সিল্করুট

সাহিত্যে সমরখন্দ

আলী আমজাদ

আমিন মা’আলোফ রচিত ‘‌সমরখন্দ’

আগার আ তুর্ক-এ-শিরাজি বে দাস্ত আরাদ দেল-এ মারা

বে খাল-এ হিন্দুওয়াস বাখশাম সমরখন্দ ও বোখারা রা

পারস্যের কবি হাফিজ (আনুমানিক ১৩২৫-১৩৯০ খ্রি) তার দীওয়ানে এ দুই চরণ লিখেছিলেন। হাফিজের অনুবাদ করতে গিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, 

‘‌যদিই কান্তা শিরাজ সজ্‌নি ফেরত দেয় মোর চোরাই দিল্ ফের, 

সমরকন্দ আর বোখারায় দিই বদল তার লাল গালের তিল্‌টের!’

সহজ করে বলা যায়, ‘‌শিরাজের সেই তুর্কি কন্যা যদি আমার মন ফেরত দেয়/ তার গালের তিলের বিনিময়ে বিলিয়ে দেব সমরখন্দ আর বোখারা’। অর্থাৎ হাফিজের প্রেমিক সত্তার কাছে প্রিয়ার গালের তিলের কাছে বুখারা-সমরখন্দের জৌলুশ কোন ছার! ইসলামী সাহিত্যে হয়তো সমরখন্দের নাম আগে-পরে বহুবার এসেছে কিন্তু হাফিজের এ চরণের মতো করে কখনো আসেনি। এর এমনই শক্তি যে কাজী নজরুল ইসলামের পরও অনেকে হাফিজের চরণ দুটি অনুবাদ করে গেছেন।

বাংলা সাহিত্যে নানা সময়ে ইসলামের ইতিহাসের নানা অংশ ও ঘটনা এসেছে। সে সবের মধ্যে এসেছে শহরের নামও। কিন্তু সমরখন্দের নাম তুলনামূলক কমই এসেছে। তবে নানা সময় কবিতা বা ভ্রমণ কাহিনীতে এসেছে এ শহরের নাম। কখনো এসেছে হাফিজের কবিতার প্রসঙ্গ টেনে। যেমন পল্লীকবি জসীমউদ্‌দীন লিখেছেন সমরখন্দের কথা। তার লেখা ‘‌কবিতা’য় আছে,

‘‌মানব জীবনে সবচেয়ে যত সুন্দরতম কথা,

কবিকার তারই গড়ন গড়িয়া বিলাইছে যথাতথা।

সেকথা শুনিয়া লাভ লোকসান কি হয় না হয়,

কেহ কেহ করে সমরকন্দ তারি তরে বিনিময়।’

(কবিতা, জলের লেখন জসীমউদ্‌দীন; পলাশ প্রকাশনী)

সমরখন্দ এমন এক শহর, যা নিয়ে লিখতে বাধ্য হয়েছেন পশ্চিমা লেখকরাও। লিখেছেন ব্রিটিশ নাট্যকার ক্রিস্টোফার মারলো। লিখেছেন আমেরিকার কবি এডগার অ্যালান পো। তবে সরাসরি সমরখন্দ নয়, তারা লিখেছিলেন তৈমুরকে নিয়ে। এর মধ্যে ক্রিস্টোফার মারলো লিখেছিলেন নাটক ‘‌ট্যাম্বুরলেইন দ্য গ্রেট’। এর দুই অংশের প্রথম পর্বে ছিল তৈমুরের উত্থান ও সমরখন্দের রেনেসাঁ, দ্বিতীয় পর্বে ছিল তৈমুরের শেষ জীবনের ঘটনা।

এডগার অ্যালান পোর কবিতাটির নাম ‘‌ট্যামারলেন’। তবে সেখানে তৈমুরের পাশাপাশি সমরখন্দের প্রসঙ্গ এসেছে সরাসরি। অ্যালান পো সমরখন্দকে বলেছেন পৃথিবীর সব শহরের রানী। পো লিখেছেন,

Look ‘round thee now on Samarcand!—

Is not she queen of Earth? her pride

Above all cities? in her hand

Their destinies? in all beside

Of glory which the world hath known

Stands she not nobly and alone?

Falling—her veriest stepping-stone

Shall form the pedestal of a throne—

সাহিত্যে সমরখন্দ প্রসঙ্গ আরো অনেকবার এসেছে। হ্যারল্ড ল্যাম্ব লিখেছিলেন তৈমুরকে নিয়ে। সেখানে তৈমুরের সময়ের সমরখন্দ পাওয়া যায়। 

বাবর যে সময় সমরখন্দ দখলের বারবার চেষ্টা করছিলেন সে চিত্র এসেছে পিরিমকুল কাদিরভের লেখা ‘‌বাবর’ উপন্যাসে। সেখানে বাবরের বারবারের চেষ্টা আর শায়বানি খাঁর দুর্ধর্ষ আক্রমণের পাশাপাশি পাওয়া যায় সমরখন্দের মানুষের জীবনের কিছু চিত্র।

‘‌সমরখন্দ’ নাম দিয়ে আস্ত উপন্যাসই লিখেছেন আমিন মা’আলোফ। উপন্যাসের শুরুতেই মা’আলোফ লিখেছেন, ‘‌কখনো কখনো সমরখন্দে ধীরগতির ক্লান্ত দিনের শেষে সন্ধ্যায় শহরবাসী সময় কাটানোর জন্য রাস্তার শেষপ্রান্তে গোলমরিচের বাজারের কাছে দুটি সরাইখানায় যায়। তারা সোগদিয়ার কস্তুরির সুগন্ধে ভরা মদ পান করতে আসে না। আসে পথচারীদের যাতায়াত দেখতে।’

চেঙ্গিসের আক্রমণে শহরে দুর্দশা প্রসঙ্গে আমিন লিখেছেন, ‘‌চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে প্রথম মোঙ্গল অভিযান ছিল সন্দেহাতীতভাবে প্রাচ্যের ওপর পরিচালিত ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ। গুরুত্বপূর্ণ নগরীগুলো ধ্বংস করে মানুষকে নির্মূল করে ফেলা হয়। পিকিং, বুখারা, সমরখন্দেও একই ঘটনা ঘটে। শহরগুলোর বাসিন্দাদের সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করা হয়। বিজয়ী বাহিনীর বড় পদের অধিকারীদের হাতে তুলে দেয়া হয় নারীদের। শিল্পী ও কারিগরদের পরিণত করা হয় দাসে।’ 

সমৃদ্ধ নগরের এরূপ পরিণতি হয়েছে বারবার। মা’আলোফ বা কাদিরভ, সমরখন্দ যতবার সাহিত্যে এসেছে, সেখানে গুরুত্ব পেয়েছে এ সমৃদ্ধি ও তার ওপর করা বিজেতাদের ধ্বংসলীলা।


আলী আমজাদ: লেখক