সিল্করুট

বাংলার আর্থসামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থা

ফারিহা আজমিন

দারাসবাড়ি মসজিদ। আলোকচিত্র: এ এন এম ফরিদ আখতার, উইকিমিডিয়া কমনস

বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস পুনর্গঠনের জন্য অন্যতম নির্ভরযোগ্য আকরগ্রন্থ মিনহাজ-ই-সিরাজ জোজজানী রচিত তবকাত-ই-নাসিরী। এ গ্রন্থে বাংলা অঞ্চলে মুসলিম শাসনের প্রথম ৫০ বছরের ইতিহাসের বর্ণনা পাওয়া যায়।

সমসাময়িক মানদণ্ডে উচ্চ শিক্ষিত মিনহাজ ৩৪ বছর বয়সে ভারতে এসেছিলেন। কর্মজীবনে প্রথমে তিনি সম্রাট নাসিরুদ্দিন কুবাচার দরবারে কাজী পদে যোগদান করেছিলেন। তবে কুবাচার কাছ থেকে শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ মুলতান দখল করে নিলে মিনহাজ দিল্লিতে চলে আসেন। দিল্লিতে মিনহাজ তার মেধা বিকাশের অনুকূল পরিবেশ পেয়েছিলেন। এবং তিনি সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদের রাজত্বকালে দিল্লির কাজী থাকা অবস্থায় বিখ্যাত গ্রন্থটি রচনা করেন। ক্ষমতাশীন সুলতান নাসিরুদ্দিনকে তিনি গ্রন্থটি উৎসর্গ করেন।

তবকাত-ই-নাসিরী গ্রন্থে ১২৫৯ সাল পর্যন্ত বাংলার ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছিল। বখতিয়ার খলজির বিজয় থেকে শুরু করে ১২৫৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার ইতিহাসের একমাত্র নির্ভরযোগ্য উৎস হলো তবকাত-ই-নাসিরী। মিনহজ স্বয়ং বাংলায় এসেছেন এবং দুই বছর এখানে অবস্থান করেছেন। তাই তার গ্রন্থটিতে বাংলার বিবরণ নিছক দূর থেকে দেখা দরবারি লেখকের বর্ণনা বলা যায় না। গ্রন্থের বেশকিছু তবাকতজুড়ে (অধ্যায়) বাংলার শাসকদের বর্ণনা করেছেন। বিশেষ অংশে লখনৌতির খলজি মালিকদের বর্ণনা ছাড়াও মিনহাজ সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ ও তার বংশধরদের অধীনে বাংলার ইতিহাস আলোচনা করেছেন। তিনি সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুতমিশের সভাসদদেরও বিবরণ দিয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকে আবার বাংলার গভর্নর হিসেবেও নিয়োজিত ছিলেন। ফলে এ সময়ে বাংলার আর্থসামাজিক এবং ধর্মীয় পরিস্থিতি, অগ্রগতির বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়েছে।

১২৪২ খ্রিস্টাব্দে কারায় মালিক ইজ্জউদ্দিন তুগরল তুগান খানের সঙ্গে মিনহাজের দেখা হয়েছিল। অতঃপর তিনি বাংলার রাজধানী লখনৌতিতে নিয়ে এসেছিলেন। বাংলায় দুই বছরের মতো তিনি অবস্থান করার ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছিলেন। বাংলার তখনকার রাজধানীতে অবস্থানকালে তিনি বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয় সম্পর্কে তার বেঁচে থাকা সহযোগীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। দিল্লি সুলতানদের বাংলায় অভিযানকালে আসা দিল্লিবাসীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন এবং সে তথ্যগুলো তিনি ইতিহাস রচনার কাজে ব্যবহার করেছেন। 

বাংলায় মুসলিম সমাজের বিকাশ সম্বন্ধেও ঐতিহাসিক মিনহাজ তার তবকাত-ই-নাসিরীতে ধারণা দিয়েছেন। তার বর্ণনা থেকে জানা যায়, বখতিয়ার খলজি রাজধানী লখনৌতির সামাজিক অবকাঠামো পুনর্গঠনে মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। খলজির এ কর্মযজ্ঞে তার পরিষদরাও তাকে অনুসরণ করেছিল। পরে সুলতান ইওয়াজ খলজিও মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়া তিনি ইসলামিক বিষয়াবলির ওপর আলোচনার ব্যবস্থা করেছিলেন। এসব আলোচনা সভায় মুসলিম সংস্কৃতির পাদপীঠ মধ্য এশিয়া থেকে আসা মুসলিম তাত্ত্বিকরা ভাষণ দিতেন। এসব পণ্ডিতের মধ্যে জামালুদ্দিন গজনভীর ছেলে জালালুদ্দিন অন্যতম ছিলেন। তিনি সুলতান গিয়াস উদ্দিন ইওয়াজ খলজির সভাকক্ষে জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দিয়েছিলেন। এছাড়া মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মোহাম্মদ শিরান, আলি মর্দান ও হুসাম উদ্দিন ইওয়াজ ছিলেন সবচেয়ে বিশিষ্ট খলজি অভিজাত। বাংলায় তখন মুসলিমদের পাশাপাশি প্রচুর খ্রিস্টান, মূর্তিপূজারিও দেখা গেছে। এশিয়ার উত্তরাঞ্চলেও সে সময়ে বিপুলসংখ্যক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীও ছিল।

তবকাত-ই-নাসিরীতে মিনহাজের বর্ণনায় অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য নেই। বাংলার প্রথম দিকের মুসলিম শাসকদের মধ্যে গিয়াস উদ্দিন ইওয়াজ খলজি দিকনির্দেশনামূলক কিছু কাজ করেছিলেন। মিনহাজ সে সময়গুলোকে লিপিবদ্ধ করে লিখেছেন—

গিয়াস উদ্দিনের কোষাগার স্বর্ণ ও রুপা দিয়ে পরিপূর্ণ ছিল। তাই সুলতান গিয়াস উদ্দিন ইওয়াজ খলজি সর্বপ্রথম জনসাধারণের উপযোগী কাজে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি লখনৌতি শহর ও শহরতলিকে বন্যার পানির প্লাবন থেকে রক্ষা করার জন্য একাধিক ডাইক নির্মাণ করেছিলেন। গঙ্গার বিপরীত তীরে লখনৌতি দুটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল। পশ্চিমের অংশে অবস্থিত লখনৌতি শহর। নদীর অন্য পাশে নগরী বিস্তৃত ছিল দেবকোট পর্যন্ত। সেখানে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল, যা ছিল প্রায় ১০ দিনের পথ। এ তথ্য থেকেই তৎকালীন অর্থনৈতিক সংস্কারের অগ্রগতি সম্পর্কে জানা যায়।

মসজিদ নির্মাণ বাংলার মুসলিম সমাজ অগ্রগতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির বিজয়ের মাধ্যমে মসজিদ নির্মাণ শুরু হয়েছিল বাংলায়। মিনহাজ-ই-সিরাজ লখনৌতি শাসক গিয়াস উদ্দিন ইওয়াজ শাহকে আরো বর্ণনা দিয়েছেন। গ্রন্থটি থেকে জানা যায়, তিনি দুই দফায় দীর্ঘ ১৫ বছর বাংলাকে শাসন করেছিলেন। ১২০৮-১০ পর্যন্ত প্রথমবার এবং পুনরায় ১২১২-২৭ পর্যন্ত শাসন করেছেন।

তার শাসনকে তবকাত-ই-নাসিরীতে"গঠনমূলক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কারণ খলজি বন্যা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উদ্ভাবন করে এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম রেকর্ড করা বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছেন। তাছাড়া গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড সম্প্রসারণের মাধ্যমে প্রধান শহরগুলোকে সংযুক্ত করে বাংলায় বড় ধরনের উন্নয়ন সাধন করেছিলেন। খলজিই বাংলার প্রথম নৌবাহিনী প্রতিষ্ঠা করেছেন। লখনৌতিতে সম্পূর্ণ দুর্গ ও বাসনকোটের দুর্গ শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

গিয়াস উদ্দিন ইওয়াজ খলজির দীর্ঘ শাসনামলে বাংলায় শান্তি বজায় ছিল। তিনি পূর্ববঙ্গ, কামরূপ, ত্রিহুত ও উৎকলে অভিযান পরিচালনা করেছেন এবং রাজ্যগুলোকে একত্রিত করে তার করদ রাজ্যে পরিণত করেছিলেন। গিয়াস উদ্দিন ইওয়াজ বেশকিছু মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ধর্মতত্ত্ববিদ, পুরোহিত এবং নবীর বংশধরদের ভালো বেতন ও উপবৃত্তি প্রদান করেছিলেন। ফলে রাজ্যের জনগণ তার অনুগ্রহ ও দানশীলতা থেকে প্রচুর ধন-সম্পদ অর্জন করেছিলেন।

আলিম ও সুফিদের প্রতি সুলতান গিয়াস উদ্দিন ইওয়াজ খলজির উৎসাহ নিয়ে মিনহাজ-ই-সিরাজ নিম্নরূপ লিখেছেন:

‘আর সেই দেশে (লখনৌতি) তার ভালো কাজের অনেক চিহ্ন রয়ে গেছে। তিনি আলিম (শিক্ষিত), মাশায়েখ (ধর্ম ও আইন বিষয়ে জ্ঞানী) এবং সাইয়্যেদ (রাসূলের বংশধর) এবং অন্যান্য লোকদের মধ্যে ভাল লোকদের পেনশন দিতেন এবং অন্যান্য লোক তাঁর উদারতা থেকে প্রচুর সম্পদ পেতেন (উদ্দিন-উস-সিরাজ, ১৮৬৪ )।’

১২২৬ সালে ইলতুতমিশের বাংলা দখলের পূর্ব পর্যন্ত তিনি বাংলাকে স্বাধীনভাবে পরিচালনা করে গিয়েছেন। এরপর বাংলা চলে আসে দিল্লির মামলুক সুলতানাতের অধীনে। বাংলা শাসন এবং এ অঞ্চলের সমাজ সংস্কারের বেশকিছু কাজের বর্ণনাও উঠে এসেছে মিনহাজের গ্রন্থে। কুতুবউদ্দিন আইবেকের শুরু করা কুতুব মিনারের কাজও ইলতুতমিশের সময়ে শেষ হয়েছিল। এছাড়া তিনি আজমিরের একটি বিখ্যাত মসজিদও নির্মাণ করেছেন। সেই সঙ্গে দিল্লির সুলতানদের মধ্যে সর্বপ্রথম খাঁটি আরবি মুদ্রার প্রবর্তন করেছিলেন ইলতুতমিশ। এভাবেই সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় উন্নয়নের মধ্য দিয়ে বাংলাকে সমৃদ্ধ করে গেছেন মুসলিম শাসকরা। তুর্কি বীর ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি বাংলা জয় করে এর রাজধানী গৌড় থেকে লখনৌতিতে পরিবর্তন করা থেকেই শুরু হয়েছিল বাংলার স্বাধীন অস্তিত্বের সূচনা। এরপর ১২২৭-৮১ পর্যন্ত মোট ১৫ জন সুলতান বাংলাকে শাসন করেছেন। তারা অনেকেই এ সময় দিল্লির প্রতি মৌখিকভাবে অনুগত থাকলেও প্রায় স্বাধীনভাবেই বাংলা শাসন করে গিয়েছেন।

ফারিহা আজমিন: লেখক