সিল্করুট

দিল্লির সম্রাটকে সুরক্ষা দিত বেগমের সৈন্যরা

আহমেদ দীন রুমি

বেগম সামরু ও তার সেনাবাহিনী, ১৮০৫-২৬

একজন সুশ্রী তরুণী রণক্ষেত্রে নিজের বাহিনীকে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশনা দিচ্ছেন। সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে চলছেন প্রতিপক্ষের তরবারির সামনে। এমন দৃশ্যের নজির ইতিহাসে খুব একটা নেই। অথচ সেটারই সাক্ষী হয়েছিলেন কর্নেল জেমস স্কিনার। তিনি তখন মারাঠা সেনাবাহিনীতে কর্মরত। যোদ্ধার সাজে দেখেছেন বেগম সামরুকে। আর পরবর্তী সময়ে বিস্ময়ের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন তার সাহসিকতা ও সুশৃঙ্খল সামরিক বাহিনীর প্রসঙ্গ। বেগমের উত্থান ও প্রতিষ্ঠার পেছনে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তাদের ওপর ভর দিয়েই বহু গুণে বেড়েছে বেগমের প্রতাপ। মানুষ তাকে তুলনা করেছে শক্তিশালী ডাকিনীর সঙ্গে, যে তার শত্রুদের কখনো ছেড়ে দেয় না। 

দিল্লি সম্রাটের জায়গিরদার হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই সেনাবাহিনী রাখতেন বেগম। বাহিনীর বড় অংশটা থাকত রাজধানী সারধানায়। আরেক অংশ থাকত দিল্লিতে, মোগল রাজধানীর সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য। ১৭৮৮ সালে রোহিলাপ্রধান গোলাম কাদির দিল্লি অভিযান চালান। মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমকে অন্ধ করে দেয়ার জন্য কুখ্যাতি অর্জন করেছেন তিনি। সম্রাটের এহেন বিপদের মুহূর্তে বেগমের সেনাবাহিনী বীরত্বের সঙ্গে এগিয়ে আসে এবং কাদিরকে পরাজিত করে। গোলাম কাদির বাধ্য হন দিল্লি ত্যাগ করতে। এ ঘটনাই প্রমাণ করে বেগমের সামরিক সক্ষমতা। সারধানা আর দিল্লিতে নিযুক্ত নিয়মিত বাহিনীর বাইরে গড়ে তোলা হয়েছিল অনিয়মিত বাহিনী বা সেহবান্দি। পরবর্তী যেকোনো জরুরি অবস্থার জন্য আগাম সামরিক প্রস্তুতি হিসেবে। বাহিনীর অস্ত্রের জোগান দেয়ার জন্য সারধানায় তার দুর্গের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছিল সুরক্ষিত অস্ত্রাগার ও কামানশালা। সামরিক সদস্যরা ছিল সুশৃঙ্খল। পদাতিক, গোলন্দাজ ও অশ্বারোহীরা ছিল নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে প্রশিক্ষিত। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন আধুনিক ইউরোপীয় যোদ্ধা। বেগম যখন মৃত্যুবরণ করেন, সে সময় তার সৈন্যের নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল রেগেলিনি ও আরো এগারোজন ইউরোপীয় অফিসার। তাদের মধ্যে জন থমাসও একজন। জন থমাস বেগমের আস্থাভাজন সেনানায়ক জর্জ থমাসের পুত্র। অবশ্য ব্রিটিশদের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার পরে তাকে মাত্র একবার যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল। সেটা লর্ড কম্বারমেয়ারের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনীর ভরতপুর অবরোধের সময়। ১৮২৬ সালে বাহিনী ভরতপুর উপনীত হয়। সেনাপ্রধান মনস্থ করেন অবরোধে কোনো স্থানীয় বাহিনী ও তাদের প্রধানকে রাখা হবে না। এমন সিদ্ধান্ত আহত করে বেগমের অহমকে। তাকে অনুরোধ করা হয় মথুরায় থাকার জন্য। অথচ জবাব দেন, ‘আমি যদি ভরতপুর না যাই। সারা ভারতভূমি মনে করবে বয়সের ভারে ভীতু হয়ে গেছি।’ 

জনৈক ব্রিটিশ অফিসারের স্ত্রী ডানা ১৮১০ সালে সারধানা ভ্রমণ করেন। বেগমের সেনাবাহিনীর জন্য নিয়মিত সেনানিবাস দেখেছেন তিনি সেখানে। তার দাবি, সেনাবাহিনীর পাশাপাশি তাদের পরিবারও বসবাস করে সারধানায়। সৈন্যরা দীর্ঘকায় ও অস্ত্র চালনায় চৌকস। তাদের প্রধান অংশ রাজপুত, কারণ রাজপুতরা যুদ্ধের জন্য বিখ্যাত। গড়ে উঠেছিল আফিম খাওয়ার অভ্যাস। পরনে থাকা গাঢ় নীল ইউনিফর্ম বিস্তৃত হয়েছে তাদের পা পর্যন্ত। এছাড়া রয়েছে মাথায় পাগড়ি এবং হাতে ব্যান্ড। কামান বাহিনীও সুসজ্জিত ও সুশৃঙ্খল। তবে বেগম সামরুর সৈন্যের সংখ্যা এবং শক্তি সবসময় একরকম ছিল না। ইবারতনামা অনুসারে, ১৭৮৭ সালে যখন তিনি গোলাম কাদিরকে পদানত করেন, তখন তার সঙ্গে ছিল চার প্লাটুন প্রশিক্ষিত সৈন্য। ১৮০৫ সালে ‘‌মেমোয়ার্স অব জর্জ থমাস’ নামে জর্জ থমাসের জীবনী লেখেন উইলিয়াম ফ্রাঙ্কলিন। সেখানে তিনি দাবি করেছেন, ১৭৯৪ সালে বেগমের সেনাবাহিনীতে চার ব্যাটালিয়ন পদাতিক, ২০টি কামান এবং ৪০০টি অশ্বারোহী ছিল। ১৮০২ সালে বেগমের সেনাবাহিনীর সক্ষমতা দাঁড়ায় পাঁচ ব্যাটালিয়নে, যাদের প্রতি ব্যাটালিয়নে সৈন্য সংখ্যা ৬০০ করে। কামানের সংখ্যা ছিল ২৪টি। অশ্বারোহীর সংখ্যা ছিল ১৫০। পরবর্তী সময়ে এ সংখ্যা আরো বেড়েছে। ঠিক এক বছর পরে অর্থাৎ ১৮০৩ সালে বেগমের বাহিনীতে ছয়টি ব্যাটালিয়নে সৈন্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার। কামানের সংখ্যা তখন ৪০ এবং অশ্বারোহীর সংখ্যা ২০০। ব্রিটিশদের সঙ্গে বেগমের চুক্তি হয় ১৮০৫ সালে। চুক্তির পর সে সময়ে থাকা সেনাবাহিনীর অর্ধেকই (৩ ব্যাটালিয়ন) চলে যায় কোম্পানির নির্ধারিত স্থানে। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও পঞ্চম ব্যাটালিয়নের কাঁধে পড়ে সে দায়িত্ব। দ্বিতীয় ব্যাটালিয়নে সৈন্য সংখ্যা ছিল ৫১৬। তাদের দুই ভাগ করে এক অংশ রানিয়া এবং অন্য অংশ ভাওয়ানিতে নিযুক্ত করা হয়। তৃতীয় ব্যাটালিয়নে সৈন্য সংখ্যা ছিল ৫১৫। তাদের তিন ভাগ করে এক অংশ মিরাট, এক অংশ মুজাফফরনগর এবং বাকি অংশ সাহারানপুরে নিযুক্ত রাখা হয়। পঞ্চম ব্যাটালিয়নের সৈন্য সংখ্যা ছিল ৫১৫। একেও দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। তাদের মধ্যে প্রথম অংশ কারনাল ও দ্বিতীয় অংশ গুরগাঁওয়ে নিযুক্ত করা হয়। তিনটি ব্যাটালিয়ন মিলিয়ে সৈন্য সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৫৪৬। মিরাটের ম্যাজিস্ট্রেট এবং কালেক্টর আরএনসি হ্যামিলটন বেগমের মৃত্যুর ঠিক পর পরই তার সেনাবাহিনীর ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন। তার বর্ণনা অনুসারে, দেশীয় পদাতিক বাহিনীর ব্যাটালিয়ন ছিল ছয়টি। তাদের মধ্যে প্রথম ব্যাটালিয়নে সৈন্য সংখ্যা ৫০৭, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যাটালিয়নে সৈন্য সংখ্যা ৫০৪ করে। চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ ব্যাটালিয়নে সৈন্য সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৪৮৮, ৪৮১ ও ৪৬২। এছাড়া দেহরক্ষী হিসেবে ছিল ২৬৬ জন এবং অনিয়মিত অশ্বারোহী হিসেবে ২৪৫ জন এবং কামান বাহিনীতে ১০০৭ জন সৈন্য ছিল। অর্থাৎ সব মিলিয়ে সৈন্য সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৪৬৪ জন।

১৮০৫ সালের সেপ্টেম্বরে বেগমের দপ্তরে অভ্যন্তরীণ খবরাখবর তুলে ধরেন জিডি গুথরি। তিনি ছিলেন সাহারানপুরের কালেক্টর। দেখা যায়, ১৮০৩ সালে এক ব্যাটালিয়নের পেছনে মাসে খরচ ছিল ৬ হাজার ৫৯৫ রুপির মতো। দাক্ষিণাত্যে নিযুক্ত থাকা ব্যাটালিয়নের জন্য বাড়তি যুক্ত হতো ৪ হাজার ২৪৬ রুপি। এছাড়া বেগমের সৈনিকরা নতুন কোনো অভিযানে বের হলেও বাড়তি বেতন বরাদ্দ পেত। সেদিক থেকে সেনাবাহিনীদের জন্য প্রদেয় অর্থকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। প্রথমত, মূল বেতন, দ্বিতীয়ত, নিজস্ব অঞ্চল ছাড়া দূরে অবস্থান করলে বাড়তি যুক্ত বেতন এবং সর্বশেষ বিভিন্ন ধরনের বরাদ্দ। সেনাবাহিনীতে একজন কর্নেলের মূল বেতন ছিল ৫০০ রুপি, তবে বেগমের শাসিত অঞ্চলের বাইরে নিযুক্ত হলে ৫০০ রুপি বাড়তি পেতেন। মেজরের বেতন ৪০০ রুপি হলেও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বাড়তি যুক্ত হতো ২০০ রুপি। এভাবে ক্যাপ্টেন, লেফটেন্যান্ট ও কমান্ড্যান্টের বেতন ছিল যথাক্রমে ২৫০, ১৫০ ও ৮২ রুপি। বেগমের সঙ্গে ব্রিটিশদের চুক্তি হওয়ার পর সারধানার সেনাবাহিনীতে ব্রিটিশ প্রভাব পড়ে। যেতে হয় নানা ধরনের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। খরচের দিক থেকেও আসে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। ব্রিটিশ শাসিত প্রদেশগুলোর সুরক্ষায় নিযুক্ত থাকা বেগমের সেনাবাহিনীর তিনটি ব্যাটালিয়নের পেছনেই সে সময়কার মাসিক ব্যয় ছিল ১১ হাজার ৭৬৩ রুপি। সৈনিকদের সক্ষমতা সম্পর্কে কোম্পানির কোনো প্রকার সন্দেহ ছিল না। এজন্যই তারা সেনাবাহিনীতে সৈন্যের সংখ্যা কমানোর বিরোধিতা করেছে সবসময়। কর্তৃপক্ষ সামরিক সুযোগটিকে নিজেদের কাজে লাগাতে চাইত। বেগমের মৃত্যুর পরও সৈনিকদের নিজেদের কাজে লাগানোর জোর প্রচেষ্টা ছিল। সে সময়ে একাংশকে সারধানায় রাখা হয়। বাকিদের নিযুক্ত করা হয় ব্রিটিশদের আধিপত্য থাকা বিভিন্ন প্রদেশগুলোয়। তবে সিদ্ধান্তটি দীর্ঘ হয়নি। শিগগিরই মিরাটের ম্যাজিস্ট্রেট তাদের বেতন পরিশোধ করে দিয়ে বেগমের সেনাবাহিনীর বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। সৈনিকদের বড় একটা অংশ লাহোরের মহারাজা রঞ্জিত সিংহের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়।  

বেগমের উত্থান ও প্রতিষ্ঠার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সেনাবাহিনী। তার আয়ের বড় একটা অংশও ব্যয় হতো তাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পেছনে। সৈন্যদের এ সমারোহ তার জীবনকে আরো বেশি রোমাঞ্চকর হিসেবে পরিণত করেছে। তাই কেবল নারী শাসক হিসেবে না, সফল সমরনায়ক হিসেবেও ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন বেগম সামরু।   

আহমেদ দীন রুমি: লেখক