সিল্করুট

সমতট অঞ্চলের ইতিহাস অনুসন্ধানে সাম্প্রতিক ভাবনা

এ কে এম সাইফুর রহমান

পাঁচথুবী মন্থের মুড়ায় প্রাপ্ত ব্রোঞ্জের বৌদ্ধমূর্তি, রাজলীলাসনে উপবিষ্ট সিংহনাদ অবলোকিতেশ্বর। ছবি: লেখক

সমতট দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার একটি প্রাচীন জনপদ। নামটি বর্ণনামূলক, জাতিবাচক নয়। সমুদ্রগুপ্তের সময় থেকে (চতুর্থ শতাব্দী) এর স্বতন্ত্র অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। এলাহাবাদ প্রশস্তিতে ডবাক, কামরূপ, নেপাল ও কর্তৃপুরের সঙ্গে সমতট পূর্ব সীমান্তে প্রত্যন্ত রাষ্ট্র বলে উল্লিখিত হয়েছে। বৃহৎসংহিতায় (ছয় শতক) বঙ্গ থেকে পৃথক একটি জনপদ হিসেবে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। সপ্তম শতাব্দীতে বাংলা ভ্রমণকালে হিউয়েন সাঙ তার বর্ণনায় বলেন, কামরূপ (পূর্ব আসাম) থেকে দক্ষিণ দিকে ১২০০-১৩০০ লি (প্রায় ৩৫০ কিমি) অতিক্রম করে তিনি সমতট (সান-মো-তট-অ) পৌঁছেন, যার প্রদক্ষিণ পথ ছিল প্রায় ৩ হাজার লি (প্রায় ৮০০ কিমি)। জনপদটি ছিল সমুদ্রের পাশে অবস্থিত, নিচু ও আর্দ্র। তিনি বৌদ্ধ সংস্কৃতির কেন্দ্র ২০ লি (প্রায় ৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার) আয়তনবিশিষ্ট সমতটের রাজধানীর চিত্র তুলে ধরেন। ময়নামতি-লালমাই পাহাড় শ্রেণী এবং চারপাশের প্লাবন সমভূমি এলাকা হতে প্রাপ্ত রাত, দেব, চন্দ্র ও খড়্গ বংশের তাম্রশাসনে ‘‌সমতট’ ও রাজধানী ‘‌দেবপর্বত’ নামটির উল্লেখ আছে। গবেষকরা লালমাই-ময়নামতি পাহাড় শ্রেণীতে প্রাপ্ত প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষগুলো দেবপর্বতের সঙ্গে অভিন্ন বলে চিহ্নিত করেছেন।

প্রাচীন সমতট জনপদের অবস্থান শনাক্ত করা গেছে, কিন্তু এর বিস্তৃতি খুব ভালো করে চিহ্নিত নয়। বর্তমান কুমিল্লা জেলার লালমাই-ময়নামতি সমতটের কেন্দ্র বা রাজধানী ‘‌দেবপর্বত’ হিসেবে প্রমাণিত হলেও জনপদটির বিস্তৃতি সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা পাওয়া যায় না। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে ‘‌সমতট’ নামের অর্থ ‘‌সাগর উপকূলীয় সমতল ভূমি’। সে অর্থে বঙ্গোপসাগরের উপকূল ধরে বিস্তৃত গোটা সমতল অঞ্চলটিই অতীতে সমতট নামে পরিচিত ছিল বলে ধারণা করা যায়। অঞ্চলটিই গুপ্ত-পরবর্তী সময়ে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ-ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত দেব, খড়্গ, রাত ও চন্দ্র বংশের অন্যতম প্রধান জনপদ ছিল। সুতরাং সমতট সম্পর্কে হিউয়েন সাঙের বর্ণনা এবং সমতট নামের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অনুযায়ী ভৌগোলিকভাবে এ জনপদের অবস্থান ছিল একটি প্লাবন সমভূমিতে। অন্যদিকে সমতটের রাজধানী দেবপর্বত লালমাই-ময়নামতি পাহাড় শ্রেণীতে অবস্থিত। অর্থাৎ রাজধানী দেবপর্বত উঁচু পাহাড় শ্রেণীতে অবস্থিত হলেও জনপদটির বেশির ভাগ অংশই প্লাবন-সমভূমি ছিল বলে ধরে নেয়া যায়। ভূতাত্ত্বিকভাবে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের এ ভূমি ‘নবগঠিত’ ভূমিতে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সমতটের অবস্থান ও বিস্তৃতি নির্ণয় করা যেতে পারে। ময়নামতি-লালমাইসহ নবগঠিত প্লাবন-সমভূমি অর্থাৎ সমতটের অঞ্চলের ইতিহাস অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে সেটি সম্ভব হতে পারে।

এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে প্রাচীন হরিকেল রাজ্য এবং চট্টগ্রামে অবস্থিত এর রাজধানী সম্পর্কে উল্লেখ করা প্রয়োজন। সপ্তম শতাব্দী পরবর্তী সময়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে তমলুক বা তাম্রলিপ্তি বন্দর পরিত্যক্ত হওয়ায় প্রাচীন বাংলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হয়ে উঠেছিল হরিকেল। হরিকেল রাজ্যের সীমানাও এখন পর্যন্ত চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। সমতট ও হরিকেল রাজ্য নিয়েও অনেক ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। অনেকে ধারণা করেন হরিকেল সমতটের অধীন কোনো রাজ্য ছিল। আবার অনেকে হরিকেল জনপদকে স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে মনে করেন। দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের এ সমৃদ্ধ প্রাচীন জনপদ দুটি (সমতট ও হরিকেল) সম্পর্কে অনেক তথ্য উপাত্ত পাওয়া যায়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে সমসাময়িক এ দুটি জনপদের মধ্যে তাদের অবস্থানগত, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক বা যোগাযোগ থাকার কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক বা ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত তেমন একটা পাওয়া যায়নি।

এর আগে বিভিন্ন গবেষক ময়নামতি-লালমাই এলাকার আশপাশে প্রত্নতাত্ত্বিক আলামত বা নিদর্শনগুলো থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ময়নামতি-লালমাই পাহাড় শ্রেণীর চারপাশের প্লাবন সমভূমিতে পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও অনুসন্ধানের ফলে আরো অনেক প্রাচীন স্থাপত্য কাঠামোর ধ্বংসাবশেষের নমুনাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন শনাক্ত করা গেছে। এসব প্রত্নতাত্ত্বিক আলামত বা নিদর্শনগুলো কুমিল্লার লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের প্রত্নস্থানের সন্নিকটবর্তী বাইরের দিকে সমতল ভূমিতে (সমতট জনপদে) আদিমধ্য যুগের বসতি থাকার সম্ভাবনাকে তুলে ধরে। প্লাবন সমভূমিতে অবস্থিত পাঁচথুবী, মন্দুক, বড় কামতা, গুনাইগড়, শহরগ্রাম প্রভৃতি স্থনে বড় বড় এলাকাজুড়ে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এসব স্থানে বেশ কয়েকটি ঢিবির অস্তিত্ব এখন পর্যন্ত টিকে রয়েছে এবং বিভিন্ন সময়ে মাটি কাটার ফলে ষষ্ঠ-ত্রয়োদশ শতাব্দীর তাম্রলিপি, মুদ্রা, কাঠের তৈরি স্তম্ভ, পাথরের ও ধাতুর তৈরি প্রতিমাসহ দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার্য তৈজসপত্রের নমুনা পাওয়া গেছে।

কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলাধীন পাঁচথুবী নামক ইউনিয়নে প্রাথমিক অনুসন্ধানে মন্থের (মহন্তের) মুড়া, ইটাল্লার হিল মুড়া, কালিকাপুরের সমীরের বাড়িসংলগ্ন মুড়া, কালিকাপুরের মনির মিয়ার বাড়িসংলগ্ন মুড়া, কালিকাপুরের মঠের মুড়া, কালিকাপুরের বৈষ্ণব মুড়া, বসন্তপুরের বসন্ত মুড়া নামক প্রত্নস্থান শনাক্ত ও নথিভুক্ত করা হয়। অনুসন্ধানকালে সব কয়টি প্রত্নস্থান প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপত্যসংবলিত ঢিবি হিসেবে পাওয়া যায় এবং ঢিবিগুলোয় প্রাচীন স্থাপত্য কাঠামোর ধ্বংসাবশেষের নমুনা দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া ঢিবিগুলোর সারফেসে ও মাটি কাটা বা গর্ত করার ফলে তৈরি হওয়া উন্মুক্ত সেকশনে ইটের তৈরি দেয়াল, প্রচুর পরিমাণে ছোট-বড় ইটের ভগ্নাংশ ও মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ দেখতে পাওয়া যায়। 

জরিপে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একটি সামগ্রিক আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে পাঁচথুবীর মন্থের মুড়া ঢিবিকে বেছে নেয়া হয় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালনার জন্য। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে প্রাপ্ত আলামত এ অঞ্চলে ময়নামতি-লালমাই পাহাড় শ্রেণীর চারপাশের প্লাবন সমভূমিতে মানব বসতি স্থাপনের সময়কাল নির্ণয়ে সাহায্য করেছে। এসব আলামত আদিমধ্য যুগের বলে শনাক্ত করা যেতে পারে। প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এ অঞ্চলের ইতিহাস প্রায় দেড় হাজার পুরনো বলে প্রমাণ করে। এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মন্থের মুড়া প্রত্নস্থানের সময়কাল ময়নামতি-লালমাই পাহাড় শ্রেণীর বসতির সমসাময়িক।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর হতে স্থানীয় জনশ্রুতি ও প্রত্নবস্তু প্রাপ্তির গুরুত্ব বিবেচনা করে গোমতী নদীর তীরের এ প্রত্নস্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালনা করা হয়। খননকালে স্থাপত্যিক কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ ও বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক উপাদান (যেমন-স্থাপত্যিক নিদর্শন, মৃৎপাত্র, ব্রোঞ্জ ও লৌহনির্মিত নিদর্শন, পোড়ামাটির খেলনা, পোড়ামাটির ভাস্কর্য. নকশাকৃত ইট, পাথরের পাত্রের ভগ্নাংশ, পোড়ামাটির বল ও প্রভৃতি) পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে স্থাপত্যিক অবকাঠামোর ধ্বংসাবশেষ ও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নবস্তুর সন্ধান পাওয়ায় ঢিবিটিকে আদি মধ্যযুগীয় কালপর্বের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রত্নস্থান হিসেবে শনাক্ত করা হয়। খননে চারটি স্থাপত্য নির্মাণ কালপর্বের সাক্ষ্যবাহী স্থাপত্যিক কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ (ইমারতের দেয়াল, মেঝে, সংযোগ দেয়াল, কর্নার) পাওয়া যায়। এছাড়া মোট চারটি সাংস্কৃতিক কালপর্বের নমুনা পাওয়া যায়। প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু ও উন্মোচিত স্থাপত্য নিদর্শনের সঙ্গে লালমাই-ময়নামতিতে প্রাপ্ত প্রত্নস্থানগুলোর বিভিন্ন নিদর্শনের সঙ্গে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। কিছু প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে, যেগুলো খুবই স্বতন্ত্র প্রকৃতির, যা এ অঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। এছাড়া আদি মধ্যযুগ-পরবর্তী পর্বের কিছু প্রত্নবস্তুরও সন্ধান পাওয়া যায়।

এ অঞ্চলে পরিচালিত পূর্ববর্তী প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার একটি বড় সীমাবদ্ধতা ছিল ময়নামতি-লালমাই পাহাড় শ্রেণীকেন্দ্রিক হওয়া। পাশাপাশি এর আগে পরিচালিত বেশির ভাগ প্রত্নতাত্ত্বিক খননে স্তরতত্ত্বীয় বিশ্লেষণ ও কালপর্বীকরণ/যুগ বিভাজনের বিশদ পর্যালোচনা পরিলক্ষিত হয় না। ফলে পরিবেশগত প্রক্রিয়া ও মানুষের কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা, পরিবর্তন ও রূপান্তরের ঘটনা, প্রক্রিয়া ও কালানুক্রম ব্যাখ্যা করা সমস্যা হয়ে যায়। ফলে এ অঞ্চলের প্রাচীন মানব বসতি স্থাপন ও বসতির পরিবর্তনের কারণগুলো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে পাঁচথুবীর মন্থের মুড়া ঢিবিতে খননটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পাঁচথুবীর মন্থের মুড়াসহ এ প্লাবন-সমভূমিতে বিভিন্ন কালপর্বে বসতির ব্যবহার ও পুনর্ব্যবহারের ওপরে নদী খাত ও প্লাবন সমভূমির প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের প্রভাব সক্রিয় ছিল। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিবর্তনের পাশাপাশি এ প্রভাবকে এ অঞ্চলের অতীত মানববসতির পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা রূপান্তরের কারণ বলে প্রাথমিকভাবে অনুমান করা যায়। সামগ্রিকভাবে বসতি পরিকল্পনার পরিবর্তনেও ভূমিকা রেখেছিল নদী ও ভূমির বদল।

প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ভূতাত্ত্বিকভাবে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের প্রাচীন সমতট জনপদের এ ভূমি ‘নবগঠিত’ ভূমিতে বসতি স্থাপন অত্যন্ত সংগতিপূর্ণ। এ অঞ্চলের প্রচলিত ও ধরে নেয়া অতীত মানববসতি ও সক্রিয়তার ইতিহাস যাচাই ও পুনর্বিবেচনার জন্য এ ধরনের গবেষণা অত্যন্ত তাৎপর্য বহন করবে এবং ভূমির ব্যবহার ও বসতি স্থাপনের যে আন্তঃসম্পর্ককেন্দ্রিক পর্যালোচনা সেটি সমতটের আঞ্চলিক ইতিহাস রচনায় ভূমিকা রাখবে।


এ কে এম সাইফুর রহমান: আঞ্চলিক পরিচালক, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ, কুমিল্লা