সুন্দরবন রক্ষা করা কেন জরুরি?

আরিফ দেওয়ান

সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় আম্পান মোকাবেলার সময়ে বিষয়টি আবারো প্রমাণিত হয়েছে যে বাংলাদেশের নিরাপত্তার স্বার্থে সুন্দরবন কতটা আপোষহীন। প্রলয়ঙ্করী সিডর, আইলা, রোয়ানু, বুলবুল ও ফণির ক্ষত কাটতে না কাটতেই আবারও বুক পেতে উপকূলীয় এলাকার মানুষ ও সম্পদ রক্ষা করল বনটি। সুন্দরবন ঘূর্ণিঝড় আম্পানের গতি ৭০ কিলোমিটার কমিয়েছে, পাশাপাশি জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতাও কমিয়েছে ৩-৪ ফুট। সরকারের হিসাবমতে,  বাংলাদেশের মোট ২৬টি জেলায় ঝড়টি তান্ডব চালায়। মোট ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১১০০ কোটি টাকা। ৮৪ পয়েন্টে বাঁধ ভেঙেছে প্রায় ১৫০কিলোমিটার। ১১০০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি সেতু ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২০০টি। কৃষিতে ১ লাখ ৭৬ হাজার  হেক্টর জমির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ২০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ১৯৬০ সালের পরে সংগঠিত ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে আম্পান সবচেয়ে দীর্ঘ সময় এবং বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে তান্ডব চালিয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘসময় এবং বিস্তীর্ণ এলাকা ধরে চলা এই ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতির পরিমাণ ও হতাহতের সংখ্যায় ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭ সালের সিডর কিংবা ২০০৯ এর আইলার চেয়েও কম হওয়ার অন্যতম কারণ সুন্দরবন। ১৫১ কিলোমিটার গতিতে আম্পান বাংলাদেশের সাতক্ষীরায় আঘাত হানে, তবে এর আগেই সুন্দরবন ঝড়ের গতিবেগ অনেকটাই কমিয়ে দেয়। ঘূর্ণিঝড়টির সঙ্গে আসা জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ১৫ থেকে ১৮ ফুট হওয়ার আশঙ্কা করা হলেও সুন্দরবনের কারণে উপকূলে আছড়ে পড়ার সময় ১০ থেকে ১২ ফুটে নেমেআসে। ফলশ্রুতিতে উপকূলের মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি কম হয়।

সুন্দরবনের মোট আয়তনের প্রায় ৬২ শতাংশ বাংলাদেশে। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠা এ বনসমুদ্র থেকে উঠে আসা দুর্যোগেগুলোকে প্রথম মোকাবেলা করে। বাংলাদেশের ফুসফুস খ্যাত সুন্দরবন অক্সিজেনের এক বিশাল ফ্যাক্টরি হিসেবে কাজ করে। এর অর্থনীতিক গুরুত্বও অনেক। সুন্দরবন থাকার কারণে আমরা সৌভাগ্যবান। কিন্তু পরিতাপের বিষয় সুন্দরবনকে আমরা প্রতিনিয়ত ধবংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। কখনো উন্নয়নের নামে, আবার কখনো ব্যক্তি বা মুষ্টিমেয় দলগত স্বার্থের কারণে।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রকল্পটির কথা ধরা যাক। প্রকল্প এলাকাটি সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বলার অপেক্ষা রাখে না, এর ফলে সুন্দরবনের বনাঞ্চল, পরিবেশ ও জীবসম্পদ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এমনকি এই প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদে সুন্দরবনের অস্তিত্ব টিকে থাকার জন্য হুমকি স্বরূপ। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এ প্রকল্প হবে কয়লাভিত্তিক, যার নির্মাণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিরুৎসাহিত করা হয়। কেননা, পরিবেশবান্ধব না হওয়ার পাশাপাশি মানুষ ও জীববৈচিত্রের জন্য ক্ষতিকর বলে বিভিন্ন দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে কঠোর আইন রয়েছে। যেমন, কানাডা ও ফ্রান্সে কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে রয়েছে কঠোর আইন (প্রমাণ করতে হবে যে এটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়, যথেষ্ট ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলে তা অনুমোদিত হবে না)। পাশাপাশি তারা জনমত ও বিশেষজ্ঞ মতামতকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়।

পরিতাপের বিষয়, পরিবেশগত গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোকে আমরা উপলব্ধি করতে পারছি না। বিষয়টি সত্য যে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির বিকল্প নেই। কারণ আমাদের গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে আসছে, যার একটা বড় অংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই বলে সুন্দরবনের মতো প্রাকৃতিক বনের নিকটেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নির্মাণ করতে হবে? তাও কয়লাভিত্তিক? যা উন্নয়নের নামে বড় ধরণের পরিবেশগত ক্ষতি সাধনেরই নামান্তর।

তাছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনে জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি করতে হবে। যেহেতু সুন্দরবন সংলগ্ন নদীপথ জাহাজ চলাচলের উপযুক্ত নয় তাই এ কয়লা ছোট ছোট নৌকা বা লঞ্চে করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নিতে হবে। মালামাল ওঠানামা এবং চলাচলের সময় কয়লাভর্তি নৌকা বা লঞ্চ ডুবির আশংকা রয়েছে। যা পরিবেশের জন্যও ঝুঁকির। তাছাড়া বায়ু দূষণও শব্দ দূষণ তো আছেই।বাতাসে কার্বনডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাবে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হবে।

সাধারণত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পরিবেশে অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছড়ায়। এছাড়া বিষাক্ত সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড, ক্যাডমিয়াম, লেড, ছাই ইত্যাদি গ্যাস ও ভারী ধাতু পরিবেশে নির্গমনের ফলে এসিড-বৃষ্টি অবধারিত। এতে করে অনায়সে ক্ষতিগ্রস্থ হবে সুন্দরবনের বিভিন্ন গাছগাছালি ও প্রাণীদের জীবনচক্র, যেহেতু তাদের খাদ্য ও বায়ু বিষাক্ত হয়ে পড়বে। মানুষের জন্যও এ প্রভাব প্রযোজ্য। নানাবিধ বিচার-বিশ্লেষণে দেখা যায়,  রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবন ও সেখানকার জীববৈচিত্র্যের জন্য অপূরণীয় ক্ষতিকর এ প্রশ্নে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মধ্যে কোনো মতভেদ নেই।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার পাপাশাপাশি, সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতেও যেমন, ঠিক তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেশের মোট বনজসম্পদের একক বৃহত্তম উৎস সুন্দরবন। কাঠের উপর নির্ভরশীল শিল্পের কাঁচামালের এক বিশাল অংশ জোগান দিয়ে আসছে সুন্দরবন।বহুমানুষ সুন্দরবন কেন্দ্রীক জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় নানা অজুহাতে নির্বিচারে গাছ কেটে উজাড় করা হচ্ছে বনটি।

২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইন্সটিটিউটের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়‘সিডর’-এর সময় সুন্দরবন দেশের দক্ষিণ-পশিমাঞ্চলের ৪৮৫ দশমিক ২৯ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ রক্ষা করেছিল। গবেষকেরা বলছেন, সুন্দরবন না থাকলে টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি হতো। সম্প্রতিআইপিসিসিএর এক প্রাক্কলনে দেখানো হয়েছে যে, ২০৫০ সালে বাংলাদেশ তার ভূমির ১৭ শতাংশ এবং খাদ্য উৎপাদনের ৩০ শতাংশ হারাবে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাসমূহ এবং এসব জেলায় বসবাসরত জনগোষ্ঠী। সুতরাং ভবিষ্যতের মহাবিপদ হতে রক্ষা পেতে হলে আমাদের অবশ্যই সুন্দরবন রক্ষা করতে হবে। জাতীয় স্বার্থেই সুন্দরবন রক্ষার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

লেখক
উন্নয়নকর্মী

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন