ভারতের ইতিহাসের বেশ কয়েকটি শক্তিশালী সাম্রাজ্যের মধ্যে চোল রাজবংশ অন্যতম। মূলত মধ্যযুগে দক্ষিণ ভারতে রাজত্ব করেছিল এ চোলরা। তাদের শাসনে দক্ষিণ ভারত সমৃদ্ধ হয়েছিল বিভিন্নভাবে। চোল শাসনামলে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শিল্পকর্ম, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও সাহিত্য নির্মিত হয়েছিল। রাজা বিজয়ালয়, প্রথম রাজাধিরাজ, রাজেন্দ্র, বীররাজেন্দ্র, প্রথম রাজরাজ এবং দ্বিতীয় রাজেন্দ্র চোল ছিলেন এই চোল সাম্রাজ্যের অন্যতম শাসক। এরা প্রত্যেকেই নিজেদের সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে রাজ্যে উন্নত সেচ, প্রশাসন, শিক্ষা, সংস্কৃতির প্রসার, শিল্প এবং বিপুল স্থাপনা তৈরি করেছেন। এসব কাজ পরবর্তী সাম্রাজ্যগুলোর জন্য তৈরি করেছিল দৃষ্টান্ত। এমনি চোল শাসনামলের বেশকিছু স্থাপনা আজও ভারতের অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে পরিগণিত হয়। তাদের জটিল ও নিখুঁত শিল্পকর্মগুলোই চোল স্থাপনা বিশেষ করে মন্দিরগুলোকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। চোলরা ভারতের তামিলনাড়ু অঞ্চলে তাদের রাজত্ব শুরু করেছিল। এরপর এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ভূখণ্ডগুলোকেও তারা নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করেছিল। চোল স্থাপত্য ও সংস্কৃতি ইতিহাসবিদ থেকে সাধারণ পর্যটক—সবার কাছেই আকর্ষণীয় নিদর্শন হয়ে আছে। স্থাপত্যের পাশাপাশি শিল্প ও সাহিত্যেও নিজেদের ছাপ রেখে গেছেন চোল রাজারা। রাজকীয় শিল্পকর্ম, বিশেষ করে ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যে চোলরা উৎকর্ষ দেখিয়েছে। শিল্প ও স্থাপত্য চোল যুগে সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ চোখে পড়ার মতো। এ সংস্কৃতির উদ্ভব সঙ্গম সাহিত্য থেকে, যা তামিল ভাষায় লেখা। বলা হয় চোলরা ছিল ধর্মপ্রাণ। তারা শিলালিপি, খোদাই ও ব্রোঞ্জের মূর্তি সমৃদ্ধ মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। এর মধ্যে তাঞ্জোরের বৃহদীশ্বর মন্দির বিখ্যাত। মন্দিরটি রাজা রাজরাজা চোল নির্মাণ করেন। এ মন্দির তিনি দেবতা শিবকে উৎসর্গ করেছিলেন। চোল সাম্রাজ্য ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। দেব-দেবীর ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য খোদাই করা হতো এবং উৎসবের সময় পূজার জন্য মন্দিরে এগুলো স্থাপন করা হতো। এ যুগে নির্মিত মন্দিরগুলো দ্রাবিড়ীয় স্থাপত্যশৈলী অনুসরণ করে তৈরি। যেখানে মন্দিরের আকৃতি ধাপযুক্ত পিরামিডের মতো এবং কেন্দ্রে প্রবেশদ্বারসহ একটি জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। উল্লেখযোগ্য কিছু স্থাপত্য ও শিল্পকলা হলো গঙ্গাইকোন্ডা চোলাপুরম মন্দির, ঐরাবতেশ্বর মন্দির। ঐরাবতেশ্বর মন্দিরটি হিন্দু দেবতা শিবকে উৎসর্গ করে নির্মাণ করা হয়েছে। এটিতে ছয় জোড়া বিশাল মূর্তি রয়েছে, যা প্রবেশদ্বারটি রক্ষা করে এবং শিবের একটি পাথরের মূর্তি এবং মন্দিরের ভেতরে অসংখ্য ব্রোঞ্জের ভাস্কর্যও রয়েছে। নটরাজ শিব বা নটরাজের বিশ্ববিখ্যাত নৃত্যচিত্রটি চোল রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় দক্ষিণ ভারতে মধ্যযুগে সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। চোলরা ভগবান শিবের কট্টর ভক্ত ছিলেন এবং তাদের বেশির ভাগ মন্দির তাদের প্রিয় দেবতা শিবকে উৎসর্গ করেই তৈরি হয়েছিল। তাই চোল শাসনামলে বেশ কয়েকটি ঐশ্বরিক ভূমিকায় শিবকে চিত্রিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল শিব বা শিব নটরাজের নৃত্য, যা শেষ পর্যন্ত চোল শক্তির প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি শিবের ভাস্কর্যটি তেরো শতকের। বর্তমানে ব্রোঞ্জের তৈরি করা ভাস্কর্যগুলোর সঙ্গে এটিকে নয়াদিল্লির জাতীয় জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য রাখা আছে। যেভাবে ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি হতো ভাস্কর্য শিল্পচর্চা এবং শিল্পীর গুরুত্ব দুটোই ছিল চোলদের রাজত্বকালে সর্বাধিক এবং শিল্পের বিকাশও নতুন মাত্রায় পৌঁছেছিল সে সময়। এ সময়ে মন্দিরগুলোর স্থাপত্যের পাশাপাশি চোলরা ভাস্কর্য তৈরির জন্য বিশেষত ব্রোঞ্জ ব্যবহার করত। তাই এ ব্রোঞ্জ নিয়ে আলাদা করে না বললেই নয়। ব্রোঞ্জগুলো এমন একটি কৌশল ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছিল যা লস্ট-ওয়াক্স কৌশল বা সিরে পারডু নামে পরিচিত ছিল। যা নিশ্চিত করেছিল যে প্রতিটি ভাস্কর্যের ধরন হবে প্রতিটি থেকে আলাদা। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে এই ধরন উদ্ভূত বলে বিশ্বাস করা হয়। ভাস্কর্য তৈরিতে একটি মোমের মডেলে গরম ধাতু ঢেলে করা হতো। এই কৌশল চোল যুগে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। যা সে সময়ে অপূর্ব কিছু ভাস্কর্য তৈরি করেছিল। যার মধ্যে নটরাজ ভাস্কর্য অন্যতম। গঙ্গাইকোন্ডা চোলাপুরম মন্দির গঙ্গাইকোন্ডা চোলাপুরম মন্দিরটি তামিলনাড়ুর আরিয়ালুর অঞ্চলে ১০২৩ থেকে ১০৩৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজা প্রথম রাজেন্দ্র চোল নির্মাণ করেছেন। এ মন্দিরের নামকরণ করা হয়েছে গ্রামের নামানুসারে—গঙ্গাইকোন্ডা চোলাপুরম। যা প্রায় ২৫০ বছর ধরে চোল সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে কাজ করেছে। সম্পূর্ণ পাথর দিয়ে নির্মিত হয়েছে মন্দিরটি। যা চোল শিল্প ও স্থাপত্যের একটি অনন্য নিদর্শন হিসেবে রয়েছে। এটিকে রাজা রাজেন্দ্র চোলের রাজত্বকালের অন্যতম স্থাপনা এবং চোল রাজবংশের একটি জীবন্ত ইতিহাস বলে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া চোলদের যুদ্ধের অর্জন হিসেবে অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক এবং বাংলা থেকেও তারা নিয়ে এসেছিল বেশ কয়েকটি ভাস্কর্য ও মূর্তি। যেগুলো পরবর্তী সময়ে মন্দিরে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে চান্দেসা মূর্তি এবং সরস্বতী হলো মন্দিরের সবচেয়ে সুন্দর ভাস্কর্য। ঐরাবতেশ্বর মন্দির, কুম্ভকোনম ঐরাবতেশ্বর মন্দিরটি বারো শতকে চোল সম্রাট দ্বিতীয় রাজেন্দ্র দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। যেটি তাঞ্জাভুরের কুম্বাকোনামে অবস্থিত। মন্দিরটি নির্মাণ হয়েছে ইন্দ্রের সাদা হাতি বা ঐরাবতের রূপকে স্বর্গের রাজা শিবকে উৎসর্গ করে। গঙ্গাইকোন্ডা চোলাপুরম মন্দিরের মতোই ঐরাবতেশ্বর হলো চোল শাসনামলের শিল্প ও স্থাপত্যের একটি অন্যতম সৃষ্টি। যেগুলোয় রয়েছে অসংখ্য পাথরের খোদাই। বৃহদীশ্বর মন্দির বা গঙ্গাইকোন্ডা চোলাপুরম মন্দিরের তুলনায় এ মন্দিরটি ছোট হলেও এ মন্দিরের বিস্তৃত ও নিখুঁত কারুকাজের জন্য এটি অনন্য। কাঞ্জিভরম সিল্ক শাড়ি বিশ্বজুড়ে খ্যাতি লাভ করেছে দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত কাঞ্জিভরম সিল্ক শাড়ি। এ শাড়ির জনপ্রিয়তা ও চাহিদা এত বেশি হয়েছে এর উজ্জ্বল রঙ এবং এর নকশার জন্য। চোলদের সময়ে নির্মিত মন্দিরের গায়ের নকশাগুলো থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে শাড়িতে নকশা এবং বিস্তৃত জরির কাজ করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এই শাড়িটি কাঞ্চিপুরম শহরের নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে। এই শাড়ি পল্লব সাম্রাজ্য থেকে ব্রিটিশ শাসন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সাম্রাজ্যের শাসনের অধীনেও একইভাবে তৈরি হয়ে এসেছে। ঐতিহাসিকদের মতে, মহান চোল রাজা রাজরাজ সৌরাষ্ট্র থেকে তাঁতিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কাঞ্চিপুরমে এসে বসতি স্থাপন করতে এবং এই তাঁত কাজের সূচনা করতে। কিন্তু বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শাসক কৃষ্ণদেব রায়ের রাজত্বকালে এটি সমৃদ্ধ শিল্পে পরিণত হয়েছে। আগে এটি কেবল স্থানীয় কারুকাজ হিসেবেই পরিচিত ছিল। সাহিত্য কাম্বা রামায়ণম এবং পেরিয়াপুরানম ইতিহাসে বিখ্যাত দুটি চোল সাহিত্য। চোল রাজারা সাহিত্যের প্রচারে বেশ মশগুল থাকতেন। তামিল পণ্ডিত ও লেখকদের পৃষ্ঠপোষকতায় সে সময়ে বেশকিছু সাহিত্য রচনা হয়েছিল। চোলদের সময় ইতিহাসে সাহিত্যের ভক্তিমূলক সময় হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কারণ বেশির ভাগ সাহিত্যকর্মই রচনা হয়েছে ধর্ম নিয়ে। কল্লাদানার, কাম্বার, পুগালান্ধি, অট্টকুথার, সেক্কিঝার, আভাইয়ার এবং থিরুত্তাক্কাদেভারের মতো বেশকিছু মহান তামিল কবি চোল যুগকে আরো সমৃদ্ধ করেছিলেন। বেশ কয়েকটি কাজের মধ্যে সেক্কিজার রচিত পেরিয়াপুরানম এবং কাম্বার কাম্বা রামায়ণমকে সেই সময়ের দুটি শ্রেষ্ঠ কাজ বলে মনে করা হয়। পেরিয়াপুরানম হলো একটি তামিল কাব্যিক বিবরণ, যা শৈব ধর্মের ৬৩ জন কবিকে নিয়ে লেখা। কাম্বা রামায়ণম হলো রামায়ণের একটি সংস্করণ, যা বাল্মীকির রামায়ণের ওপর ভিত্তি করে রচিত। ফারিহা আজমিন: লেখক