সিল্করুট

ব্রিটিশ ভারতে লবণ বাণিজ্যের উত্থান-পতন

আহমেদ দীন রুমি

ফোর্ট উইলিয়াম। শিল্পী: য়ান ভ্যান রাইন, ১৭৫৪

প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যার পুরোধাপুরুষ সুশ্রুত। উপমহাদেশে অন্তত চার ধরনের লবণের কথা বলেছেন তিনি। সিন্ধু ও কোহাত অঞ্চলে উৎপাদিত খনিজ লবণকে বলা হতো সৈন্ধব। সমুদ্র থেকে আহরিত লবণের নাম সামুদ্র। রাজস্থানের সম্ভর হ্রদ থেকে প্রাপ্ত লবণ পরিচিত সাকম্বরী নামে। আর লবণাক্ত মাটি থেকে আহরিত লবণের নাম পানসুজ। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কেবল লবণের ব্যবহারই বাড়েনি, বেড়েছে উৎসও। আর তাই ঔপনিবেশিক আমলে কেবল কলকাতায়ই অন্তত তেরো ধরনের লবণের নজির মেলে।

স্কটিশ উদ্ভিদতত্ত্ববিদ স্যার জর্জ ওয়াট ১৮৯৮ থেকে ১৯০৩ সাল পর্যন্ত ভারতে লবণ বাণিজ্যের চালচিত্র তুলে ধরেছেন তার ‘‌দ্য কমার্শিয়াল প্রডাক্টস অব ইন্ডিয়া’ বইয়ে। তার দাবি অনুসারে, এ সময়ে উপমহাদেশে উৎপাদিত লবণের মধ্যে সামুদ্রিক লবণই ছিল ৬১ দশমিক ৮ শতাংশ। তাছাড়া হ্রদ থেকে ২৭ শতাংশ এবং খনি থেকে ১১ দশমিক ২ শতাংশ লবণ আহরিত হতো। লবণের উৎপাদন ছিল বার্ষিক ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৫৭২ টন। অবশ্য ১৯০৫ সালে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ১২ লাখ ৯১ হাজার ১৩৭ টনে। সে সময় আমদানির পরিমাণও ছিল ঊর্ধ্বমুখী। ১৯০৩-০৪ অর্থবছরে ভারতে লবণ আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৫৫৯ টন। ১৯০৬-০৭ অর্থবছরে আমদানি বেড়ে দাঁড়ায় ৪ লাখ ৬৭ হাজার ৯৪৯ টনে। কেবল খনি থেকে লবণের বার্ষিক উৎপাদন ছিল ১ লাখ ৯ হাজার টন। তার মধ্যে আবার ৮১ শতাংশ পাওয়া যেত সল্ট রেঞ্জ থেকে। বাকি ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ কোহাত অঞ্চল থেকে এবং ৪ দশমিক ৩ শতাংশ মান্দি অঞ্চলে পাওয়া যেত। দীর্ঘদিন পর্যন্ত ভারতীয় জনগোষ্ঠীর চাহিদার ৭০ শতাংশ লবণই পাওয়া যেত স্থানীয় উৎসে। বাকি ৩০ ভাগ লবণ আমদানি করা হতো। যদিও শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের একচেটিয়া বাণিজ্য নীতির কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে শিল্পটি। 

১৮৯৪ সালে ব্রিটিশ সরকার ভারতের লবণ শিল্পের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য মোটা দাগে চারটি প্রশাসনিক অঞ্চল তৈরি করে। অঞ্চল চারটি হলো বাংলা, উত্তর ভারত, বোম্বে ও মাদ্রাজ। বাংলায় মুসলিম শাসনামলে স্থানীয় উৎপাদনকারীরা বিশেষ সুবিধা পেত কর আদায়ের ক্ষেত্রে। কিন্তু কোম্পানি ক্ষমতা নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে নিয়ন্ত্রণ। ১৭৬৫ সালে লর্ড ক্লাইভ এবং ১৭৮০ সালে ওয়ারেন হেস্টিংসের মাধ্যমে যে নীতিমালা প্রস্তুত হয়, সেটাই নানাভাবে সংস্কার হয়ে টিকে ছিল ১৮৬২ সাল পর্যন্ত। উত্তর ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আগে ছিল শিখ শাসন। মধ্যপ্রদেশ, রাজপুতনা, পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশজুড়ে তখন কোনো সুগঠিত কর ব্যবস্থাপনা ছিল না। কোম্পানি ক্ষমতায় আসলে লবণ শিল্পকে আনা হয় নর্দার্ন ইন্ডিয়া সল্ট ডিপার্টমেন্টের অধীনে। সেদিক থেকে বোম্বের উৎপাদিত লবণের অধিকাংশই ছিল স্থানীয় চাহিদা পূরণ করার জন্য। তার পরও রফতানি করা হতো মধ্য ভারত, রাজপুতনা, মধ্যপ্রদেশ, মালাবার, মাদ্রাজ ও বাংলায়। সর্বশেষ মাদ্রাজের উৎপাদিত লবণের বড় অংশই ছিল সমুদ্রকেন্দ্রিক। ১৮০৫ সালে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে সেখানকার লবণ বাণিজ্যের সুগঠিত নীতিমালা সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। ব্রিটিশ আমলে বেসরকারি উদ্যোগে লবণ উৎপাদন করার অনুমতি ছিল। তবে লবণ বিক্রি করতে হতো সরকারের কাছে। সে লবণই সরকার নতুন করে বিক্রি করত বাজারে। 

ভারতে লবণ উৎপাদনের প্রতিটি মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে সরকার। শিল্পকে কেন্দ্রীভূত করার জন্য অগ্রগতি সাধন করা হয় যোগাযোগ ব্যবস্থায়। সমন্বয় করা হয় বিভিন্ন অঞ্চলের দামকে। বাংলায় লবণ উৎপাদনের অন্যতম উৎস ছিল উপকূলীয় অঞ্চল। লবণ উৎপাদনকারীদের বলা হতো মলঙ্গি আর উৎপাদন অঞ্চলকে চর। চরগুলো বিভক্ত ছিল বিভিন্ন উৎপাদন ইউনিটে, যা পরিচিত ছিল আড়ং নামে। আড়ংগুলোও আবার ছোট ছোট খলাড়িতে বিভক্ত ছিল। তিন-চারটি লবণের খেত নিয়ে গঠিত হতো খলাড়ি। প্রতি খলাড়িতে সাতজন মলঙ্গি কাজ করত। লবণচাষী তথা মলঙ্গিরা আবার বিভক্ত ছিল দুই ভাগে—আজুরা মলঙ্গি ও ঠিকা মলঙ্গি। ব্রিটিশ শাসনের আগে বংশানুক্রমিকভাবে লবণ উৎপাদনের পেশায় নিয়োজিত চাষীরা পরিচিত হতো আজুরা মলঙ্গি হিসেবে। অন্যদিকে কোম্পানি আমলে দূরবর্তী অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে আনা চাষীদের বলা হতো ঠিকা মলঙ্গি। বাংলায় উৎপাদিত লবণের অর্ধেকের বেশি উৎপন্ন হতো মেদিনীপুরে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য পরিমাণ লবণ উৎপাদন হতো সুন্দরবন অঞ্চলে। ১৭৮০ সালে কোম্পানি বাংলার সমগ্র লবণ অঞ্চলকে ছয়টি এজেন্সিতে বিভক্ত করে। এগুলো হলো হিজলি, তমলুক, চব্বিশ পরগনা, রায়মঙ্গল, ভুলুয়া ও চট্টগ্রাম এজেন্সি। প্রতি এজেন্সিতে নিয়োগ দেয়া হয় এজেন্ট। এজেন্টদের দায়িত্ব ছিল মলঙ্গিদের লবণ উৎপাদন ও সরবরাহ তদারকি করা। পাশাপাশি নিশ্চিত করা সরবরাহকৃত লবণের গুণগত মান। লবণের দাম বেশি হওয়ায় প্রায়ই মলঙ্গিরা বেশি পরিমাণ লবণ তৈরি করে গোপনে বিক্রি করত। চুক্তির চেয়ে বেশি লবণ যেন তৈরি না হয়, সেটা নিশ্চিত করতেন এজেন্টরা। রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্বও ছিল তাদের হাতে। আর এ দায়িত্ব সহজ করার জন্য এজেন্টের অধীনে নিয়োগ দেয়া হতো দেশীয় কর্মচারী। কর্মচারীর মাধ্যমে সল্ট এজেন্টরা কোম্পানির লবণ ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করতেন। চুক্তি করতেন বিভিন্ন ঠিকাদারদের সঙ্গে। এজেন্টরা লবণ সরবরাহের জন্য ঠিকাদারকে আগাম হিসেবে নগদ অর্থ প্রদান করতেন। অন্যদিকে ঠিকাদাররা মলঙ্গিদের লবণের দাদন দিত। 

কোম্পানি একচেটিয়া বাণিজ্য প্রসারের জন্য নানা রকম নীতিমালা গ্রহণ করতে থাকে। মূলত এসব নতুন ব্যবস্থা মলঙ্গিদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। লবণের উৎপাদনে মলঙ্গিদের যা ব্যয় হতো, কোম্পানি তাদের কাছ থেকে প্রায় একই দামে লবণ কিনে নিত। ফলে মলঙ্গিদের খুব একটা লাভ হতো না। তাছাড়া আগে মলঙ্গিরা বছরে তিন মাস লবণ উৎপাদন করত। কোম্পানি আমলে তাদের ছয়-সাত মাস লবণ উৎপাদন করতে বাধ্য করা হয়। মলঙ্গিরা সাধারণত চাষী। বছরের অন্য সময় তারা চাষে মনোযোগ দিত। দীর্ঘ সময় লবণ নিয়ে ব্যস্ততা তাদের জন্য বিড়ম্বনা আকারে দেখা দেয়। এদিকে তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত কোম্পানি কর্মচারীরাও নানা উৎকোচের দাবি নিয়ে হাজির থাকত। ছিল বাড়ি বাসা সেলামি, খড়ি পোটা সেলামি, জ্বাল খুন্তি সেলামি, খুঁটি সেলামি এবং পুলিশ সেলামির মতো হরেক কিসিমের কর ও সেলামি। লবণ ওজনকারী কয়ালকে পর্যন্ত খলাড়িপ্রতি ছয় মণ লবণ দিতে হতো। এত কিছুর পরও কোম্পানি কর্মচারীরা মলঙ্গিদের শোষণ আরম্ভ করে। লবণ ওজনের দায়িত্বে নিয়োজিত কয়ালরা বেশি মাপের বাটখারা ব্যবহার করে মলঙ্গিদের প্রতারণা করে। বিভিন্ন আড়ংয়ে ভিন্ন মাপের বাটখারা ব্যবহার করায় প্রতারিত হতো মলঙ্গিরা। লবণ ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণের জন্য ১৭৭৪ সালে কোম্পানি তদন্ত কমিটি নিয়োগ দেয়। কমিটির ভাষ্য মোতাবেক, কয়ালরা বেশি মাপের বাটখারা ব্যবহার করে প্রতি মণে ১০ থেকে ১৫ সের লবণ বেশি নিত। সচেতন থাকার পরও কার্যত বিরোধিতা করতে পারত না মলঙ্গিরা। প্রতিবাদ করতে গেলে নেমে আসত নির্যাতন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে যেতে উদ্যত হলে বল প্রয়োগে ফিরিয়ে আনা হতো। ১৭৯৯ সালের ১১ এপ্রিল সল্ট কমিটির কাছে হিজলির মলঙ্গিরা অভিযোগ করে সল্ট এজেন্ট চ্যাপম্যান ও এজেন্টের নাজির রামহরি সিংয়ের বিরুদ্ধে। তাদের পাঁচদিন ধরে একটি কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখা হয় কোনো প্রকার পানাহার ছাড়াই। এমন ঘটনাগুলোই মলঙ্গিদের ঐক্যবদ্ধ করে, যা পরবর্তী সময়ে আন্দোলনে রূপ নেয়। প্রথম আন্দোলন দেখা দেয় যশোর জেলার রায়মঙ্গল এজেন্সিতে। তবে আন্দোলন রায়মঙ্গলে সীমাবদ্ধ থাকেনি। দ্রুত সময়ের মধ্যে অন্যান্য এজেন্সিতে ছড়িয়ে পড়ে একই ধারায় আন্দোলন। বিভিন্ন নেতার নেতৃত্বে এগিয়ে আসে মলঙ্গিরা। মেদিনীপুরের এজেন্ট চ্যাপম্যানের মালীর ভাই বলাই কুণ্ডু ছিলেন প্রথম সারির নেতাদের একজন। তিনি লবণ কর্মচারীদের অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে মেদিনীপুরের বীরকুল ও বলসাইয়ের মলঙ্গিদের সংগঠিত করেন। মলঙ্গিরা তার নেতৃত্বেই লবণের দাম বাড়ানোর আবেদন জানায় বোর্ড অব ট্রেডের কাছে। ১৭৯৮ সালের ৬ জানুয়ারি চব্বিশ পরগনার মুড়াগাছার মলঙ্গিরা একইভাবে দাখিল করে আবেদন। অভিযোগ, হুডাদার রামতনু দত্ত তিন বছর ধরে তাদের ওপর অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছেন। দরখাস্তে মলঙ্গিরা তাকে অপসারণ করে ভালো হুডাদার নিয়োগের দাবি জানায়। এ দাবি ক্রমে ব্যাপক আন্দোলনের রূপ লাভ করে। আন্দোলনের মুখে কোম্পানি হিজলি থেকে কোম্পানির প্রতিনিধিকে সরিয়ে অন্যজনকে স্থলাভিষিক্ত করে। এছাড়া মলঙ্গিদের ওপর কোনো রকম অত্যাচার না হওয়ার নিশ্চয়তা দেয়া হয়। গোমস্তা বা লবণ কর্মকর্তারা জোর করে দাদন দিতে গেলে প্রতিহত করা হবে। সবচেয়ে বড় কথা, জমিদার বা কালেক্টররা খলাড়ি ভাড়া ছাড়া মলঙ্গিদের কাছ থেকে কোনো অতিরিক্ত অর্থ নিতে পারবে না। 

নতুন নীতিমালা গ্রহণের ফলে সাময়িক স্বস্তি ফিরলেও লবণ শিল্প দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৮১৩ সালে সনদ আইন প্রবর্তিত হওয়ার পর ভারতের বাণিজ্য ইউরোপীয়দের সম্মুখে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে লবণ বাণিজ্যে। বিশেষ করে বাংলা অঞ্চলের লবণ শিল্প দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ১৮১৭ সালে কোম্পানি আমদানীকৃত লবণে শুল্ক আরোপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেও উদ্যোগ সফল হয়নি। কোম্পানি ব্রিটেনের লবণ উৎপাদনকারীদের দাবির মুখে বাংলায় অবাধে লবণ আমদানির সুযোগ দিতে বাধ্য হয়। ১৮৩৫ সালে কলকাতায় ব্রিটেনের চেশায়ার থেকে লবণ আমদানি শুরু হয়। স্থানীয় লবণের চেয়ে অধিক পরিশোধিত ও সস্তা হওয়ায় আমদানি করা লবণ দখল করে নেয় বাংলার বাজার। জার্মানি, এডেন, মাসকট ও জেদ্দার লবণই এখানকার অর্ধেকের বেশি চাহিদার জোগান দিতে থাকে। বিপরীতে সংকুচিত হতে থাকে স্থানীয় লবণের বাজার। কফিনের সর্বশেষ পেরেকটা আসে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম বাড়ার ঘটনায়। ক্রমবর্ধমান জ্বালানি দামের কারণে বেড়ে যায় লবণ উৎপাদন সংশ্লিষ্ট ব্যয়। চল্লিশের দশকে আফিম যুদ্ধের কারণে তীব্র রূপ নেয় সে সংকট। কোম্পানি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো লবণ ছেড়ে অন্যান্য পণ্যের দিকে মনোযোগ দিতে থাকে। বাংলা উৎপাদিত পণ্যের চেয়ে বরং কাঁচামাল সরবরাহের কেন্দ্র হিসেবেই বেশি পরিচিতি পেতে শুরু করে। মলঙ্গিরা চলে যেতে থাকে কৃষি ও কায়িক শ্রমে। প্রতিকূল এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় লবণ শিল্প আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।

আহমেদ দীন রুমি: লেখক