বিপন্নপ্রায় স্থাপত্যের জীবন্ত জীবাশ্ম

সৌমেন হাজরা

বইমাত্রই যেমন সাহিত্যকর্ম নয়, স্থাপনামাত্রই তেমন স্থাপত্য নয়। একটি বই তখনই সাহিত্যকর্ম হয়ে ওঠে যখন তা পাঠকের কাছে বিমূর্ত হয় তারই নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন হিসেবে। কালজয়ী সাহিত্য পাঠকের মননে যে চেতনার স্ফুরণ ঘটায়, তা বহুমাত্রিক। সাহিত্যের পুনর্পাঠ পৌনঃপুনিকভাবে নবতর মাত্রার বিস্তৃতি ঘটায়। স্থান-কালের বাধা অতিক্রম করে তা হয়ে ওঠে সর্বজনীন, কালোত্তীর্ণ। স্থাপত্যও তেমনি দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আর উচ্চতায় সীমাবদ্ধ একটি ত্রিমাত্রিক ক্ষেত্র বা অবয়ব শুধু নয়। চতুর্থ মাত্রায় সেই পরিসর এবং নির্দিষ্ট প্রসঙ্গ কাঠামোতে সেই অবয়ব যখন অনুধাবনকারীর কাছেশুধু নান্দনিকতায় নয়, সামগ্রিকভাবে তার উপলব্ধিতেপ্রেরণাদায়ক সুখানুভূতির দ্যোতনা ঘটাতে সক্ষম হয়, তখনই তা হয়ে ওঠে স্থাপত্য। স্থাপত্য প্রায়োগিক শিল্প। মানুষ পাঁচটি মাত্র ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুধাবন করে জাগতিক সবকিছু, যা মস্তিষ্কে তার অতীতলব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্লেষিত হয়ে যে চিত্র তার মানসপটে তৈরি করে, সেটাই ওই বিষয়ে তার উপলব্ধি। শিল্পকর্ম তখনই শিল্পোত্তীর্ণ হয় যখন তা রসাস্বাদনকারীর কাছে বিনির্মিত হয় অনুপ্রেরণা হিসেবে।

বিশিষ্ট স্থপতি প্রত্নস্থাপত্য সংরক্ষণবিশারদ অধ্যাপক আবু সাঈদ স্থাপত্য সম্পর্কে তার উপলব্ধির কথা প্রসঙ্গে ঢাকা শহরের দুটি স্থাপনার কথা উল্লেখ করেন, যে দুটি স্থানে তিনি যতবার গিয়েছেন প্রতিবার যেন সেই পরিসর, এর আঙ্গিক স্থানিক অবয়ব তার কাছে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় ধরা পড়েছে। এর একটি হলো স্থপতি কানের অনন্য সৃষ্টি জাতীয় সংসদ ভবন আর অন্যটি শাঁখারীবাজারের পুরনো বাড়িগুলো। আন্দ্রেই তারকাভস্কি বলেছিলেন, একটি বই হাজারো পাঠকের কাছে হয়ে ওঠে হাজারো বই। শুধু কি তাই, একই বইয়ের পুনর্পাঠ যেন নতুন এক আবিষ্কার, নবতর অনুধাবন। স্থাপত্যকর্মের মর্ম উপলব্ধিও তেমনই, স্বতন্ত্রের কাছে তা অনন্য। আবার যেহেতু প্রত্যেক স্বতন্ত্রের সত্তা ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়, পরিণত হয়, হয় অভিজ্ঞ, প্রতিবার ওই শিল্পরূপ পুনর্নির্মিত হয় তার উপলব্ধিতে, নতুন রূপে। মহান স্থপতি লুই আই কানের অনবদ্য স্থাপত্য আমাদের মহান জাতীয় সংসদ ভবন। শুধু অবয়ব, বহিরাবরণ, গঠন উপাদান বা বিন্যাসে নয়, স্থানের পরম্পরা কিংবা পরিসরের ব্যাপ্তি এবং ব্যঞ্জনা তা ব্যবহারকারীর উপলব্ধির ক্ষেত্রে সতত পরিবর্তনশীল দ্যোতনার সৃষ্টি করে। প্রতিটি স্থান সামগ্রিকভাবে অন্যান্য স্থানের সঙ্গে নিবিড় বুননে গাঁথা। স্থান স্থানের মধ্যে, অবয়ব অবয়বের মধ্যে এমনভাবে গ্রথিত, যা এক নিরবচ্ছিন্ন ঐকতানের সৃষ্টি করে।

অন্যদিকে শাঁখারীবাজারের পুরনো বাড়িগুলোকে স্থাপত্যের জীবন্ত জীবাশ্মের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। ঢাকা শহরের জন্মলগ্ন থেকে এর ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে জড়িত এই বাড়িগুলোর অস্তিত্ব। মূলত ক্ষুদ্র এক বাণিজ্য নগরী হিসেবে গোড়াপত্তন ঘটে ঢাকার। একদিকে ধোলাইখাল আর অন্যদিকে বুড়িগঙ্গা নদী, এরই মধ্যে সীমাবদ্ধ ভূখণ্ডে হস্ত কুটির শিল্পী আর বণিকদের দ্বারা গড়ে ওঠা বাজার ক্রমান্বয়ে বৃহৎ জনপদে পরিণত হয়। বিশেষায়িত হস্ত কুটির শিল্পনির্ভর বণিক সম্প্রদায় এমন এক বিশেষ আবাসন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন