেল কলেজগুলোকে উন্নত মানের এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির জন্য অর্থ বরাদ্দ করা উচিত।
স্বাস্থ্য সংকট মোকাবেলায় আমরা কতটা অসহায় ও অপ্রস্তুত বর্তমান কভিড-১৯ সংকট এটাই প্রমাণ করে। সীমাবদ্ধতাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই স্পষ্ট। যেমন টেস্টিং কিট, ভেন্টিলেটর, হাসপাতালের বিছানা ও হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট (আইসিইউ) থেকে শুরু করে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যার অপ্রতুলতা। এটি অবশ্যই স্বাস্থ্য খাতে আরো বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বড় বিনিয়োগ ছাড়া সবার জন্য সাশ্রয়ী ও গ্রহণযোগ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায় না এবং স্বাস্থ্যসেবার সুফল ভোগের ক্ষেত্রে অসমতা হ্রাস করা যায় না। আমরা যদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে চাই, তবে অবশ্যই প্রত্যেকের জন্য সর্বজনীন ও ভালো মানের স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ করতে হবে। কিন্তু কভিড-১৯ সংকট স্বাস্থ্য খাতে আমাদের যে অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতা রয়েছে, তা আবারো স্পষ্টভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। তাই স্বাস্থ্য খাতের উন্নতির বিষয়টি সামগ্রিকভাবে দেখা উচিত।