সিল্করুট

অঞ্চলভেদে শাড়ি পরার ধরন

ফারিহা আজমিন

গ্যালাক্সি অব মিউজিশিয়ানস ১৮৮৯, শিল্পী: রাজা রবি বর্মা ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় পোশাক হিসেবে নারীর পছন্দের তালিকায় রয়েছে শাড়ি। অঞ্চলভেদে দেখা যায় বাহারি শাড়ি। পাঁচ-নয় মিটার এ টুকরো কাপড় পরিধানেও রয়েছে নানা ধরন। স্থানভেদে বিভিন্ন মানের, বিভিন্ন ডিজাইনের শাড়ি তৈরি হয়। বাংলাদেশের তৈরি শাড়ির মধ্যে আছে জামদানি, কাতান, রাজশাহী সিল্ক, মণিপুরী শাড়ি, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি, বালুচরি শাড়ি, পাবনার শাড়ি, ঢাকাই জামদানি শাড়ি ইত্যাদি। সময় ও স্থানভেদে এ শাড়ি পরিধানের ধরনও ছিল ভিন্ন। বাংলার বাইরে দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর কাঞ্জিভরম সিল্ক, বেনারসের বেনারসি সিল্ক, কেরালার কাসাভু শাড়ি, মহারাষ্ট্রের পৈঠানি সিল্ক, গুজরাটের বাঁধনী ও পাটলা শাড়ি, আসামের মুগা সিল্ক, রাজস্থানের কালামকার ইত্যাদি বিখ্যাত।

পোশাক সবসময় নির্দিষ্ট অঞ্চলের সংস্কৃতির কথা বলে। তেমনি পোশাক পরিধানের ধরনও তার সংস্কৃতির পরিচায়ক। অঞ্চল, সময় ও উৎসবের ভিত্তিতে পালাবদল করে নারীর শাড়ি পরার রয়েছে নানা ধরন। শাড়ি পরার ক্ষেত্রে পেটিকোট ও ব্লাউজের ব্যবহার খুব বেশি সময়ের নয়। আগে টুকরো কাপড় হিসেবে কেবল শাড়িই পরা হতো। ভারতের অনার্যরা সেলাই জানত না বলেই তারা নারী, পুরুষ সবাই অখণ্ড বস্ত্র পরিধান করত, যা কালক্রমে পুরুষের ধুতি ও শাড়ি নারীর পোশাক হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় মনে করেন, আদিমকালে পূর্ব-দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাই করা কাপড় পরার প্রচলন ছিল না। এ অখণ্ড বস্ত্রটি পুরুষের পরনে থাকলে হতো ধুতি এবং নারীর পরনে থাকলে শাড়ি। তবে সে সময় উচ্চবংশের নারীরাই কেবল শাড়ির সঙ্গে পালা-পার্বণে ওড়নাজাতীয় কাপড়ে নিজেকে ঢেকে নিতেন। পোশাকের মাপের সঙ্গে সামাজিক মর্যাদার একটি বিষয় সে সময় পরিলক্ষিত হয়েছে। ক্ষত্রিয়রা গোড়ালি পর্যন্ত এবং শূদ্ররা হাঁটু পর্যন্ত কাপড় পরত। সম্ভবত বিভিন্ন গোত্রের নারীরা নিজস্ব প্রয়োজন অনুসারে শাড়ির কাঠামো পরিবর্তন করেছে। 

মনে করা হয় সেমিজের দ্বিখণ্ডিত রূপই ব্লাউজ ও পেটিকোট। সেমিজের ওপর শাড়িকে গিট দিয়ে প্রথমে ডানে পরে বাঁয়ে লম্বা ভাঁজ দিয়ে জড়িয়ে টেনে এনে ডান হাতের নিচ দিয়ে আলগা করে বাম কাঁধে আঁচলের সামান্য অংশ রাখার যে ধরন, তার নাম ‘এক প্যাঁচ’। এ ধরন চালু ছিল সুদীর্ঘকাল। ‘এক প্যাঁচ’ ধরনের শাড়ি পরার অনেক সুবিধা ছিল একদিকে পর্দা রক্ষা, অন্যদিকে সংসারের কাজের সুবিধা। তাই বাঙাল বাড়ির নারী মানেই যেন এক প্যাঁচে শাড়ি। প্রয়োজনে ঢিলা আঁচল কোমরে জড়িয়ে নেয়া গেছে, সন্তান লালনে-পালনে ও শীত-বর্ষায় লম্বা আঁচল মায়ের কাজে লেগেছে। পরবর্তীকালে এ ধরনও পরিবর্তন হয়েছে। পরার ধরনে এসেছে ‘কুঁচি পদ্ধতি’। এ পদ্ধতিতে শাড়িকে কোমরে পেঁচিয়ে সামনের অংশে কুঁচি পেটের ওপর দিয়ে লতিয়ে বুক ঘিরে ছন্দোময় ভঙ্গিতে ওপরে তুলে বাম কাঁধ ছুঁয়ে আঁচলটিকে পিঠে ছেড়ে দেয়া হয়। এভাবে পরা শাড়ির আঁচল দ্বারা অবগুণ্ঠনের কাজও হয়। একালের অবগুণ্ঠনের স্টাইল আগের মতো নয়। অবগুণ্ঠন মানে আর মুড়ি ঘোমটা নয়, তা আব্রুর মাধ্যমে সৌন্দর্য পরিস্ফুট করার পন্থা। এখন অবগুণ্ঠন মানে মাথার তালুর কাছে আলতো করে আঁচল তুলে দেয়া। বাংলায় শাড়ির ‘কুঁচি’র প্রাথমিক চিন্তা এসেছে অবাঙালিদের কাছ থেকে। ঘাগরার ঘেরাও কুঁচির প্রভাবই লক্ষ করা যায় শাড়ির কুঁচিতে। এ ধরন এসেছে দক্ষিণ ভারতের তালিড়নাড়ু থেকে। সেখানকার কাঞ্জিভরম শাড়ির কুঁচি আরো সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্যই পেটিকোটের বদলে ঘাগরার ব্যবহার হয়। এছাড়া শাড়িকে পরিধেয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন এমন অবাঙালিরাই প্রথমে কুঁচি পদ্ধতি চালু করেন।

বাংলায় নারীর প্রাত্যহিক ব্যবহার্য শাড়ির তালিকায় সর্বদাই তাঁতের শাড়ি ছিল। প্রাচীনকাল থেকেই বয়ন শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়ি। টাঙ্গাইলের বাজিতপুরের তাঁতিরা এ রকম সূচি শিল্প শোভিত উন্নত মানের শাড়ি তৈরি করেন। একসময় স্থানীয় জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হতো টাঙ্গাইল শাড়ি। ঐতিহ্যগতভাবে শত বছর ধরে বাঙালি নারীরা চিকন সুতার শাড়ি পরতে পছন্দ করেন। আশির দশকে শাড়ি আটপৌর করেই পরতেন নারীরা। পাতলা নরম শাড়ি ব্যবহারে ঘরের কাজও সহজেই করা যায়। তবে একটা সময় পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে নারীদের ব্লাউজের ব্যবহার ছাড়াই শাড়ি পরতে দেখা গেছে। কেবল উচ্চবংশীয় নারীদের শাড়ির ওপরে ওড়না পরতে দেখা যেত বলে জানা যায়। 

এছাড়া বাঙালি উৎসবে শাড়ি ও শাড়ি পরার ধরনেরও পরিবর্তন এসেছে। যেমন বিয়ে, বৌভাত, মেহেদি অনুষ্ঠান ও গায়ে হলুদসহ নানা অনুষ্ঠানে দেখা যায় নানা শাড়ি এবং শাড়ি পরনেরও ভিন্ন ধরন। জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে দেখা যায় বেনারসি, কাতান বা কাঞ্জিভরম শাড়ির ব্যবহার। এক্ষেত্রে কুঁচি দিয়ে পেছনে আঁচল ফেলেই শাড়ি পরতে দেখা যায় বেশি। আবার গায়ে হলুদের মতো আরো কিছু নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন বাংলা নববর্ষেও নারীরা আটপৌর করেই শাড়ি পরেন। শাড়ি পরার ৮০টিরও বেশি ধরন আছে বলে জানা যায়। টেক্সটাইল পণ্ডিত ঋতু কাপুর চিশতি তার বই ‘সারিস: ট্র্যাডিশন অ্যান্ড বিয়ন্ড’ গ্রন্থে শাড়ি পরার ১৪টি ধরন নথিভুক্ত করেছেন। যেখানে তিনি ভারতের আঞ্চলিক শাড়ি পরার ধরনগুলোকে নথিভুক্ত করেছেন। যেমন দাক্ষিণাত্যের অঞ্চলে নিভি স্টাইলে শাড়ি পরিধান করা হয়। যেখানে শাড়ির কুঁচিগুলো পায়ের মধ্য দিয়ে নিয়ে পেছনে পেটিকোটের সঙ্গে গুঁজে দেয়া হয়। তবে এভাবে পা ঢেকে শাড়ি পরলেও স্বাছন্দ্যেই চলাচল করা যায়। বিহার, উত্তর প্রদেশ, গুজরাট ও রাজস্থানে যেমন শাড়ির বুনন কৌশলের মধ্যে রয়েছে নানা ভিন্নতা, তেমনি রয়েছে শাড়ি পরার ধরনেও। যেমন ভারতের এ অঞ্চলগুলোয় নিভি স্টাইলে নয় সিধা আঁচল স্টাইলে শাড়ি পরেন নারীরা। শাড়িতে কুঁচি দিয়ে আঁচল বা পাল্লুর সামনের অংশে ঢিলেঢালা প্রান্ত থাকে বলেই এ শৈলী সিধা নামে পরিচিত। নিভি স্টাইলের অনুরূপ কুঁচিগুলো টেনে নেয়ার পর আলগা প্রান্তটি পেছন থেকে টেনে নেয়া হয়, ডান কাঁধের ওপর দিয়ে আঁচল নিয়ে সুরক্ষিত করার জন্য পেছনে টেনে নেয়া হয়। এ স্টাইলে ভারতের পাঞ্জাবি ও সিন্ধি হিন্দুরা শাড়ি পরেন। 

বাংলা ও ওড়িশা অঞ্চলে শাড়ি পরার ধরন ঘড়ির কাটার বিপরীত দিকে শাড়ি মোড়ানো হয় এবং শাড়ির আঁচল এমনভাবে রাখা হয় যেন মাথায়ও কাপড় দেয়া যায়। ১৮৭০ সালে সমাজ সংস্কারক জ্ঞানদানন্দিনী দেবী মুম্বাই সফরের পর বাংলায় ব্রাহ্মিকা শাড়ির প্রচলন করেছিলেন। উনিশ শতকের চল্লিশের দশক থেকে বিশ শতক পর্যন্ত সময়কে বলা হয় ‘ভিক্টোরিয়ান যুগ’। এ যুগে ফ্যাশনের মূল কথাই ছিল কাপড়ে সারা শরীর ঢাকা থাকতে হবে। এভাবে বিভিন্ন সময়ে ভ্রমণ, সফর, যুদ্ধ, বাংলা জয়, এমন সব ঘটনার মধ্য দিয়েই সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ঘটেছে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে। যেমন নেপালের ঐতিহ্যবাহী শাড়ি নেওয়ারি শাড়ি। এ শাড়ি পরার ধরন আমাদের এ অঞ্চলের চেয়ে বেশ ভিন্ন। এটাকে যদিও নিভি ড্রেপ স্টাইল বলা হয়। তবে শাড়িটিকে ভাঁজ করে নিভি শাড়ির মতো পরে আঁচল বুকে না জুড়ে বরং কোমরের চারপাশে বেঁধে দেয়া হয়, যেন এটি কোমর থেকে নিচে নেমে যায়। শাড়িগুলো মোটা ব্লাউজের সঙ্গে পরা হয় এবং সামনের দিকে কয়েকবার বাঁধা থাকে। ভোজপুরি ও আওয়াধি ভাষী সম্প্রদায় গুজরাটি কাপড়ের মতো শাড়িও সিধা পাল্লু স্টাইলে পরিধান করে। এছাড়া নিভি ড্রেপ স্টাইল নেপালে শাহ রাজবংশ ও রানাদের দ্বারা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। আবার ঘাগরা বা লেহেঙ্গা স্টাইলে শাড়ি পরা জনপ্রিয় হয়েছে ভারতের রাজস্থান থেকে। বলা হয় মধ্যপ্রদেশ, বিহার, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ এমনকি পাকিস্তানের সিন্ধু ও পাঞ্জাবেও এভাবেই লেহেঙ্গার মতো শাড়িকে পেঁচিয়ে নিয়ে সামনের আঁচলের অংশ বাম দিক থেকে এনে ব্লাউজের ওপর রাখা হয়। এছাড়া প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর ধরে পরিহিত এ বস্ত্র প্রতিনিয়তই নানা ধারায়, নানা ধরনে পরা হচ্ছে। ফ্যাশন ও স্টাইল সচেতন নারীরা নিজেকে আরো গুছিয়ে পরিপাটি হয়ে শাড়ি পরতেই ভালোবাসেন। একুশ শতকে এসে উনিশ শতকের নানা স্টাইলই যেন আবার ফিরে আসছে। বর্তমান ফ্যাশনের পাশাপাশি শাড়ি পরার ধরন, ব্লাউজের কাট সব মিলিয়ে সাজ পোশাকে উনিশ শতকের ছোঁয়াও রয়েছে।

ফারিহা আজমিন: লেখক