আদালতের
নির্দেশনা মেনে গত রোববার বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) ১ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে গ্রামীণফোন।
আর গতকাল আপিল বিভাগ কোম্পানিটিকে আগামী তিন মাসের মধ্যে আরো ১ হাজার কোটি টাকা
দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সব মিলিয়ে ২ হাজার কোটি টাকা পরিশোধের কারণে চলতি হিসাব
বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির
আর্থিক ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গ্রামীণফোনের
৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত ২০১৯ হিসাব বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী অনুসারে কোম্পানিটির
কাছে ১ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকার নগদ অর্থ রয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯ হিসাব বছরে
শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ঘোষিত ৪০ শতাংশ চূড়ান্ত লভ্যাংশ পরিশোধে ৫৪০ কোটি টাকা ব্যয়
হবে। লভ্যাংশের অর্থ পরিশোধের পর কোম্পানিটির কাছে প্রায় ৮৩৬ কোটি টাকার নগদ অর্থ
থাকবে। বর্তমানে গ্রামীণফোনের কাছে প্রায় ১ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকার রিটেইনড আর্নিংস
বা পুঞ্জীভূত সঞ্চিতি রয়েছে। ২০১৯ হিসাব বছরে গ্রামীণফোনের ৩ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা
কর-পরবর্তী মুনাফা হয়েছে। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে
কোম্পানিটির ৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে। আর ছয় মাসে কোম্পানিটির মুনাফার
পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৭০২ কোটি টাকা। যেখানে এ বছরের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে
বিটিআরসিকে ২ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে।
নিরীক্ষা দাবির সাড়ে ১২ হাজার কোটির টাকার মধ্যে ২ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করতে গত বছরের নভেম্বরে তিন মাস সময় দিয়ে রায় দেন আদালত। এর বিরুদ্ধে চলতি বছরের জানুয়ারিতে গ্রামীণফোন রিভিউ পিটিশন দাখিল করে। রিভিউ পিটিশনের শুনানিতে সোমবারের মধ্যে ১ হাজার কোটি টাকা ও পিটিশনের রায়ে তিন মাসের মধ্যে বাকি ১ হাজার কোটি টাকা দেয়ার নির্দেশ দেন আদালত।
দেশের
শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের সঙ্গে বিটিআরসিকে অর্থ
পরিশোধের পর গ্রামীণফোনের আর্থিক বিবরণীতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, সেটি জানতে চাওয়া হয়েছিল। তারা বলছেন, কী
ধরনের প্রভাব পড়তে পারে সেটি নির্ভর করবে বিটিআরসিকে পরিশোধ করা অর্থ আর্থিক
বিবরণীতে কীভাবে দেখানো হবে তার ওপর। বিটিআরসিকে দেয়া অর্থ যদি গ্রামীণফোন তার
কাছে থাকা নগদ অর্থ থেকে পরিশোধ করা হয়েছে দেখায়, তাহলে
এর রিটেইনড আর্নিংস কমে যাবে। অন্যভাবে বলা যায়, এতে
কোম্পানির ইকুইটি কমবে। এতে স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) কমে যাবে। আবার যদি নগদ অর্থ থেকে কিছু
অংশ এবং ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কিছু অংশ পরিশোধ করা হয়, তাহলে কোম্পানির দায় বাড়ার পাশাপাশি সুদজনিত ব্যয় বেড়ে যাবে। আর
সুদজনিত ব্যয় বাড়লে কোম্পানির কর-পরবর্তী মুনাফাও কমবে। আবার এ বিষয়ে
যেহেতু আইনি প্রক্রিয়া চলমান,
তাই এটির ফলাফলের
ওপরও তা নির্ভর করছে।
পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট
অন্যতম শীর্ষস্থানীয় একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, গ্রামীণফোন
বিটিআরসির দাবীকৃত অর্থ ন্যায়সংগত হিসেবে মনে না করার কারণে আর্থিক বিবরণীতে এ-সংক্রান্ত কোনো সঞ্চিতি সংরক্ষণ করেনি বলে জানিয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে
তারা সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে আয় বাড়া সত্ত্বেও শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশের
পরিমাণ অনেক কমিয়েছে। তাছাড়া ৪০ শতাংশ চূড়ান্ত লভ্যাংশ কোম্পানিটির অধিকাংশ
শেয়ারের মালিকানায় থাকা টেলিনর অনুমোদন নাও করতে পারে বলে জানিয়েছে গ্রামীণফোন।
ফলে বিটিআরসিকে অর্থ পরিশোধ করতে কোম্পানি যাতে কোনো সমস্যায় না পড়ে, সে ধরনের প্রস্তুতি তারা আগেই নিয়ে রেখেছে।
বিটিআরসির
দাবি অনুযায়ী, নিরীক্ষা আপত্তিতে গ্রামীণফোনের কাছে
১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ ও আরেক সেলফোন অপারেটর রবি আজিয়াটার কাছে ৮৬৭ কোটি ২৩
লাখ টাকা পাওনা রয়েছে সরকারের। গ্রামীণফোনের কাছে দাবি করা সাড়ে ১২ হাজার কোটির
মধ্যে বিটিআরসির পাওনা ৮ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল পাওনা ২ হাজার ২৯৯
কোটি এবং বাকি ৬ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা বিলম্ব ফি ও সুদ। এর বাইরে ৪ হাজার ৮৬ কোটি
টাকা পাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
(এনবিআর)।
গত
বছরের এপ্রিলে পাওনা অর্থ দাবি করে গ্রামীণফোন ও রবিকে নোটিস পাঠায় বিটিআরসি।
পরবর্তী সময়ে অপারেটর দুটির এনওসি প্রদান বন্ধ করে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। পাওনা
অর্থ আদায়ে দুই সেলফোন অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবির লাইসেন্স কেন বাতিল হবে না, তা জানতে চেয়ে গত ৫ সেপ্টেম্বর অপারেটর দুটিকে চিঠি দেয় বিটিআরসি। এর
আগেই ঢাকার দেওয়ানি আদালতে আলাদাভাবে দুটি মামলা করে গ্রামীণফোন ও রবি। গত ২৫
আগস্ট মামলা করে রবি। আর গ্রামীণফোন মামলা করে ২৬ আগস্ট।
গত
বছরের ১৭ অক্টোবর বিটিআরসির নিরীক্ষা আপত্তি দাবির ওপর দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা দেন
হাইকোর্ট। বিটিআরসি লিভ টু আপিল করলে আপিল বিভাগ গ্রামীণফোনকে ২ হাজার কোটি টাকা
দিতে নির্দেশ দেন। আপিল বিভাগের আদেশের বিরুদ্ধে গ্রামীণফোন গত ২৬ জানুয়ারি রিভিউ
পিটিশন দাখিল করে। এতে ২ হাজার কোটি টাকার পরিবর্তে ৫৭৫ কোটি টাকা দেয়ার অনুমতি
চেয়ে আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছে গ্রামীণফোন। নিরীক্ষা দাবির মূল পাওনার ২৫ শতাংশ
হিসেবে প্রায় ৫৭৫ কোটি টাকা জমা দিতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। আর আদালতের বাইরে আলোচনার
অংশ হিসেবে গত বুধবার বিটিআরসিকে ১০০ কোটি টাকা দেয়ার প্রস্তাব দিলেও তা
প্রত্যাখ্যান করে সংস্থাটি। পরদিন রিভিউ পিটিশনের শুনানি শেষে ২৪ ফেব্রুয়ারির
মধ্যে ১ হাজার কোটি টাকা দিতে নির্দেশ দেন আদালত।
গ্রামীণফোনের
হেড অব এক্সটার্নাল কমিউনিকেশন মুহাম্মদ হাসান এ প্রসঙ্গে জানান, আপিল বিভাগ নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখায় আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আদেশটি
পর্যালোচনা করে পরবর্তী সময়ে মন্তব্য করা যাবে।
দেশের
অন্যতম শীর্ষস্থানীয় একটি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস ফার্মের পার্টনার, যিনি একসময় পেশাদার হিসাববিদদের সংগঠন দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড
অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি বণিক বার্তাকে বলেন,
গ্রামীণফোন এখনো
পর্যন্ত বিটিআরসির দাবীকৃত অর্থকে তাদের দায় হিসেবে স্বীকার করেনি। তাই আমার মনে
হয়, সরকারের চাপের পাশাপাশি আদালতের নির্দেশের কারণে
তারা দিতে বাধ্য হলেও এটিকে দায় হিসেবে না দেখিয়ে অ্যাডভান্সড (অগ্রিম) হিসেবে দেখাবে। অবশ্য অগ্রিম হিসেবে
দেখালেও কোম্পানির ব্যালান্সশিট থেকে নগদ অর্থ বেরিয়ে যাওয়ার কারণে আর্থিক
বিবরণীতে এর একটা প্রভাব তো থাকবেই। তাছাড়া কোম্পানির নগদ প্রবাহের ওপরও এতে চাপ
তৈরি হবে। তবে আদালতে বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হলে তখন কোম্পানির আর্থিক ফলাফলের
ওপর এর সামগ্রিক প্রভাব কী হবে,
সেটি
পূর্ণাঙ্গভাবে বোঝা যাবে বলে জানান তিনি।