প্রশান্ত কুমার
হালদার। আর্থিক খাতের একজন শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক এবং তার
আগে রিলায়েন্স ফিন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বেতন-ভাতাসহ বৈধ উৎস থেকে তার আয় ছিল ১২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। কিন্তু এর বাইরে আরো
প্রায় ২৭৫ কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মালিক প্রশান্ত হালদার, যার কোনো বৈধ উৎস দেখাতে পারেননি তিনি। দুর্নীতি দমন
কমিশনের (দুদক)
অনুসন্ধান বলছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহী থাকা অবস্থায়
দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিপুল এ সম্পদ অর্জন করেছেন প্রশান্ত।
শুধু সম্পদ
অর্জন নয়, অবৈধভাবে অর্জিত এ সম্পদের বড় একটি অংশ পাচারও
করেছেন প্রশান্ত হালদার। ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী হলেও ব্যক্তিগত ও নিজের
স্বার্থসংশ্লিষ্ট কয়েকটি ব্যাংক হিসাবে বিভিন্ন সময়ে ১ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা জমা
করেছেন তিনি, যা পাচার হয়েছে বলে মনে করছে দুদক।
দুদকের
অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রশান্ত হালদার তার নিজ নামে পরিচালিত ব্যাংক
হিসাবে ২৪০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা,
তার মা লীলাবতীর নামে
পরিচালিত ব্যাংক হিসাবে ১৬০ কোটি টাকা এবং নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন
প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে আরো ১ হাজার ২৩৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা জমা করেন এবং
পরবর্তী সময়ে এ টাকা উত্তোলন করে অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলেন।
জানা গেছে, অবৈধ ব্যবসাসহ বিভিন্ন অবৈধ উৎস থেকে অর্জিত সম্পদের বেশির
ভাগই বিদেশে, বিশেষ করে কানাডায় পাচার করেছেন প্রশান্ত হালদার।
বর্তমানে নিজেও বিদেশে অবস্থান করছেন তিনি। তবে ঢাকায় তার নামে একাধিক বাড়ি, প্লট ও ফ্ল্যাট রয়েছে এবং নামে-বেনামে একাধিক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। জ্ঞাত আয়ের উেসর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ২৭৪ কোটি
৯১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৫ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে
মামলা করেছে দুদক। মামলাটি করেছেন দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী।
ক্যাসিনো-সংশ্লিষ্টতার মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে প্রথম যে ৪৩ জনের বিরুদ্ধে
দুদক অনুসন্ধান শুরু করে, তাদের মধ্যে প্রশান্ত কুমার হালদার ছিলেন একজন।
এছাড়া তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন লিজিং কোম্পানির ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে
পাচারের আরেকটি অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক।
অভিযোগে বলা হয়েছে, রিলায়েন্স ফিন্যান্সের এমডি থাকা অবস্থায় তিনি নিজের আত্মীয়স্বজনকে আরো বেশ কয়েকটি লিজিং কোম্পানির ইনডিপেনডেন্ট পরিচালক বানান এবং একক কর্তৃত্বে অদৃশ্য শক্তির মাধ্যমে পিপলস লিজিংসহ বেশ কয়েকটি লিজিং কোম্পানির টাকা কৌশলে বের করে আত্মসাৎ করেন।
অনুসন্ধানে দুদক
প্রশান্ত কুমার হালদারের ১৮৭ কোটি ৭৮ লাখ ৫২ হাজার ৪৩০ টাকার স্থাবর সম্পদের খোঁজ
পেয়েছে। এসব সম্পদের মধ্যে তার নিজ নামে রয়েছে ৬৩ কোটি ২৪ লাখ ১৮ হাজার ৪৩০ টাকা।
আর লিপরো ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে রয়েছে ১২৩ কোটি ৫৪
লাখ টাকার সম্পত্তি। এসব সম্পত্তির হিসাব তিনি তার আয়কর নথিতেও প্রদর্শন করেননি।
দুদকের কর্মকর্তারা অনুসন্ধানে এসব স্থাবর সম্পদ অর্জনের কোনো বৈধ উৎস খুঁজে
পাননি।
প্রশান্ত হালদার
কীভাবে নানা কৌশলে কাগুজে প্রতিষ্ঠান গড়ে সম্পদ স্থানান্তর করেন, তার একটি বর্ণনাও তুলে ধরা হয়েছে দুদকের মামলার এজাহারে।
লিপরো ইন্টারন্যাশনালের বিষয়ে এতে বলা হয়েছে,
লিপরো ইন্টারন্যাশনালের
শেয়ারহোল্ডার হলেন উত্তম কুমার মিস্ত্রি,
তার স্ত্রী রচনা মণ্ডল ও
পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড। পিঅ্যান্ডএল কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার ও
চেয়ারম্যান হলেন উদ্দাব মল্লিক ও এমডি সোমা ঘোষ এবং হাল ইন্টারন্যাশনাল। হাল
ইন্টারন্যাশনালের মেমোরেন্ডাম অব আর্টিকেল অ্যাসোসিয়েশন পর্যালোচনায় দুদকের
কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন,
প্রতিষ্ঠানটির মালিক
প্রশান্ত হালদার।
প্রশান্ত হালদারের অবৈধ সম্পদের উৎস অনুসন্ধানে ময়মনসিংহের ভালুকা সাবরেজিস্ট্রি অফিস থেকেও বিভিন্ন দলিলের তথ্য সংগ্রহ করেছে দুদক। সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায়, ভালুকা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের নয়টি দলিলমূলে ভালুকা উপজেলার হাতীবেড় এবং উথুরা মৌজায় নিজ নামে মোট ৫৮৯ শতক জমি কিনেছেন প্রশান্ত হালদার, যার মূল্য ১ কোটি ৩৪ হাজার টাকা। তবে এ সম্পত্তি ক্রয়ের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো আয়ের উৎস দেখানো হয়নি। ফলে দুদক এ সম্পত্তিকে বৈধ উপায়ে অর্জিত জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
দুদকের
অনুসন্ধান কর্মকর্তারা প্রশান্ত হালদারের আয়কর নথি ও অন্যান্য রেকর্ডপত্রও
পর্যালোচনা করে দেখেছেন। সেসব নথি পর্যালোচনা করে তারা জানতে পেরেছেন, প্রশান্ত হালদার তার নিজ নামে ৩২ কোটি ২৫ লাখ ৫৮ হাজার ৭২৬
টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য উল্লেখ করেছেন। তবে এসব অস্থাবর সম্পদ অর্জনের
সপক্ষে সুনির্দিষ্ট আয়ের কোনো বৈধ উৎস দুদকের অনুসন্ধানে পাওয়া যায়নি।
দুদকের
অনুসন্ধান বলছে, আটটি কোম্পানিতে নিজের নাম এবং নিকটাত্মীয় ও
কর্মচারীদের নাম ব্যবহার করে ৬৭ কোটি ৩৫ লাখ ৪৪ হাজার ১৯৯ টাকা বিনিয়োগ করেছেন
প্রশান্ত হালদার। আর এসব বিনিয়োগের স্বপক্ষে সুনির্দিষ্ট কোনো বৈধ আয়ের উৎস দুদকের
অনুসন্ধান কর্মকর্তারা খুঁজে পাননি।
এর মধ্যে
রেপটাইলস ফার্ম নামের একটি প্রতিষ্ঠানে পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, রাজিব সৌম ও তার স্ত্রী শিমু রায়ের নাম ব্যবহার করে ৫ কোটি
৬৯ লাখ ৪ হাজার টাকা, সুখাদা লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানে নিজ নামের
পাশাপাশি অবন্তিকা বড়াল, প্রীতিষ কুমার হালদার এবং সুসমিতা সাহার নামে ৩০
লাখ টাকা, নর্দান জুট ম্যানুফ্যাকচারিং নামের প্রতিষ্ঠানে
উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও অমিতাভ অধিকারীর নাম ব্যবহার করে ৩০ লাখ টাকা, সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ নামের প্রতিষ্ঠানে মো. সিদ্দিকুর রহমান,
মাহফুজা রহমান, নিয়াজ রহমান সাকিব,
ইসতিয়াক রহমান ইমরান ও মো. ইনসান আলী শেখের নাম ব্যবহার করে ২৩ কোটি ৩৮ লাখ ১৬ হাজার
২৭০ টাকা, আজিজ ফ্যাব্রিকস নামের প্রতিষ্ঠানে পিঅ্যান্ডএল
ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ও রামপ্রসাদ রায়ের নাম ব্যবহার করে ৬২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা, আনান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ নামের প্রতিষ্ঠানে অভিজিৎ
অধিকারী তীর্থ ও প্রীতিষ কুমার হালদারের নাম ব্যবহার করে ৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা এবং
ক্লিউইস্টন ফুড অ্যান্ড অ্যাকোমোডেশন নামের প্রতিষ্ঠানে মো. আব্দুল আলিম চৌধুরী,
মো. জাহাঙ্গীর আলম,
মো. সিদ্দিকুর রহমান,
রতন কুমার বিশ্বাস, পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, অমিতাভ অধিকারী, সিমটেক্স টেক্সটাইল,
জেডএ অ্যাপারেলস, মো. আলমগীর হোসেন, পিঅ্যান্ডএল
অ্যাগ্রো ফার্মস, আনান কেমিক্যাল ও উইনমার্ক লিমিটেডের নাম ব্যবহার
করে ৩১ কোটি ৪৫ লাখ ২৬ হাজার ৪০০ টাকা বিনিয়োগ করেছেন প্রশান্ত হালদার।
এছাড়া রহমান
কেমিক্যালস লিমিটেড, পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড, আর্থস্কোপ
লিমিটেড, নিউট্রিক্যাল লিমিটেড, রহমান কেমিক্যালস লিমিটেড, রতন কুমার
বিশ্বাস, রাজীব সৌম,
অমিতাভ অধিকারী, আনন্দ মোহন রয়,
প্রশান্ত কুমার চক্রবর্তীর
নাম ব্যবহার করে ও নিজ নামে ৬৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছেন প্রশান্ত হালদার।