রাজধানীর প্রথম মসজিদ

ড. মো. আদনান আরিফ সালিম

একসময় ঢাকাকে বলা হতোমসজিদের শহর বলা বাহুল্য, সাধারণ বিচারে শহরে মসজিদের আধিক্যের কারণেই অমন পরিচিতি যুক্ত হয়েছে। তবে মসজিদের শহরের প্রথম মসজিদ কোনটি তা নিয়ে অনেকের মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকতে পারে। মূলত ১৫ শতকের মাঝপর্বে ঢাকায় নির্মিত একটি মসজিদ শনাক্ত করা গেছে। তাই সময়ের বিচারে আদিতম মসজিদ এটিই। মসজিদটির মূল অংশ বহু সংস্কারের পথ ধরে এখনো টিকে আছে, যাকে ঢাকার নারিন্দায় অবস্থিত বখত বিনতের মসজিদ হিসেবে শনাক্ত করা যায়। যদিও অনেক লেখক-গবেষকের অসাবধানী শব্দ ব্যবহারে এটি সাধারণ্যেবিনত বিবির মসজিদনামে অধিক পরিচিত।

ঔপনিবেশিক যুগে বাংলার ঐতিহ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে গবেষণা শুরু হয় বেশ জোরেশোরে। তখন ১৮৩২ সালের দিকে ঢাকায় নিযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেট জর্জ হেনরি ওয়াল্টার একটি প্রতিবেদনে ঢাকায় মসজিদের সংখ্যা দাবি করেন ১৫৩। আর পরিসংখ্যান বলছে, সংখ্যা ধীরে ধীরে আরো বেড়েছে। আর সময়ের আবর্তে ঢাকা পরিণত হতে থাকে অসংখ্য মসজিদের এক নগরীতে। জনবহুল শহর হিসেবে গড়ে ওঠা রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী অনেক মসজিদ হারিয়ে গেছে। নতুন করে নির্মাণ করতে গিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বেশ কয়েকটি। আলোচ্য বখত বিনতের মসজিদও এর বাইরে নয়। বেশ কয়েক দফা সংস্কার নির্মাণে মসজিদটি হারিয়ে যেতে বসেছিল তার পূর্বতন বৈশিষ্ট্য থেকে। ঐতিহ্য অনুরাগী স্থানীয় ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে আরো অনেকের চেষ্টায় সে যাত্রা রক্ষা পায় মসজিদটি।

রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তান থেকে অনুমান চার কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে টিকাটুলির খ্রিস্টান কবরস্থান পার হয়ে নারিন্দার মোড়ে প্রধান সড়কের পাশেই মসজিদটির অবস্থান। মসজিদের গায়ে সংযুক্ত ফার্সি অক্ষরে লেখা শিলালিপি পাঠে জানা যায়, ১৪৫৭ সালের দিকে মোগল সেনাপতি ইসলাম খানের বাংলায় আসার আনুমানিক ১৫০ বছর আগে নির্মাণ করা হয় মসজিদ। ইতিহাস থেকে দেখা যাচ্ছে, তখন বাংলার শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত স্বাধীন সুলতানি আমলে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শাসক নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহ। শিলালিপিতে উল্লিখিত মসজিদ নির্মাণের তারিখ ৮৬১ হিজরি, অর্থাৎ ১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দ। লিপিসাক্ষ্য অনুযায়ী সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহের শাসনামলে জনৈক মারহামাতের মেয়ে মুসাম্মাত বখত বিনত এটি নির্মাণ করান; নামকরণটি তার নামেই। আলোচ্য শিলালিপিটি মূল মসজিদের প্রধান প্রবেশপথেই লাগানো হয়েছিল। তবে এখন তা উত্তর দিক থেকে দ্বিতীয় প্রবেশপথের ঠিক উপরে রয়েছে।

প্রচলিত ইতিহাস আলেখ্যে অনেকে বলে থাকেন মধ্যযুগ অন্ধকার যুগ, তখন নারীর অধিকার ছিল না, তারা ছিল নির্যাতিত, নিগৃহীত নিষ্পেষিত। মসজিদ অমন ঢালাও মন্তব্য সমর্থন করে না। বখত বিনত মসজিদের নির্মাতা বলে সহজেই মন্তব্য করা যায়, ১৫ শতকে একজন মুসলিম নারী সমাজকর্মে অংশ নিতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মসজিদ কিংবা প্রাচীন স্থাপত্যের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, এখানেও অনেকটা তা-ই। অর্থাৎ লোককাহিনীর অন্তরালে চাপা পড়তে পড়তে হারিয়ে যেতে বসেছে মূল ইতিহাস। অন্যদিকে ইতিহাসের প্রাথমিক সূত্র নিয়ে গবেষণা না হওয়া থেকে শুরু করে মধ্যযুগ গবেষণায় আমাদের দেশের গবেষকদের অনীহা এবং অনেকটা গা-ছাড়া ভাব থাকায় বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস বের করে আনাটা বেশ কঠিন।

বখত বিনতের মসজিদ তথা প্রচলিত নামে বিনত বিবি মসজিদের ইতিহাস বের করে আনার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে এখানে প্রাপ্ত শিলালিপির ভাষ্য। সুলতানি আমলে প্রাপ্ত লিপিগুলোয় সাধারণভাবে আরবি ভাষার দেখা মেলে। কিন্তু এখানে আরবির সঙ্গে মিশ্রভাবে ফার্সি লিপির ব্যবহারও দৃষ্টিগোচর হয়। এক্ষেত্রে লিপিটি প্রথম নির্মাণযুগের, নাকি পরে কোনো একটি সময়ে সংস্কার

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন