প্রচলিত ধারার
ইতিহাসে ফরায়েজি
আন্দোলনকে ধর্মীয়
সংস্কার আন্দোলন
হিসেবেই দেখা
হয়। ইসলামের
ফরজ থেকে
ফরায়েজি নামটি
এসেছিল; এ
আন্দোলনে ইসলামের
নানা রীতিনীতি
পালনের বিষয়ে
কড়াকড়ির কথা
ওঠে। কিন্তু
একে ধর্মীয়
সংস্কার আন্দোলন
না বলে
কৃষক আন্দোলন
বলা বেশি
যুক্তিযুক্ত। হাজি
শরীয়তউল্লাহর নেতৃত্বে
শুরু হওয়া
এ আন্দোলন
পূর্ববঙ্গের কৃষকদের
উদ্বুদ্ধ করেছিল।
কৃষক বললে
খেতে কাজ
করে ফসল
ফলানো মানুষের
কথা মনে
হয়। শরীয়তউল্লাহ
ও ফরায়েজি
আন্দোলনের সময়
কৃষকের পাশাপাশি
অন্যান্য পেশাজীবী
গ্রমীণ মানুষও
এ আন্দোলনে
অংশ নিয়েছিলেন।
আন্দোলনটি মূলত
শাসক ও
ধনিক (জমিদার,
কোম্পানি ও
অন্যান্য) শ্রেণীর
বিরুদ্ধে হয়েছিল।
সে হিসেবে
বলা যায়
শাসক শ্রেণীর
বিরুদ্ধে রায়তের
আন্দোলন। আর
আন্দোলনটির সূতিকাগৃহ
ছিল বৃহত্তর
ফরিদপুর। ফরায়েজি আন্দোলন
শুরু হয়েছিল
হাজি শরীয়তউল্লাহর
হাত ধরে।
বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির
ফরিদপুরের তত্কালীন
মহকুমা মাদারীপুরের
(বর্তমানে জেলা)
শ্যামাইল গ্রামে
তার জন্ম
১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে।
ছেলেবেলায় বাড়ি
থেকে পালিয়ে
তিনি কলকাতায়
যান। সেখানে
মাওলানা বাশারত
আলীর শিষ্য
হয়েছিলেন। গুরুর
সঙ্গেই তিনি
১৭৯৯ সালে
মক্কার উদ্দেশে
রওনা হন।
সেখানে দীর্ঘ
সময় তিনি
বাশারত আলীর
সাহচর্যে ধর্মসহ
অন্যান্য বিষয়ে
শিক্ষালাভ করেন।
সেকালে মুসলমানদের
মধ্যে বেশকিছু
বেশরিয়তি রীতিনীতি
প্রচলিত ছিল।
এর একটি
কারণ মুসলমানদের
একটি বড়
অংশ ছিল
ধর্মান্তরিত। সনাতন
ধর্মের আদলে
তারা নানা
রকম পীর
পূজা ও
মানত প্রভৃতি
পালন করত।
হাজি শরীয়তউল্লাহ
মক্কায় থাকাকালীন
ওয়াহাবি আন্দোলনের
অন্যতম নেতা
শাহ ওয়ালীউল্লাহ
ও সৈয়দ
আহদম বেরলভীর
সংস্পর্শে আসেন।
ওয়াহাবিদের অন্যতম
নীতি ছিল
ইসলামের মূল
বিষয়গুলোর সঙ্গে
অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত
থাকা ও
পালন করা।
মক্কায় অবস্থানকালেই
শরীয়তউল্লাহ বুঝতে
পারেন বাংলার
মুসলমান সমাজ
ধর্মের মূল
অনুশাসন থেকে
বিচ্যুত। তিনি
দেশে ফিরে
জনগণকে ধর্মের
মূল সূত্রের
সঙ্গে যুক্ত
করার চেষ্টা
করেন। তার
অন্যতম লক্ষ্য
ছিল ইসলামের
অবশ্যপালনীয় বিষয়গুলো
পালন করতে
মানুষকে উদ্বুদ্ধ
করা। ফরজের
প্রতি জোর
দেয়ার কারণে
তার আন্দোলনকে
ফরায়েজি আন্দোলন
নাম দেয়া
হয়েছিল। আন্দোলনটি মূলত
বৃহত্তর ফরিদপুর
থেকেই শুরু
হয়েছিল। এখানে
এসে শরীয়তউল্লাহ
গ্রামের মুসলমানদের
মধ্যে ধর্মের
মূল বিষয়গুলো
প্রচার করেন।
পীর পূজা,
মাজার সংস্কৃতি,
কবরে বাতি
জ্বালানো, মনসা-শীতলার
পূজা থেকে
তাদের বিরত
করার চেষ্টা
করেন। এখান
থেকে কয়েকটি
বিষয় লক্ষ
করা যায়।
বৃহত্তর ফরিদপুরে
সে সময়
মুসলমান সমাজে
ইসলামী ভাবধারার
পাশাপাশি নানা
প্রকার লৌকিক
আচার প্রচলিত
ছিল। বাংলার মূল
শাসক ছিল
তখন কোম্পানি।
ইস্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানির শাসনে
তখন রায়তের
হাঁসফাঁস অবস্থা।
পূর্ববঙ্গের অন্যান্য
অঞ্চলের মতো
ফরিদপুরেও তখন
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের
মাধ্যমে তৈরি
হয়েছে নতুন
জমিদার। তারা
রায়ত ও
তাদের সম্পর্কে
তুলনামূলক কম
ওয়াকিবহাল। জমিদারি
থেকে মুনাফা
অর্জন করাই
লক্ষ্য। এমন
সময় শরীয়তউল্লাহ
একটি ধারণা
নিয়ে আসেন
যে মুসলমানদের
উচিত নিজ
ধর্মের অনুশাসন
মেনে আত্মবিশ্বাসে
বলীয়ান হওয়া।
তিনি ওয়াহাবি
নীতি অনুসরণ
করলেও গোঁড়ামি
না করে
বলেন, বিধর্মীদের
শাসনে থাকাকালীন
ওয়াজিব বা
সুন্নতের প্রতি
অতিরিক্ত জোর
না দিয়ে
কেবল ফরজ
পালনে জোর
দেয়া উচিত। হাজি শরীয়তউল্লাহর
মূল লক্ষ্য
ছিল মুসলমানদের
দুরবস্থা থেকে
উদ্ধার করা।
সে কাজ
তিনি ধর্মীয়
অনুশাসন দিয়ে
করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু ক্রমেই
বুঝতে পারলেন
সমস্যাটা ধর্মীয়
নয় বরং
রাজনৈতিক। কিছুটা
অর্থনৈতিকও বটে।
ফলে ক্রমেই
হাজি শরীয়তউল্লাহর
আন্দোলনটি রাজনৈতিক
মোড় নেয়।
তিনি দেখতে
পান, রায়তরা
নানাভাবে অত্যাচারিত।
সে সময়
নীল চাষের
জন্য ইংরেজ
কোম্পানি জমিদারদের
চাপ দিচ্ছিল
এবং জমিদাররা
বাধ্য করেন
রায়তদের। বৃহত্তর
ফরিদপুর অঞ্চল
নদীবিধৌত। স্বাভাবিকভাবেই
এখানকার অন্যতম
প্রধান ফসল
ধান। কিন্তু
দেখা গেল
নীল চাষের
কারণে ধান
চাষ করা
গেল বন্ধ
হয়ে। কিংবা
যেখানে দুই
মৌসুমে ফসল
ফলানো হতো
সেখানে এক
মৌসুমের বেশি
ফসল ফলানো
সম্ভব হতো
না। হাজি
শরীয়তউল্লাহ এ
বিষয়গুলো লক্ষ
করেন। তার
আন্দোলনে প্রাথমিক
পর্যায়ে ধর্ম
প্রধান বিষয়
থাকলেও স্বাভাবিকভাবেই
রায়তের এ
সমস্যা ও
সংকটগুলো তাকে
ভাবাতে শুরু
করে। ক্রমেই
আন্দোলনটি রায়ত
আন্দোলনে পরিণত
হয়। কৃষক
ও রায়তরা
সংঘবদ্ধ হতে
শুরু করেন।
তারা জমিদার,
নীলকরদের বিরুদ্ধে
তাদের দাবিদাওয়া
জানাতে শুরু
করলে শরীয়তউল্লাহসহ
পুরো আন্দোলন
ব্রিটিশদের রোষের
শিকার হয়। এর কারণ
ছিল। শরীয়তউল্লাহ
যখন তার
আন্দোলন শুরু
করেন, বাংলা
তখন এক
ধরনের পরিবর্তনের
মধ্য দিয়ে
যাচ্ছিল। বিলাতের
শিল্প বিপ্লব,
বিশেষত বস্ত্র
শিল্পে দ্রুত
পরিবর্তন বাংলার
রায়তদের প্রভাবিত
করে। নীল
চাষ যেমন
কৃষকদের খোঁড়া
করে দিচ্ছিল
তেমনি বিলাতের
সুতা ও
বস্ত্র এখানকার
তন্তুবায়দের মাথাব্যথার
কারণ হয়ে
ওঠে। ফলে
এমন এক
সময় আসে
যখন তারা
ন্যূনতম মজুরিতে
কাজ করতে
বাধ্য হন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর
ত্রিশের দশকে
অর্থনৈতিক মন্দার
কারণে পণ্যের
মূল্য আরো
কমতে শুরু
করে। এ
অবস্থায় কৃষক
ও অন্যান্য
পেশাজীবীর জীবনধারণ
ক্রমেই কঠিন
হয়ে ওঠে।
এর মধ্যে
ইংরেজ কোম্পানির
কোষাগারে অর্থের
প্রয়োজন বাড়তে
থাকে। খাজনা
ও অন্যান্য
পাওনা দেয়ার
নিমিত্তে জমিদাররা
প্রজাদের ওপর
নানা করের
বোঝা আরোপ
করতে থাকে।
এর মধ্যে
কালী পূজা,
দুর্গা পূজার
জন্য মুসলমানদের
কাছ থেকে
কর নেয়া
হতো। শরীয়তউল্লাহ
এর বিরোধিতা
করেন। অন্যদিকে
দাদন পদ্ধতিতে
নীল চাষের
কারণে কৃষকের
মুনাফা তো
থাকতই না,
অনেক সময়
আর্থিক ক্ষতির
পরিমাণ ছিল
অনেক বেশি।
ফরায়েজি আন্দোলন
কেবল ফরিদপুরে
সীমাবদ্ধ ছিল
না। ছড়িয়ে
পড়েছিল এর
আশপাশে অঞ্চলে।
ঢাকা, নোয়াখালী,
বাকেরগঞ্জ, ত্রিপুরা
(কুমিল্লা) ও
চট্টগ্রামে এ
আন্দোলন বেগবান
হয়। আর
ফরিদপুর বলতে
বর্তমান হিসাবে
ফরিদপুর, মাদারীপুর,
রাজবাড়ী, শরীয়তপুর
এর অন্তর্ভুক্ত
ছিল। শরীয়তউল্লাহর
জনপ্রিয়তা এত
বেড়ে যায়
যে ময়মনসিংহ
পর্যন্ত তার
‘শাগরেদ’
তৈরি হয়।
নানা সূত্র
থেকে জানা
যায়, অন্তত
১২ হাজার
তাঁতি তার
অনুসারী হয়েছিল।
শরীয়তউল্লাহর সংস্কারে
বলা হয়েছিল
কলু, জোলা,
তাঁতি কেউই
নিচু জাত
নয়। ইসলামের
মূল সূত্রে
‘সবাই
সমান’ এ
ধারার বাইরেও
পেশাজীবীদের সম্মান
দেয়ার ক্ষেত্রে
শরীয়তউল্লাহকে সময়ের
তুলনায় আধুনিক
বলতে হয়।
অবশ্য সে
কারণে তিনি
যেমন কোম্পানি
ও হিন্দু
জমিদারদের রোষের
শিকার হয়েছিলেন,
তেমনি অনেক
মুসলমান জমিদারও
তার বিরুদ্ধে
কাজ করেছিলেন।
এর মধ্যে
ঢাকার জমিদাররা
অন্যতম। তারা
পুলিশের সহায়তায়
১৮৩১ সাল
নাগাদ রামনগর
বা নয়াবাড়িতে
শরীয়তউল্লাহর বিরুদ্ধে
প্রতিরোধ গড়ে
তোলার জন্য
কেন্দ্র তৈরি
করেন। প্রতিষ্ঠাতা হাজি
শরীয়তউল্লাহ হলেও
এ আন্দোলনকে
ধারণ করে
বেগবান করেন
তার সুযোগ্য
পুত্র দুদু
মিয়া। মুহসিনউদ্দীন
নামে শরীয়তউল্লাহর
পুত্র এ
নামেই অধিক
পরিচিত। পিতার
মৃত্যুর পর
তিনি ১৮৪০
সালে ফরায়েজি
আন্দোলনের হাল
ধরেন। শরীয়তউল্লাহর
সময়ের তুলনায়
দুদু মিয়ার
সময়টি ছিল
ভিন্ন। এ
সময় কৃষক
ও রায়তরা
আরো নিগৃহীত
হতে শুরু
করেন। দুদু
মিয়ার অনুসারী
তাই আরো
বাড়তে থাকে
এবং তিনি
বুঝতে পারেন
আন্দোলনে প্রয়োজনে
সহিংস হতে
হবে। প্রথমে
কেবল প্রতিরোধের
মধ্যেই থাকতে
চেয়েছিলেন। এরপর
রায়তের দুরবস্থা
দেখে তার
সময়েই জমির
দাবি তোলা
হয়। ফরায়েজি
আন্দোলনের এ
পর্যায়ে ‘লাঙল
যার, জমি
তার’ স্লোগানের
সূচনা। কোম্পানি ও
জমিদাররা এবার
ভীত হয়ে
পড়েন। বেঙ্গল
পুলিশের ধারণা
অনুসারে দুদু
মিয়ার অন্তত
৮০ হাজার
অনুসারী ছিল।
অন্যদিকে বেঙ্গল হুরকারু পত্রিকার
সম্পাদক আলেকজান্ডার
ফোর্বসের ধারণা
সংখ্যাটি তিন
লাখের কাছাকাছি।
এতে অবাক
হওয়ার কিছু
নেই। দুদু
মিয়ার প্রতাপ
নিয়ে একটি
ঘটনার উল্লেখ
করা যায়।
এক নীলকরকে
হত্যার অভিযোগে
ফরিদপুর কোর্টে
দুুদুকে বিচারের
জন্য হাজির
করা হয়েছিল।
এ সময়
দুদু মিয়াকে
নিরাপত্তা দেয়ার
জন্য আশপাশের
নদীতে শত
শত নৌকা
নিয়ে তার
অনুসারীরা অপেক্ষা
করছিল। ইন্ডিগো
কমিশনে এক
সাক্ষী জানিয়েছেন,
দুদু মিয়াকে
মোকাবেলা করার
জন্য ঢাকায়
একটি পূর্ণ
রেজিমেন্টকে সর্বদা
প্রস্তুত রাখা
হতো। কোম্পানির
ভয় ছিল
যে দুদু
মিয়া চাইলে
যেকোনো সময়
বৃহত্তর ফরিদপুরে
নিজস্ব শাসন
শুরু করতে
পারেন। সিপাহি
বিদ্রোহের সময়
দুদু মিয়া
বলেছিলেন যে
তিনি নির্দেশ
দেয়ামাত্র ৫০
হাজার মানুষ
যেকোনো দিকে
ছুটে যেতে
প্রস্তুত। ঔপনিবেশিকতা ও
জমিদারদের বিরুদ্ধে
যে আন্দোলনগুলো
রায়তের পক্ষে
কথা বলেছিল,
ফরায়েজি আন্দোলন
তার মধ্যে
অন্যতম। একে
অনেকে স্বরাজের
জন্য প্রথম
আন্দোলন বলেন।
শরীয়তউল্লাহ বা
দুদু মিয়া
সরাসরি স্বরাজের
কথা না
বললেও রায়তের
স্বার্থের কথা
তারা বলেছেন।
পূর্ববঙ্গের বৃহত্তর
ফরিদপুর অঞ্চলের
এ আন্দোলন
সাধারণ মানুষকে
সচেতন করে
তুলেছিল এতে
সন্দেহ নেই।
মাহমুদুর রহমান: লেখক