করোনায় অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগের অপব্যবহার ডেকে আনতে পারে মারাত্মক বিপদ

ইফতেখার রফিকুল্লাাহ ও ড. মাহবুবুল হাসান সিদ্দিকী

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত (নিশ্চিত শনাক্ত) মানুষের মোট সংখ্যা ১ লাখ ২৬ হাজারেরও বেশি, আর মৃতের মোট সংখ্যা দেড় হাজারের অধিক। টেস্টের অপ্রতুলতা হিসাবে নিলে এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, করোনা পরিস্থিতি সহসাই উন্নতির কোনো স্পষ্ট লক্ষণ এখনো দৃশ্যমান নয়। এমনকি বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন যে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের এমন পরিস্থিতি অনেক দিন পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে। এ অবস্থায় ১৪ জুন প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘করোনা চিকিৎসায় অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বন্ধে উদ্যোগ নেয়া জরুরি’ প্রতিবেদনটি উদ্বেগের সৃষ্টি করে। করোনাসংক্রান্ত সব ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করে ভবিষ্যতের জন্য কর্মপন্থা নির্ধারণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সবার জন্য প্রাণঘাতী হয় না। এটি তাদের জন্যই বেশি মারাÍক, যাদের বার্ধক্য বা অন্যান্য অসুখের (কো-মরবিডিটি) জন্য শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধক্ষমতা (ইমিউনিটি) দুর্বল হয়ে আছে। এমনিতেই নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরে শরীরের ইমিউনিটি আরো দুর্বল হয়ে যায়। তাই নভেল করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তিকে এমন আরো অনেক জীবাণু (যেমন ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাস বা অন্যান্য ভাইরাস) আক্রমণ করার সুযোগ পায় (সেকেন্ডারি ইনফেকশন), যারা স্বাভাবিক অবস্থায় ওই ব্যক্তিকে আক্রান্ত করে না। 

এখন পর্যন্ত প্রকাশিত গবেষণা তথ্যের আলোকে জানা যায় যে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশের ক্ষেত্রে সেকেন্ডারি ভাইরাল, ব্যাকটেরিয়াল অথবা ফাংগাল ইনফেকশন দেখা দিতে পারে। করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃতদের ক্ষেত্রে এ হার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে বলে গবেষণায় জানা যায়। অতএব, এ ধরনের সেকেন্ডারি ইনফেকশন করোনা আক্রান্তদের জন্য ঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে।   

করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির ইমিউনিটি এমনিতেই দুর্বল হওয়ার কারণে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ফাংগাসজনিত সেকেন্ডারি ইনফেকশন প্রতিরোধে বলতে গেলে একমাত্র চিকিৎসা হলো অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগ থেরাপি। এই অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগ আমাদের দেহে বিকল্প শক্তি হিসেবে কাজ করে, যা এদের ধ্বংস করে ফেলে। তাই এ ড্রাগ ঠিকমতো কাজ করা না-করার ওপর অনেক রোগীর বাঁচা-মরা নির্ভর করে। তার থেকেও বড় কথা, সারা পৃথিবীতে অন্তত ৩০ শতাংশ রোগ সংক্রামক ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত, যার নিরাময়ের জন্য অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগ ব্যবহার হচ্ছে। আমাদের চারপাশে পরিচিত সংক্রামক রোগের মধ্যে এ মুহূর্তে কভিড-১৯ ছাড়াও যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, মেনিনজাইটিস অন্যতম, এসবের চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগের কোনো বিকল্প নেই।

কিন্তু অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়, সারা বিশ্বেই এসব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগের বিরুদ্ধে জীবাণুরা প্রতিরোধ ক্ষমতা (যা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স নামে পরিচিত) অর্জন করে ফেলছে বলে জানা যায়। যদি এ ড্রাগগুলো আর কাজ না করে অর্থাৎ জীবাণুরা যদি না মরে, তাহলে কী হবে? সহজ উত্তর হচ্ছে, আমরা জীবাণুর কাছে হেরে যাব। তার মানে জীবাণুরা যদি প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে তাহলে এসব রোগ বিস্তার লাভ করবে। মানবজাতির অস্তিত্বই বিপন্ন হতে পারে। এ অবস্থা আমাদের জন্য হবে ভয়ংকর অভিশাপ। 

জীবাণুর প্রতিরোধক্ষমতা অর্জনের একটা বড় কারণ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগের অপরিকল্পিত এবং যথেচ্ছ ব্যবহার। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর সময় এ ধরনের ঘটনা অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সম্প্রতি একাধিকবার তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। তাই বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া এবং এর পেছনের কারণগুলোর দিকে নজর দেয়া এখন সময়ের দাবি।

তবে কিছুটা আশার বিষয় হচ্ছে, সব জীবাণু এখনো রোগ প্রতিরোধী হয়ে ওঠেনি। সব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগও তেমনি এখনো অকার্যকর হয়ে যায়নি। কিন্তু দিনে দিনে পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।   

এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের সচেতন হতে হবে। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগের অপব্যবহার ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার রোধ করতে হবে। বর্তমান কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সামান্য জ্বর, সর্দি, কাশি অথবা গলাব্যথায় অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগের অপব্যবহার পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলতে পারে। এছাড়া অতি উৎসাহী হয়ে ম্যালেরিয়া ড্রাগ অথবা অননুমোদিত অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগের ব্যবহার অদূরভবিষ্যতে সার্বিক সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিকার ব্যবস্থারও অবনতি ঘটাতে পারে। ফলে সামনে দেশব্যাপী বড় ধরনের স্বাস্থ্য বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। 

অতএব, চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এ ব্যাপারে এখনই সাবধান হওয়া জরুরি। এ লক্ষ্যে নিæলিখিত পদক্ষেপগুলো কার্যকরী ভ‚মিকা রাখতে পারে বলে আমরা মনে করি: 

১. অতি সত্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উদ্যোগে হাসপাতালগুলোয়, জনসমাগমের স্থানে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগের সঠিক ও পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন করা। 

২. এছাড়া রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগ বিক্রি না করার ব্যাপারে সারা দেশে রিটেইল ফার্মাসিস্টদের বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। 

উপরের পরামর্শগুলো বাস্তবায়ন কিছু ক্ষেত্রে কঠিন এবং ব্যয়সাধ্য হলেও জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে সঠিক ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগের অপব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব বলে আমরা মনে করি।


লেখক:

ইফতেখার রফিকুল্লাহ: পিএইচডি গবেষক, যুক্তরাষ্ট্র; সাবেক ন্যাশনাল কোঅর্ডিনেটর, গ্লোবাল অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স পার্টনারশিপ, বাংলাদেশ

ইমেইল: [email protected]

ড. মাহবুবুল হাসান সিদ্দিকী: অনুজীববিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্য গবেষক; কোঅর্ডিনেটর, মাইক্রোবায়োলজি প্রোগ্রাম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

ইমেইল: [email protected] 


তথ্যসূত্র:

https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S1684118220301274/

https://blogs.scientificamerican.com/observations/covid-19-patients-need-to-be-tested-for-bacteria-and-fungi-not-just-the-coronavirus/

https://academic.oup.com/cid/advance-article/doi/10.1093/cid/ciaa530/5828058

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন