সিল্করুট

পুত্রসন্তানের অভাব ও রানী সুপায়ালাতের ট্র্যাজেডি

ফারিহা আজমিন

রানী সুপায়ালাতসূত্র: মিয়ানমার হিস্ট্রিক্যাল আর্কাইভ

বার্মার শেষ রানী সুপায়ালাত জন্মগ্রহণ করেন ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ডিসেম্বর। ১৯ বছর বয়সে রাজা থিবাউ মিনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এবং সুপায়ালাতই ছিলেন বার্মার মান্দালয় প্রাসাদের শেষ রানী। আপার বার্মার (দেশটির মধ্য ও উত্তরাঞ্চল) শাসন করা সে সময়ে বেশ কঠিন ছিল। তাই বার্মার রাজা থিবাউসহ কোনবাউং শাসকরা তাদের রাজধানী শাসনের দিকে মনোনিবেশ করেন। স্থানীয় প্রধানদের দায়িত্বে ছিল সমগ্র গ্রামাঞ্চল। সে সময়ে বর্মি রাজতন্ত্রের ক্ষমতায় ক্ষয় ঘটেছিল মূলত দুটি অ্যাংলো-বার্মি যুদ্ধে (১৮২৪-২৬) এবং (১৮৫২-৫৩) পরাজয়ের ফলে। ক্রমবর্ধমান বিদ্রোহ, দস্যু দলের আক্রমণ ও আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গ হওয়ার ফলে উচ্চ বার্মার লোকজন পালিয়ে ব্রিটিশ অধিকৃত নিম্ন বার্মায় চলে যেতে থাকে। এ অস্থিতিশীল অবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল শান জাতিগোষ্ঠি প্রধানদের বিদ্রোহ। অতীতে বর্মি রাজাদের শানপ্রধানদের কন্যাদের ছোট রানী হিসেবে গ্রহণ করার প্রথা ছিল। ফলে শান রাজ্যগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় হতো। কিন্তু রানী সুপায়ালাত রাজা থিবাউকে আর কোনো স্ত্রী গ্রহণ না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বেড়েই চলেছিল। এ পরিস্থিতিতে অনেকেই মনে করতেন রাজা থিবাউ মান্দালয়ের বাইরে কেবল নামেই শাসন করছেন।

সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থ সংকট দেখা দেয়। এ পরিস্থিতিতে রাজস্ব আহরণ করা বেশ কঠিন কাজ হয়ে পড়েছিল। সমস্যাটি আরো জটিল হয়ে ওঠে, যখন চালসহ বেশকিছু অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী নিম্ন বার্মা থেকে আমদানী করার প্রয়োজন হয়। নিম্ন বার্মা ১৮২৪ সাল থেকেই ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীনে। ফলে উচ্চ বার্মা শাসন করা রাজা থিবাউর জন্য আরো বেশি কঠিন হয়ে উঠেছিল। এ জটিল পরিস্থিতিকে আরো কঠিন করে তুলেছিল টানা কয়েক বছর ধরে উচ্চ বার্মার অতি বৃষ্টিপাত। ফলে উচ্চ বার্মায় ফলন কমে যায়। ব্রিটিশ অধীনস্থ নিম্ন বার্মার ইরাবতি দ্বীপ ছিল ফলনের জন্য সুপরিচিত। ফলে আন্তর্জাতিক চাহিদা বৃদ্ধির কারণে চালের দাম বাড়তে থাকে এবং এটি সমগ্র অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি প্রভাব ফেলেছিল। কারণ আদি থেকে বর্মিদের প্রধান খাদ্য ভাত। তারা ভাতকে উন-সা বলে। রাজা থিবাউ রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে শুরু করেন। রাজকীয় একচেটিয়া ছাড়গুলো বাতিল করা হয়, নতুন কর এবং বিভিন্ন শুল্ক আরোপ করা হয়। ঋণের আশ্রয়ও নেয়া হয়েছিল। এসব উদ্যোগ বৃথা গিয়েছিল দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে। তাই রাজা থিবাউয়ের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার প্রচেষ্টা সফলতা পায়নি।

এসব সমস্যা নিয়ে রাজা থিবাউ ও রানী সুপায়ালাত উদাসীন ছিলেন না। রাজা থিবাউ চেষ্টা করেছেন কীভাবে সাম্রাজ্যকে ব্রিটিশ অধীনতার বাইরে রেখে সচ্ছল করে তোলা যায়। এ প্রসঙ্গে ড. থান্ট মিউন্ট-উ (বর্মি বিশেষজ্ঞ ও গবেষক) মনে করেন, যদিও রাজা থিবাউর শাসনামলকে তার পিতার শাসনামলের তুলনায় দুর্বল বিবেচনা করা হয়। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো পিতার শাসনামলে শুরু হওয়া সংস্কারগুলোকে থিবাউ কেবল জোরদার করেছিলেন। 

যদিও খুব দ্রুত সাম্রাজ্যের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি পরিবর্তন হচ্ছিল, তবে এটি সত্য যে রাজা থিবাউ ও রানী সুপায়ালাত—কারোর মধ্যেই তাদের পিতা মিনদনসহ পূর্বপুরুষদের মতো রাজনৈতিক দক্ষতা ও চতুরতা ছিল না। তাদের অনভিজ্ঞতা, অসচ্ছলতা ও সীমিত শিক্ষার কারণে সাম্রাজ্য শাসন জটিল হয়ে পড়েছিল। যৌবনে রাজা থিবাউ ধর্মীয় শিক্ষায় পারদর্শী ছিলেন। ড. মাইকেল ক্যারির মতে, ‘রাজা হিসেবে তার পালি শিক্ষা অধ্যয়নের আগ্রহ ছিল এবং এর বাইরে পাশ্চাত্য শিক্ষা নিয়ে তার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না ।’

এ সময়ে প্রাসাদে বেশ কঠিন সময় পার করছিলেন রাজা থিবাউ ও রানী সুপায়ালাত। কারণ নিয়ন্ত্রণহীন সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে বিভিন্ন প্রথা ও কুসংস্কার তাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রাধান্য পেয়েছিল। এগুলো শুরু হয়েছিল বেশকিছু বিস্তৃত ধর্মীয় ও পারিবারিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। যেখানে রাজাকে নেতৃত্ব দিতে হতো। রাজ্যে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের উৎসবই পালিত হতো। তবে হিন্দু ধর্মের উৎসবগুলোই বেশি জাঁকজমকভাবে পালিত হতো। বৌদ্ধ ধর্মের কোনো আচার-অনুষ্ঠান তেমন পালন করা হতো না। কারণ বৌদ্ধ ধর্ম পালনকারীরা উৎসব এড়িয়ে চলতেন তাদের ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখতে। তবে বর্মি রাজদরবার বৈদিক নানা অনুষ্ঠানকে নিজেদের সুবিধামতো সংস্কার করে নিয়েছিল।

বর্মি অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল থিয়াং ও থায়িংয়ুথ উৎসব। থিয়াং বা পানি উৎসব পালিত হতো এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে এবং এটি বার্মিজদের নববর্ষ পালনে উদযাপিত হতো। থায়িংয়ুথ বা আলোর উৎসব পালিত হতো অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে। এটি ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি পবিত্র উৎসব। এ উভয় অনুষ্ঠানের জন্য জুন-জুলাইয়ে কাউদাও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল এবং রাজা থিবাউ রানী সুপায়ালাতকে নিয়ে জমকালো পোশাকে উপস্থিত থাকতেন। সেখানে ভক্ত জনতা ভিড় করত তাদের দেখতে। বৃহৎ রাজপরিবারের প্রাত্যহিক জীবন, জন্ম, বিবাহ ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যেকোনো কিছুতেই অনুষ্ঠান সর্বদা পালন করা হতো।

রানী সুপায়ালাতের ওপর কোথাও একটি দায়বদ্ধতা ছিল সন্তান জন্ম দান নিয়ে। বিশেষ করে পুত্রসন্তান জন্ম দিতে হবে তাকে, যেন রাজা থিবাউ পুনরায় বিয়ে করতে না পারেন। রাজপ্রাসাদের ক্ষমতার লড়াই এবং রাজনীতি সবই ছিল রেষারেষিতে পূর্ণ। রাজ্যে যে মন্ত্রীরাই শাসন করতেন তাদের অধিকাংশই ব্যক্তিগত লাভের চিন্তায় বিভোর থাকতেন। রাজা ও রানী উভয়ই এসব বিষয় নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকতেন, অনেকেই মনে করতেন তাদের ব্যক্তিগত জীবন বলতে হয়তো কিছু নেই। মন্ত্রিসভার সামান্যতম অপরাধের জন্য তাদের যেকোনো একজনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতেন। কিন উন মিংয়ি যখন রাজা থিবাউর ক্ষমতায় হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেছিল, তখন তার দুই হাত কেটে ফেলা হয়েছিল। প্রাসাদের সব আচার-অনুষ্ঠান, বিনোদন, রাজনীতিতে কড়াকড়ি আনা হলেও রাজা বর্মি নিজেই এসবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এবং রাজার সম্পৃক্ততা মানেই ছিল রানী সুপায়ালাতের সম্পৃক্ততা।

বিদেশীদের নিয়ে রানীর তেমন কোনো কৌতূহল ছিল না। প্রাসাদ থেকে বাইরের জগতের সঙ্গে রানীর যোগাযোগ ছিল মান্দালয়ে বসবাসরত বহু বিদেশী ইউরোপীয়, ইউরেশীয়, আর্মেনীয়দের। এদের মধ্যে বেশকিছু কালামা অর্থাৎ বিদেশী নারী ছিলেন, যারা রানীর দাসী এবং রাজদরবারে ছোট বড় পদে কাজ করতেন। তবে এরা সবাই রাজনৈতিক ভাবনায় অজ্ঞ ছিলেন এবং তাদেরও ব্যক্তিগত স্বার্থ ছিল মন্ত্রীদের মতোই। তাই তাদের থেকে কোনো তথ্য সংগ্রহ কিংবা পরামর্শ গ্রহণ করাকে সঠিক মনে করতেন না রানী। তবে কিছু সময় তাদের দামি উপহারের বিনিময়ে নানা তথ্য জিজ্ঞাসা করতেন। বিদেশীদের ও বিদেশী কোম্পানিসহ ব্রিটিশদের বাণিজ্য রুট ইত্যাদি তথ্য তিনি এ কালামাদের মাধ্যমে জানতেন। মান্দালয়ে তখন এ কালামাদের প্রভাব ছিল অনেক বেশি। বিশেষ করে ১৮৭৯ সালে ব্রিটিশদের চলে যাওয়ার পর।

এর পরের বছরই ১৮৮০ সালে রানীর ছয় মাস বয়সী পুত্রের আকস্মিক মৃত্যু ঘটে বসন্ত রোগে। এ সময়ে রানী সুপায়ালাত দ্বিতীয়বারের মতো গর্ভবতী ছিলেন এবং তিনি প্রার্থনা করছিলেন যেন তার পুত্রসন্তান হয়। পুত্রসন্তাদের আশায় পুরো রাজ্যে প্রস্তুতিতে কোনো কমতি ছিল না। স্বর্ণের তৈরি খাট থেকে শুরু করে সবকিছুতেই ছিল স্বর্ণের ছোয়া।

১৮৮০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর রানী সুপায়ালাত কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। তবে কন্যাসন্তানকেও একইভাবে বরণ করা হয়েছিল। নানা উৎসব উদযাপনের মধ্য দিয়ে পালন করা হয়েছে কন্যাকে নিয়ে প্রতিটি অনুষ্ঠান। এ কন্যাশিশুকে ‘সিনিয়র মিস্ট্রেস অব দ্য হেড গ্রুপ অব গডেসেস’ উপাধি দেয়া হয়েছিল। যেহেতু তার শরীরে শুদ্ধ কোনবাউং বংশের রক্ত ছিল এবং পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান, তাই তিনি পরবর্তী রানী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। তবে এতকিছুর পরও কন্যাসন্তানের জন্ম রানী সুপায়ালাতের জন্য সুখকর ছিল না। তিনি পুত্রসন্তান আশা করেছিলেন কারণ না হলে থিবাউয়ের একাধিক স্ত্রী গ্রহণের সুযোগ তৈরি হতে পারে। এ ভাবনায় রানী উদ্বিগ্ন ছিলেন। সর্বোপরি তার আগের কোনবাউং রাজারা তাই করেছিলেন। পুত্রসন্তানের মৃত্যু, এরপর কন্যাসন্তাদের জন্ম, রাজ্যের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এসব কিছুর প্রভাবে রাজা থিবাউর সঙ্গে তার সম্পর্কের বা রাজপ্রাসাদের ওপর তার প্রভাব কমে যায়। বন্ধু ইয়ানাউং রাজা থিবাউকে সাম্রাজ্যের এ পরিস্থিতিতে উত্তরাধিকারী বা পুত্রসন্তানের জন্য পুনরায় বিয়ে করতে নির্দেশ দেন। অতঃপর ১৯ বছর বয়সী মি খিংগিকে রাজা বিয়ে করলেন। তবে রানী সুপায়ালাতের ভয়ে স্ত্রী মি খিংগিকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল দীর্ঘদিন। যখন ১৮৮১ সালে রানী সুপায়ালাত আবারো কন্যাসন্তান জন্ম দিয়েছিলেন, তখন থেকেই রাজা থিবাউ মি খিংগির সঙ্গে থাকা শুরু করেন। শুরু হলো রাজা থিবাউ ও রানী সুপায়ালাতের মধ্যে পারিবারিক কলহ। তবে এক পর্যায়ে এসে রানী উপলদ্ধি করেন তিনি রাজা থিবাউকে অসম্ভব ভালোবাসেন এবং মি খিংগিকে যেভাবেই হোক রাজার জীবন থেকে সরাতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন রাজার একমাত্র বন্ধু ইয়ানাউংকে সরিয়ে ফেলা। কারণ থিবাউ যদি কারো কথাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন সে হলো বন্ধু ইয়ানাউং। 

এর মধ্যেই ১৮৮২ সালের প্রথমে রাজা থিবাউ রাজ্যের চারপাশে অভিযোগ বাক্স স্থাপন করেন। রানী সুপায়ালাত নিশ্চিত ছিলেন এ বাক্সগুলো পূর্ণ হবে ইয়ানাউংকে ঘিরে অভিযোগে। তবে বানোয়াট অভিযোগ নয়। বরং সব অভিযোগই ছিল সত্য। ইয়ানাউং ছিল একজন অসৎ ব্যক্তি এবং তার বিরুদ্ধে রাজ্যের অর্থনীতি ধ্বংস ও জনগণকে নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছিল। আরো একটি পিটিশন হয়েছিল, যেখানে ৩৬ জন স্বাক্ষর করেছিলেন—রাজা থিবাউকে অপসারণের ষড়যন্ত্রে ইয়ানাউং এ কাজ করেছিলেন। থিবাউ বুঝতে পেরেছিলেন এ কঠিন পরিস্থিতেতে তার নির্ভরযোগ্য একজনই আছেন, তিনি হলেন রানী সুপায়ালাত। রাজা তার রানীর কাছে ফিরে গেলেন।

তল্লাশি চালানো হলো ইয়ানাউংয়ের পুরো বাড়ি। ইয়ানাউংয়ের বাড়ি পৌঁছে রানী সুপায়ালাত জানতে চাইলেন, কেন রানীর চেয়ে তার বেশি সম্পদ আছে। এ কথা বলার পেছনে কারণ ইয়ানাউংয়ের বাড়ি স্বর্ণ-রুপা দিয়ে পূর্ণ ছিল। ইয়ানাউং যে রাজা থিবাউর বিরুদ্ধাচরণ করছিল তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ পাওয়া যায় শোয়ার ঘরে গিয়ে। ইয়ানাউং রাজার মতো করেই স্বর্ণখচিত নকশা করে তার খাট তৈরি করেছিল। রানীর নির্দেশে ইয়ানাউংয়ের সব সম্পদ জব্দ করা হয় এবং তাকে বন্দি করা হয়েছিল। তবে থিবাউর এত কাছের বন্ধু হওয়ার ফলে তার মৃত্যুদণ্ড সহজেই অনুমোদন করতে কষ্ট হচ্ছিল।

রানী সুপায়ালাতের নির্দেশে শিও লান বো ইয়ানাউংকে জেলে নিয়ে যায়। এবং তিনি একটি জোড়া লম্বা কাঁচি দিয়ে ইয়ানাউংকে হত্যা করেন। এবং হত্যার পর ইয়ানাউংয়ের হাতে কাঁচি রেখে দেন আত্মহত্যা বোঝাতে। এ গল্প বার্মায় এখনো এতটাই বিখ্যাত যে মান্দালয়ে এ কাঁচি ইয়ানাউং কাঁচি নামেই পরিচিত।’

রানী সুপায়ালাতের মাধ্যমে রাজা জানতে পারেন তার বন্ধুর এ পরিণতির কথা। তবে এ পরিস্থিতিতে তার মনে ইয়ানাউংকে নিয়ে আর কোনো ক্ষোভ ছিল না। এর পরেই রানী মি খিংগিকে রাজপ্রাসাদ থেকে অপসারণ করা হয়। পরোক্ষণেই মি খিংগিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় রানী সুপায়ালাতের নির্দেশে। এ সময়ে মি খিংগি গর্ভবতী ছিলেন। যদিও বিষয়টি রাজা থিবাউ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।

রানী সুপায়ালাত এসব কিছুর শেষে চেয়েছিলেন তার সাম্রাজ্যে একটি স্থিতিশীল শাসন ব্যবস্থা স্থাপন হোক। রাজ্যের সব অনিয়ম তিনি কঠোর হস্তে দমন করতে চেয়েছেন। ১৮৮২ ও ৮৩ সালের মধ্যে রানী আরো দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। তবে দুর্ভাগ্যবশত দুজনই মারা যান। প্রায় ছয় বছরের কাছাকাছি সময়ে রানী পাঁচজন সন্তান জন্ম দিয়েছেন। যার মধ্যে কেবল একজন ছিল পুত্র সন্তান এবং দুজন কন্যা সন্তান বেঁচে ছিল। রানী সুপায়ালাত দুই কন্যার মৃত্যুশোক কাটিয়ে ওঠার আগেই নিজের পরিবার থেকে আবার আঘাত পেয়েছেন। তার মা সিনবিয়ুমাশিন যিনি তার কনিষ্ঠ কন্যা সুপায়াগির সঙ্গে মিংগুনের রাজপুত্রের বিবাহ দেন। মান্দালয় প্রাসাদে দেখা দেয় নতুন ষড়যন্ত্র, সিংহাসন দখল নিয়ে। রাজা মিনদনের একটি মাত্র ছেলে বেঁচে ছিল তার সঙ্গেই বিয়ে হয়েছিল সুপায়াগির। থিবাউকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। রানী সুপায়ালাত বুঝতে পেরেছিলেন রাজ্য নিয়ন্ত্রণ ও মা সিনবিয়ুমাশিনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে তাকেই এগিয়ে যেতে হবে। রানী সুপায়ালাত ভেবেছেন যদি তার ছোট বোনের সঙ্গে রাজা থিবাউর বিয়ে দিতে পারেন, তবে উত্তরাধিকারী দ্বন্দ্বের অবসান ঘটবে। রানী যখন বোন সুপায়াগিকে প্রস্তাব দেন বিনয়ের সঙ্গে সুপায়াগি তা ফিরিয়ে দিয়েছিল। তবে সুপায়াগি ছিল অত্যন্ত ভিরু প্রকৃতির মেয়ে। সে জানত তার বোন সুপায়ালাত কতটা কঠোর নিজের সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা নিয়ে। পরিশেষে তাই হয়েছিল সুপায়াগিকে তার বোনের কথা মেনে নিয়ে রাজা থিবাউকে বিয়ে করতে হয়েছিল। সব আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিয়েই বিয়ে হয়েছিল। রানী সুপায়ালাত নিজের ছোট বোনকে রাজার নিকট হাজির করেছিলেন ছোট স্ত্রী বা রানী হিসেবে। দুর্ভাগ্যবশত, এ এরপর থেকে সুপায়াগি কখনই বড় বোন সুপায়ালাতকে তার যোগ্য সম্মান বা সদাচরণ করেননি। বরং জনসম্মুখে রানীকে অপমান করতেন পরিষ্কারভাবে তাকে বোঝানোর জন্য এখন ক্ষমতা কোথায় রয়েছে।

রানী সুপায়ালাত পুরো জীবন চেষ্টা চালিয়েছেন রাজা থিবাউ যেন কখনো পুনরায় বিয়ে না করেন। তবে সর্বশেষ তিনি নিজেই থিবাউকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়েছেন কেবল মান্দালয়ে ক্ষমতা যেন রক্ষা পায়।

ফারিহা আজমিন: লেখক