নরম্যান বেটস থেকে জোকার

সিনেমায় পাগলামি

গত শতকের আশির দশকে হলিউডের পর্দায় অন্যতম কাঙ্ক্ষিত পুরুষ ছিলেন আর্নল্ড সোয়ার্জনেগার। গত বছরের শেষে বড় পর্দায় সাইকোড্রামা ছবিতে দেখা গেছে তার পুত্র প্যাট্রিক সোয়ার্জনেগারকে। ছবির নাম ড্যানিয়েল ইজ নট রিয়েল। ড্যানিয়েলের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন প্যাট্রিক। ছবিতে প্যাট্রিক মানসিক রোগে আক্রান্ত লুক নামের এক ছাত্র আলোকচিত্রীকে সাহায্য করতে তার কাল্পনিক বন্ধুর ভূমিকা গ্রহণ করেন।    

ড্যানিয়েল ইজ নট রিয়েল ছবির পরিচালক অ্যাডাম ইজিপ্ট মর্টিমার কাজ করেছেন মানসিক রোগ নিয়ে। তবে মানসিক রোগকে ভিত্তি করে এটা দুনিয়ার সেরা ছবি নয়। গত বছরের অন্যতম আলোচিত ছবি জোকারও মনস্তাত্ত্বিক ছবি। চিকিৎসাশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে জোকার। তবে তারা অনেকেই ছবিটিকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছেন, তাদের কথায়, ‘জোকারে গুরুতর মানসিক অসুস্থতা এবং চরম সহিংসতার মধ্যকার গতানুগতিক সম্পর্ককেই দেখানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চলচ্চিত্রে মানসিক অসুস্থতা বিষয়ে কিছু দেখাতে হলে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

একই বছরে জোকার কিংবা ড্যানিয়েল ইজ নট রিয়েলের মুক্তি দেখে এমনটা ভাবার কারণ নেই যে, হঠাৎ করেই মানসিক অসুস্থতা নিয়ে সাইকোড্রামা তৈরির হিড়িক পড়েছে। সাইকোড্রামা একটি জটিল বিষয় এবং ধরনের ছবি সবসময় বক্স অফিসে সাফল্য পায় না।

নরম্যান বেটসের মতো মানসিক অসুস্থ চরিত্রগুলো সবসময় সাইকোড্রামায় খলচরিত্র হিসেবে উপস্থাপন হয়েছে এমন নয়। ওয়ান ফ্লিউ ওভার দ্য কাকু নেস্ট (১৯৭৫) থেকে বিউটিফুল মাইন্ড (২০০১) কিংবা সিলভার লিনিংস প্লেবুক (২০০১) ছবিগুলোয় মানসিক অসুস্থরাই ছিলেন নায়ক। ছবিগুলো দেখিয়েছে মানসিক অসুস্থতায় ভোগা মানুষদের জন্য প্রয়োজন সহানুভূতি।

জোকার বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়েছে। ছবিটি ১০০ কোটি ডলারের বেশি আয় করেছে। ড্যারেন অ্যারোনোফস্কির ব্ল্যাক সোয়ান (২০১০) অবশ্য বাণিজ্যিকভাবে সফল ছিল না।

জোকারের সমর্থকরা বলেন, মানসিক অসুস্থদের বিচ্ছিন্নতা, তাদের সমস্যা, অভিজ্ঞতাকে চলচ্চিত্রে তুলে ধরাটা জরুরি এবং সঠিক কাজ। তাদের দাবি আবার আরেকটি প্রশ্নকে হাজির করেবড় পর্দায় মানসিক অসুস্থতাকে তুলে ধরার বিশুদ্ধ কোনো নিয়ম আছে কিনা? ছবিতে বিষয়ে দুই ধরনের অ্যাপ্রোচ দেখা যায়, একটি হচ্ছে বাস্তবসম্মত চিত্রায়ণ, যেখানে জোর দেয়া হয় মানুষের মনস্তত্ত্বের অভ্যন্তরীণ সংকট এবং পরিবর্তনের ওপর। অন্যদিকে আছে জোকারের মতো উত্তেজনায় ভরা গল্প, রঙচঙে দৃশ্যায়ন।


মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসে গল্প পাঠকের মনে যতটা বিশদ এবং সূক্ষ্মভাবে প্রবেশ করতে পারে, ছবিতে সেটা সম্ভব হয় না। ছবিতে গুরুত্ব পায় সহজ দৃশ্যায়ন নাটকীয়তা। এমনকি সাইকোড্রামায় খুব বাস্তববাদী বলে পরিচিত ছবিগুলোও নাটকীয়তার সমস্যায় আক্রান্ত হয়। ১৯৯৯ সালে গার্ল, ইন্টেরাপ্টেড ছবিতে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি অভিনয় করেন সোশিওপ্যাথ লিসার ভূমিকায়। ছবিটিও নাটকীয়তার সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। একই ঘটনা হাল আমলের ছবি ড্যানিয়েল ইজ নট রিয়েলেও দেখা যায়।

এটাও সত্য বিশেষজ্ঞরা জোকার ছবিতে মানসিক রোগের বিশুদ্ধতা উপস্থাপন নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছেন, তা পুরোপুরি সমালোচনাযোগ্য। লাইট, ক্যামেরা ব্যবহার করে ভিজ্যুয়াল ভোকাবুলারি তৈরির ধারা চালু হয়েছে গত শতকের বিশের দশকে, জার্মান এক্সপ্রেশনিজমের মধ্য দিয়ে। সে সময় সমাজের তলায় যে অসুস্থ, অসন্তুষ্ট, রোগাক্রান্ত শক্তি ফুঁসছে, সেটা দেখানোর আগ্রহ ছিল।

মানসিক অসুস্থতা এবং মনস্তাত্ত্ব্বিক সংকট নিয়ে জার্মান এক্সপ্রেশনিজমের যে মাতামাতি দেখা যায় তা ছিল গথিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা। টড ফিলিপসের জোকার সে ধারাবাহিকতাই রক্ষা করেছে। ১৯২৮ সালে জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট পল লেনি ভিক্টর হুগোর উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি করেন দ্য ম্যান হু লাফস। আজকের দিনে নগর সভ্যতায় মানসিক চাপ, অসুস্থতা দুটোই বাড়ছে। নিজের কথা অন্যকে না শোনাতে পারার হাহাকার এবং যন্ত্রণা এখন সুলভ ঘটনা। আর বিচ্ছিন্নতার হাহাকারের ত্রাস দেখা যায় টড ফিলিপসের জোকারে।

অনেক সমালোচক মনে করেন, মানসিক অসুস্থতা নিয়ে তৈরি ছবিতে বাস্তববাদিতা তাই শতভাগ থাকতে হবে, এমন দাবি করার যুক্তি নেই। কারণ অন্দরের কল্পনা কীভাবে অসুস্থ মন প্রকাশ করবে, তা কেউ জানে না। মানসিক রোগাক্রান্তরা বিপজ্জনক এমন ধারণাকে অনেক ছবি ভেঙে দিয়েছে। রাসেল ক্রো অভিনীত বিউটিফুল মাইন্ড তার উজ্জ্বল উদাহরণ। অ্যাঞ্জেলিনা জোলি অভিনীত গার্ল, ইন্টেরাপ্টেড ছবিতে একটি সংলাপ ছিল রকম, ‘বিষয়গুলো খাতায় লিখে রাখো... এবং এগুলো থেকে নিজে বেরিয়ে আসো।আর ড্যানিয়েল ইজ নট রিয়েল ছবিতে একটি সংলাপ—‘কাউকে কোনো কাজ করতে যত না করবে, সে তত বেশি সেটা করতে চাইবে।মানসিক রোগের মতো নিয়ে তৈরি ছবির জগত্টাও বিচিত্র, জটিল, রহস্যময়এখানে শেষ কথা, দৃশ্য কিংবা উপস্থাপনের বিশুদ্ধতা বলে কিছু হয় না।

 

দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে শানজিদ অর্ণব

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন