পরিকল্পনা প্রণয়নে দুর্বলতা

টেকসই উন্নয়নের প্রতিবন্ধক

বাংলাদেশে পরিকল্পনা নিয়ে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো দীর্ঘমেয়াদি চিন্তার ঘাটতি। সম্প্রতি পরিকল্পনাবিদদের এক সম্মেলনে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় সব অনুষঙ্গ বিবেচনায় নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, উন্নত দেশে ১০০ বছরের মহাপরিকল্পনা করা হয়। দেশের পরিকল্পনাবিদরা স্বল্প সময়ের জন্য পরিকল্পনা করে থাকেন। জাতীয়ভাবে চিন্তা করে হোলিস্টিক প্ল্যান করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি ১০০ বছরের জাতীয় পরিকল্পনা করতে হবে। এক্ষেত্রে আলোচ্য সম্মেলনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স কর্তৃক উপস্থাপিত ১০ দফা সুপারিশ আমলে নেয়া দরকার। সন্দেহ নেই, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, ভূমি ব্যবহার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এসব বিষয়ের পরিকল্পনা করার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, খেলার মাঠ ও পার্ক, রাস্তাঘাটসহ সার্বিক বিষয়ে পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে নাগরিকরা সব সুযোগ-সুবিধা খুব সহজে ভোগ করতে পারে।

নগর ও শহরগুলোকে বিকেন্দ্রীকৃত ও কার্যকর স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে পরিচালনা, নগরায়ণের ইতিবাচক দিকগুলো চিহ্নিত এবং সেগুলোকে আরো শক্তিশালী এবং নেতিবাচক দিকগুলো পরিকল্পিতভাবে মোকাবেলার মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্থা, সুশীল সমাজ ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীসহ স্থানীয় নগরবাসীর অংশীদারিত্বে সবার বসবাসযোগ্য পরিকল্পিত নগরায়ণের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। মেগাসিটি, মহানগর, মাঝারি শহর এবং ছোট শহরগুলোকে সম্পৃক্ততার মাধ্যমে জাতীয় ও আঞ্চলিক অবকাঠামো উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করে নগর বসতির একটি সমন্বিত গ্রাম-শহর সংযোগ ও পারস্পরিক যোগাযোগ স্থাপনসহ ভারসাম্যপূর্ণ নগরায়ণের বিকেন্দ্রীকরণ ত্বরান্বিত করতে হবে। দেশের প্রধান প্রধান নগরী অভিমুখে অভিবাসনপ্রবণতা রোধ করে সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারসাম্যপূর্ণ নগরায়ণে যথাযথভাবে অভিবাসন পরিচালনা করতে হবে। স্থানীয় চাহিদার ভিত্তিতে পৌরসভা বা সিটি করপোরেশন জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিনিয়োগ পরিকল্পনাসহ উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করবে। পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল এলাকাগুলোর জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী কার্যক্রম হ্রাস করে সংবেদনশীল বা ঝুঁকিপূর্ণ ভূমি সম্পদ সংরক্ষণ; জনগণের অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্মুক্ত স্থানগুলো সংরক্ষণ; কার্যকর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে বিনোদনের জন্য বড় পরিসরে বিনিয়োগের সম্ভাবনা সৃষ্টি এবং পানি শোষণের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ; পাহাড়বেষ্টিত এলাকা, বিশেষ করে চট্টগ্রাম, সিলেট ও কক্সবাজার শহরে টিলা ও পাহাড় সংরক্ষণ; শহরের নিকটবর্তী অঞ্চল বা শহরতলি এলাকাকে অপরিকল্পিত উন্নয়ন থেকে রক্ষা করা ইত্যাদি।

পরিকল্পনা কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। একে সামগ্রিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখা প্রয়োজন। নইলে ঢাকা-চট্টগ্রাম নগরীর মতো সমস্যা তৈরি হতে থাকবে। পরিকল্পনার সময় সমন্বয়, সময় ও স্থায়িত্বের দিকে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। ইংল্যান্ডে ভূমি উন্নয়নের জন্য প্ল্যানিং পারমিশন নিতে হয়, বাংলাদেশেও লাগে। কিন্তু বাংলাদেশের প্ল্যানিং পারমিশনে একটি ব্যাপার একেবারেই নেই বা উপেক্ষিত, তা হচ্ছে বন্যার ঝুঁকি সমীক্ষা বা ফ্লাড রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট। ঢাকায় ডিএপি (ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান) বা ফ্লাড জোন পলিসি আছে। কিন্তু তাতে বন্যার বিষয়টি যে নিখুঁতভাবে নেয়া দরকার, সেটি অনুপস্থিত। বাংলাদেশের ডিএপির মতো ইংল্যান্ডে ফ্লাড জোনিং করা আছে সমগ্র দেশের, সেই সঙ্গে প্রতিটি অঞ্চলের জন্য স্ট্র্যাটেজিক ফ্লাড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট আছে। এ নিখুঁত ফ্লাড রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট প্ল্যানিং পারমিশনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। গবেষণা আর প্রায়োগিক জ্ঞানের মাধ্যমে ইংল্যান্ড এসব সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, তাই আমাদের আর নতুন করে কিছু আবিষ্কার করার দরকার নেই, তাদের জ্ঞান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মিলিয়ে প্রয়োগ করলে সুফল মিলবে। অন্যান্য উন্নত দেশও এ পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে।

আমরা টেকসই উন্নয়ন চাই। সবুজ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে দূষণমুক্ত উন্নয়ন, যেখানে নদ-নদীর পানি থাকবে স্বচ্ছ সলীলা। আমাদের ঘর-গৃহস্থালি ও কল-কারখানার দূষিত বর্জ্য পড়বে না বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা কিংবা কর্ণফুলীতে। উন্নয়ন হবে; তবে বনবাদাড় উজাড় করে নয়, খাল-বিল, নদী-নালা দখল করে নয়। টেকসই উন্নয়নের পথে বাংলাদেশ অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সব সময়ই বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ, নদীভাঙন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, জলাবদ্ধতা এসব সমস্যার সম্মুখীন। বৈজ্ঞানিক প্রমাণ রয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত ঝুঁকি ও নাজুক পরিস্থিতি বাংলাদেশে তীব্রতর হয়েছে। বনাঞ্চলের ক্ষতি, ভূমিক্ষয়, জলাশয়ের দূষণ এবং অন্যান্য অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে প্রতিবেশের অবনতি ঘটেছে।

বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নীতিমালা ও কর্মসূচিতে পরিবেশগত সমন্বয় জোরদারের বিষয়টি এসব পরিকল্পনা ও কর্মসূচির বাস্তবায়ন সফল হওয়ার জন্য জরুরি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর বাজেট ও সামর্থ্য বৃদ্ধি সরকারের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়াবে। একই সময়ে শীর্ষ পর্যায় থেকে নিচের পর্যায় পর্যন্ত ভূমিকা ও দায়িত্ব, পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা বিকেন্দ্রীকরণ সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা প্রয়োজন। ডেল্টা ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার জন্য জরুরি এবং এটি শক্তিশালী করাও প্রয়োজন। সবুজ প্রবৃদ্ধি কৌশলের জন্য পরিকল্পনা ও বাজেটে পরিবেশগত বিষয়গুলো সম্পৃক্ত করা অপরিহার্য।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন