সিল্করুট

মুর্শিদ কুলি খান

ও বাংলায় শিয়া নবাবদের শাসন

সুজন পারভেজ

মুর্শিদ কুলি খান

বাংলার রয়েছে বহু পুরনো সমৃদ্ধ ইতিহাস। ইসলামের আবির্ভাবের আগে ভারতবর্ষের সঙ্গে আরব, ইরানি ও চীনা ব্যবসায়ীদের যোগাযোগ ছিল। ইসলামের আবির্ভাবের পর তুর্কি ও ইরানিদের মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানুষ ইসলামের সঙ্গে পরিচিত হয়। বাংলায় শিয়া মতবাদ কবে থেকে জনপ্রিয় হয়েছিল সে বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তেরো শতকে বখতিয়ার খলজি কর্তৃক বাংলা বিজয়ের আগে সুফিদের মাধ্যমে বাংলায় ইসলামের এবং হয়তো শিয়াদেরও প্রবেশ ঘটে। সতেরো শতকে শাহজাহানের পুত্র শাহ মুহাম্মদ সুজা বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হন। তিনি প্রথমশিয়া ঘনিষ্ঠ হয়েও শিয়া মতবাদ প্রচার ও প্রসারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেননি। আঠারো শতকের প্রথমদিকে আওরঙ্গজেব মুর্শিদ কুলি খান নামে একজন শিয়া মুসলিমকে বাংলার প্রশাসক নিযুক্ত করেন। তিনিই বাংলায় শিয়া সংস্কৃতি ও আদর্শ জনপ্রিয় করেন। একসময় তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা করে বাংলায় নবাবি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন এবং শিয়া মতাদর্শ প্রচার ও প্রসারের জন্য বহু পদক্ষেপ নেন। তার পদক্ষেপগুলো ছিল শিক্ষামূলক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। ১৭১৭ থেকে ১৮৮০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬৩ বছরে ১৬ জন শিয়া নবাব বাংলা অঞ্চল শাসন করেন। এ সময়ে বাংলায় শিয়া জনসংখ্যা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের বিকাশ ঘটে। মুর্শিদাবাদে নবাবি যুগে বাংলার শিয়াদের অবস্থা কেমন ছিল? সে সময়ের বাংলার অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অর্জনগুলোই বা কেমন ছিল? 

আঠারো শতকে বাংলার নবাবদের আবাসস্থল মুর্শিদাবাদ পূর্ব ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিয়া সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হতো। মুর্শিদাবাদ ছিল বাংলার গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক কেন্দ্র। মুর্শিদ কুলি খানের (শাসনকাল ১৭১৭-২৭) শাসনামল থেকে মনসুর আলী খানের (জন্ম, ১৮৩৮- মৃত্যু, ১৮৮০) শাসন পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ শিয়াদের বসত কেন্দ্র ছিল। এর আগেও এ শহরে শিয়াদের আসা-যাওয়া ছিল। শিয়া শাসকরা শিয়া আলেমদের সঙ্গে নিয়ে জ্ঞানমূলক ও ধর্মীয় বিভিন্ন সভার আয়োজন করতেন। ইরানি, আরব ও তুর্কি ব্যবসায়ীরা মুর্শিদাবাদের অধিবাসী ছিলেন। ২০১১ সাল পর্যন্ত মুর্শিদাবাদে ৮০০ শিয়া পরিবারের বসবাস ছিল। এ শহরে অসংখ্য মসজিদ ও ইমামবাড়া রয়েছে। শিয়া শাসনের অবসান ঘটেছে, কিন্তু এখনো কিছু কিছু প্রাসাদ তাদের বংশধরদের অধীনে রয়েছে। এখনো মুর্শিদাবাদের সাধারণ মানুষের মধ্যে এ পরিবারগুলোর বিশেষ অবস্থান রয়েছে। তারা আগের মতোই কারবালার শহীদদের শোকানুষ্ঠানে অংশ নেন। এখানে অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গেও শিয়াদের সুসম্পর্ক বিদ্যমান।

নবাবি শাসনামলে মোট ১৬ জন শিয়া শাসক দীর্ঘ ১৬৩ বছর বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা শাসন করেন। মুর্শিদ কুলি খান ছাড়াও নবাবি আমলের আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকজন শাসক হলেন সুজাউদ্দিন মুহাম্মদ খান (১৭২৭-৩৯), সরফরাজ খান (১৭৩৯-৪০), আলিবর্দি খান (১৭৪০-১৭৫৬), মীর্জা মুহাম্মদ সিরাজউদদৌলা (১৭৫৬-৫৭); মীর জাফর আলী খান (১৭৫৭-৬০); মীর কাসিম আলী খান (১৭৬০-৬৩)।

প্রতিবেশী ও বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে নবাবদের বৈদেশিক সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক। মুর্শিদাবাদের নবাবরা অযোধ্যার বুরহানুল মুলক সা’দাত খান মীর মুহাম্মদ আমিন নিশাপুরীকে সমর্থন করেছিলেন। বুরহানুল মুলকের ভাই মীর মুহাম্মদ বাকের মুর্শিদাবাদের শাসকের কাছ থেকে মাসিক ভাতা সংগ্রহ করতেন। নিশাপুর থেকে মীর মুহাম্মদ আমিন তার ভাই ও বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বাংলায় এসেছিলেন। অতঃপর মুহাম্মদ শাহির দরবারে উচ্চপদ পাওয়ার পর লখনৌতে প্রতিষ্ঠিত হন। এর ফলে লখনৌ শিয়া সম্প্রদায়ের একটি বড় কেন্দ্রে পরিণত হয়। মুর্শিদাবাদের শিয়া নবাবরা অযোধ্যাকে সাহায্য করার পাশাপাশি আজিমাবাদকে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকভাবে সহযোগিতা করতেন। মুর্শিদাবাদের নবাবদের সাহায্যে বারো বা দ্বাদশ ইমামের অনুসারী কিছু পরিবার এখানে আসেন এবং এখনো সেখানে বসবাস করছেন।

বাংলায় শিয়া নবাবি শাসন পতনের কারণ কী? এর পেছনে অবশ্যই একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, উপনিবেশবাদী ব্রিটিশদের বাংলা দখল। দ্বিতীয়ত, প্রতিবেশী মারাঠা এবং অন্যান্য রাজার সঙ্গে সংঘর্ষ ও সহিংসতা। তৃতীয়ত, বাংলায় শিয়াদের মধ্যে বিভিন্ন জাতি, ভাষা, জাতীয়তা ও স্থানীয় অনেক উপাদানের সম্মিলন ঘটে। ফলে শাসকদের পক্ষে তাদের আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়ে।

খুবই জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানাদি আয়োজনের মাধ্যমে মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদ কুলি খান প্রথমবার বাংলায় মহররম মাসের প্রথম ১০ দিন কারবালায় ইমাম হোসাইন এবং তার অনুসারীদের শাহাদাতের প্রতি সম্মানার্থে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। অন্য ধর্মের অনুসারীরা সরকারের এ সিদ্ধান্তে বিস্মিত এবং ওই বিষয়ে কৌতূহলী হন। জমিদার, সরকারি কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষ অনুসন্ধানের পর অবগত হলেন যে নবাব মুর্শিদ কুলি খান হজরত মুহাম্মদ (দ.)-এর নাতির শাহাদাতবরণের ঘটনার স্মরণে ১০ দিনের ছুটি ঘোষণা করেছেন এবং এ ১০ দিন শোক পালন করবেন। ধীরে ধীরে মুর্শিদ কুলি খানের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় মহররম মাসের ১০ দিনের শোক পালন সবচেয়ে বড় ধর্মীয় রেওয়াজে পরিণত হয়। এ দিনগুলোয় নবাবদের সন্তুষ্টি এবং শিয়াদের খুশি করার জন্য প্রভাবশালীরা (শিয়া সম্প্রদায়ের বাইরের মানুষরাও) শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। এখনো মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারি প্রাসাদের ইমামবাড়া ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় ইমামবাড়া। শাহি প্রাসাদটি মহররম মাসে বিভিন্ন ধরনের আলোকসজ্জা দ্বারা সজ্জিত করা হতো। এখনো প্রত্যেক চান্দ্র মাসের প্রথম এবং অন্যান্য দিনে শাহি প্রাসাদে কোরআন তেলাওয়াত হয়।

বাংলার নবাবদের সঙ্গে সঙ্গে যারা শিয়া মতাবলম্বী ছিলেন তারাও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ড আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালন ও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। মুর্শিদাবাদ বাংলার শিয়া নবাবদের শাসনের কেন্দ্রভূমি ছিল। আমির, নবাব, এমনকি এ শহরের নারীরাও জ্ঞানমূলক ও সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন। এ শহর বাংলার শিক্ষা ও সাহিত্যের দোলনা এবং বাংলার জ্ঞান, সভ্যতা ও উর্দু সাহিত্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়। আঠারো থেকে উনিশ শতকে মুর্শিদাবাদের সাহিত্যচর্চা সারা ভারতবর্ষে প্রসিদ্ধ ছিল।

সামাজিকভাবেও শিয়া সম্প্রদায়ের অবস্থান ছিল বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক। আঠারো শতকে মুর্শিদাবাদের শিয়া শাসনের সঙ্গে সুন্নি মতাবলম্বীদের অনেক মিথস্ক্রিয়া ছিল। সুন্নি মতাবলম্বীরাও তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচার-ব্যবহার করত। ভারতবর্ষের ইসলামের ইতিহাসে সুন্নি ও শিয়াদের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ খুবই কঠিন কাজ। কারণ শিয়ারা অনেক ক্ষেত্রেই কিছুটা আড়ালে থাকতেন। ফলে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির সম্পর্কেও মতভেদ রয়েছে যে তারা শিয়া ছিলেন, নাকি সুন্নি। সে কালে ধর্মীয় আকিদা এমন ছিল যে শিয়া ও সুন্নি দুধ ও চিনির মতো মিলেমিশে বসবাস করত। তাদের পরস্পরকে পৃথক করা খুবই কঠিন কাজ ছিল। নবাবি শাসকদের সঙ্গে, বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সঙ্গেও মিথস্ক্রিয়া ছিল। অনেক হিন্দু বাংলায় নবাবি শিয়া শাসনামলে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন এবং কেউ কেউ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। কিছু কিছু কাজের ক্ষেত্রে নবাবরা মুসলমানদের চেয়ে তাদের ওপর বেশি নির্ভর করত।

অর্থনৈতিকভাবে নবাব আলিবর্দি খানের (১৭৪০-৫৬) শাসনামলে বাংলা ভারতের সম্পদশালী এলাকাগুলোর একটিতে পরিণত হয়। এ অঞ্চলে প্রচুর তুলা, রেশম ও মসলিন উৎপাদন হতো। শাসক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যেও খুব ভালো সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। ব্যবসায়ীরা নিয়মিত কর পরিশোধ করতেন এবং আলিবর্দি খানের অনুগত ছিলেন। সুজাউদ্দিন মুহাম্মদ খানের (১৭২৭-৩৯) শাসনামলে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য খুব সস্তা ছিল এবং প্রচুর পরিমাণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পাওয়া যেত। জমিদারদের কাছ থেকে তিনি লাখ লাখ রুপি কর সংগ্রহ করে দিল্লির সম্রাটকে পাঠাতেন। যখন জমিদারদের কাছ থেকে কর আহরণ করতেন তখন তাদের সঙ্গে কোনো রকম জোরজবরদস্তিমূলক আচরণ করতেন না। কৃষক ও জমিদারদের মাধ্যমেই কর আহরণ করতেন। এ থেকেই বোঝা যায় যে তার সময়ে বাংলায় জমিদারদের অর্থনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট ভালো ছিল।

লেখার ইতিতে আবারো নবাব মুর্শিদ কুলি খানকে উল্লেখ করছি। মূলত তিনিই ১৭১৭ সালে মুর্শিদাবাদে শিয়া শাসন প্রতিষ্ঠা করেন, যেটি মনসুর কুলি খানের (১৮৮০) শাসনামল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। মুর্শিদাবাদের নবাবদের সময়কে বাংলার শিয়া সম্প্রদায়ের ইতিহাসে ব্যতিক্রমী ও স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ দীর্ঘ ১৬৩ বছরে সাতজন শিয়া শাসক স্বাধীন ছিলেন। ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা জয় করার পরও নয়জন শিয়া নবাব পরাধীনভাবে শাসন করেন। নবাব সিরাজউদদৌলা ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় ইমামবাড়া প্রতিষ্ঠা করেন। শিয়া শাসকরা শিক্ষামূলক ও সাহিত্যিক অনুষ্ঠান আয়োজনের পাশাপাশি শিয়া আকিদা ও ফিকাহ নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। ওই সময়ের বড় বড় আলেম এবং ধর্মতত্ত্ব গবেষণায় বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা ইসলামিক বিষয়ে বাদশাহদের চেয়ে উঁচু পদমর্যাদায় ছিলেন এবং ধর্মতাত্ত্বিক নেতা হিসেবে আদেশ জারি করতেন।

পরিশেষে বলতে চাই, বাংলায় নবাবি আমলে শিয়া সম্প্রদায় আর মুর্শিদ কুলি খান ছিলেন একসূত্রে গাঁথা।


[হিস্ট্রিকাল স্টাডিজ অব দি ইসলামিক ওয়ার্ল্ড জার্নালে প্রকাশিত ইসমাইল জাহানবিন ও মুহাম্মদ জয়নাল আবেদিন রচিত ফার্সি প্রবন্ধ ‘তাশিয়ে বাঙ্গালা হিন্দ দর আসরে নওয়াবিনে মুর্শিদাবাদ’ অবলম্বনে]


সুজন পারভেজ: শিক্ষার্থী, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়