নগরায়ণ ও শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বেই বায়ুদূষণ নিয়ে মানুষের উদ্বেগ সমানুপাতিক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ শহরাঞ্চল, যেখানে যান চলাচল বেশি, সেখানে বায়ুদূষণের মাত্রা অনেক বেশি। পাশাপাশি কলকারখানা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়াও দূষিত বায়ুর অন্যতম উৎস। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের সংখ্যা ও ভয়াবহতা বাড়িয়ে দিতে পারে এই বায়ুদূষণ। বিষয়টি নিয়ে কাজ করা ব্রিটিশ গবেষকরা এমনটাই ধারণা করছেন। খবর দ্য টেলিগ্রাফ।
ব্রিটিশ সরকারের বিশেষজ্ঞ পরামর্শক দলগুলোর একটি গবেষণালব্ধ প্রতিবেদন গতকাল প্রকাশ করা হয়েছে। এতে তারা বলেছেন, দূষিত বাতাস ও করোনা মহামারীর মধ্যে যোগসূত্র থাকতে পারে। তবে এ বিষয়ে আকাট্য প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। এ কারণে বিষয়টি নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে আরো গবেষণা চালানো দরকার। এ গবেষণা ভবিষ্যতে মহামারী নিয়ন্ত্রণে আরো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা প্রতিরোধে লকডাউনের মধ্যে যান চলাচল কমে গিয়েছিল। ফলে শহরাঞ্চলের বাতাসে নাইট্রোজেন অক্সাইডের মাত্রাও ৩০-৪০ শতাংশ কমে যায়। মূলত ডিজেলচালিত গাড়ি থেকে এ গ্যাস নির্গত হয়। লকডাউনের বিধিনিষেধ শিথিলের পর যানবাহন চলাচল ফের বেড়ে গেছে। এতে বাতাসে নাইট্রোজেন অক্সাইডের মাত্রাও আবার বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বায়ুদূষণ ও করোনাভাইরাসের যোগসূত্রের বিষয়টি সঠিকভাবে মোকাবেলার জন্য ব্রিটিশ মন্ত্রীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এর আগে ব্রিটিশ আইনপ্রণেতাদের পক্ষ থেকেও এ ধরনের আহ্বান জানানো হয়েছিল। এছাড়া দেশটির আইনজীবীরা বলেছিলেন যে ব্রিটিশ আইনে সরকারের বায়ুমান কৌশল পর্যালোচনার কথা বলা হয়েছে। ফলে আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য সরকারকে অবশ্যই জরুরি ভিত্তিতে এ পর্যালোচনা সম্পন্ন করতে হবে।
দূষিত বায়ু যে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়, সাম্প্রতিক সময়ে সারা বিশ্বে ক্রমবর্ধমান বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে এর স্বপক্ষে বিশ্বাস আরো জোরালো হয়েছে। কিছু বিশেষজ্ঞ তো এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন যে করোনার প্রতি সংবেদনশীলতার পেছনে বায়ুদূষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে এ মুহূর্তে অন্য প্রভাবকগুলোর ভূমিকাও একেবারে বাদ দেয়া যাচ্ছে না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্কের অধ্যাপক ও ব্রিটিশ সরকারের ইনডিপেনডেন্ট সায়েন্স অ্যাডভাইজরি গ্রুপ অন এয়ার পলিউশনের চেয়ারম্যান অ্যালিস্টার লুইস বলেছেন, বায়ুদূষণের সঙ্গে শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত বিভিন্ন রোগ ও হূদরোগের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। আর এসব রোগ করোনার ভয়াবহতা আরো বাড়িয়ে দেয়। বিষয়টি বিবেচনায় নিলে বায়ুদূষণের সঙ্গে কভিড-১৯ সংক্রমণের যোগসূত্র থাকাটা আশ্চর্যজনক কিছু মনে হবে না।
বায়ুদূষণ কি তবে নভেল করোনাভাইরাসকে আরো বেশি প্রাণঘাতী করে তুলেছে? প্রতিবেদনের একটি অংশ তৈরি করেছে সরকারের আরেকটি পরামর্শক দল দ্য কমিটি অন দ্য মেডিকেল ইফেক্টস অব এয়ার পলিউশন। ১৫ জন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদকে নিয়ে গড়া এ দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক ফ্র্যাংক কেলি।
এই কমিটির মতে, বায়ুদূষণ যে কভিড-১৯ সংক্রমণ ও ভয়াবহতা বাড়িয়ে দেয়, তার গবেষণালব্ধ কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। তবে স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব বিশ্লেষণ করলে এর সম্ভাব্যতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
কমিটি বলেছে, ‘বায়ুদূষণ ও কভিড-১৯-এর মধ্যকার সম্ভাব্য যোগসূত্র নিয়ে কাজ করা হলে তা ভবিষ্যতে মহামারী ব্যবস্থাপনায় আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেবে। যেমন এর মাধ্যমে জানা যাবে কোন কোন এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা সরঞ্জাম সরবরাহ বাড়াতে হবে।’
কমিটি আরো বলেছে, দীর্ঘমেয়াদি বায়ুদূষণ কভিড-১৯ রোগীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। আর স্বল্পমেয়াদি দূষণ ফুসফুসের বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করতে পারে ও সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা জানান, দূষিত বাতাসের কিছু নমুনায় নভেল করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ফলে ঘরের বাইরে বাতাসের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাব্যতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় সম্ভাব্য সব কারণ নিয়ে আরো বিস্তারিত গবেষণা করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন তারা।