সিল্করুট

চৈনিক পরিব্রাজক ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সমতট-হরিকেলের সংযোগ সূত্র

এসএম রশিদ

অষ্টম শতাব্দীর গুহাচিত্রে হিউয়েন সাঙের সফর ছবি: স্ক্রল ডট ইন

প্রাচীন বাংলার হরিকেল জনপদ আরাকানের সঙ্গে স্থলপথে প্রতিবেশীর মতো। একই সঙ্গে বঙ্গোপসাগর দিয়েও জলপথে আছে যোগাযোগ। পূর্ববঙ্গের এ দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছিল স্থল ও জল যোগাযোগ। পুরো দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো স্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বহু মাধ্যমে যোগাযোগে এমন সুবিধা পায় না।

বাংলা ও বিহারকে বলা হয় দক্ষিণ এশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মের শেষ আশ্রয়স্থল। দশম শতাব্দী এবং তার অব্যবহিত পরের সময়ে তেমন অবস্থা দেখা যায়। তখন উপমহাদেশের অন্য অঞ্চলগুলোয় বৌদ্ধ ধর্মের ক্ষয় শুরু হয়ে গেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের বড় একটি সূত্র ছিল বৌদ্ধ ধর্ম। ৬০০-১৩০০ সালের মধ্যে নালন্দা, বিক্রমশীলা, সোমপুর, ময়নামতিতে অসাধারণ সব বিহার তৈরি ও বিকশিত হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশের সম্পর্কটি আলোচনা করতে গিয়ে দীর্ঘকাল ধরে গুরুত্ব পেয়েছে বিহার, উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা। কিন্তু এখন অনেক গবেষক আমাদের সমতট ও হরিকেল অঞ্চলের দিকে নজর দিতে বলছেন।

ইতিহাসবিদ সুচন্দ্রা ঘোষ এ নতুন গতিপথকে অলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ইতিহাসতত্ত্বের এ বাঁকবদল নিয়ে আলোচনার শুরুতে স্পষ্টভাবে বলা প্রয়োজন যে বাংলার সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ ধর্মীয় সংযোগ ‘বৃহত্তর ভারতীয়’ কিংবা ‘ইন্ডিয়ানাইজেশন’ মডেলের ওপর ভিত্তি করে তৈরি নয়। বঙ্গোপসাগর উপকূলের এ পূর্বপ্রান্তের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ধর্ম কিংবা বাণিজ্য কিংবা উভয়কে ভিত্তি করে জলপথ ও স্থলপথের সুবিধা ব্যবহার করে নির্মিত।

বাংলা তথা দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গ খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর পর থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ধর্মীয় ও বাণিজ্যিক সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে বৌদ্ধ ধর্ম অগ্রদূতের ভূমিকা নিয়েছিল। বাণিজ্য পথ ধরে বৌদ্ধ ধর্মও নতুন নতুন গন্তব্যে হাজির হচ্ছিল। বাণিজ্য পরিচালনার সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের নীতির কোনো সংঘাত ছিল না, অন্যদিকে হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে সমুদ্রযাত্রার ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব ছিল। এমন প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বিস্তৃত হতে বৌদ্ধ ধর্ম সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল।

বৌদ্ধ ধর্মের সূত্র ধরে পাঁচ ও সাত শতকের মধ্যে কয়েকজন চৈনিক বৌদ্ধ তীর্থযাত্রী বাংলায় এসেছিলেন। তারা এ উপমহাদেশে আসেন বিভিন্ন তীর্থস্থান পরিদর্শন এবং বৌদ্ধদের প্রামাণ্য ধর্মীয় গ্রন্থের সন্ধানে। ফা-হিয়েন ভারতে চৈনিক পরিব্রাজকদের মধ্যে সর্বপ্রথম, যার বিবরণী পাওয়া যায়। পাঁচ শতকের শুরুর দিকে তিনি ভারত সফরে আসেন। ফা-হিয়েন ৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে চীন থেকে যাত্রা শুরু করেন এবং ১৪ বছর পর আবার চীনে ফিরে যান। ভ্রমণের শেষ পর্যায়ে তিনি সীমান্ত রাজ্য চম্পার মধ্য দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করেন। তার গন্তব্যস্থল ছিল সে সময়ের বিখ্যাত আন্তর্জাতিক বন্দর তাম্রলিপ্তি (তমলুক, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত)। তার বিবরণী থেকে জানা যায়, এ সময় তাম্রলিপ্তিতে ২৪টি বৌদ্ধ মঠ ও অনেক সন্ন্যাসী ছিলেন। তবে তিনি আর বর্তমান বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানায় প্রবেশ করেননি। কিন্তু তার পরে যিনি এসেছিলেন, তিনি তখনকার পূর্ববাংলা সম্পর্কে অনেক জরুরি তথ্য উল্লেখ করে গেছেন। তিনি হিউয়েন সাঙ। হিউয়েন সাঙ ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের দিকে বাংলায় আসেন। তার বিবরণীতে শশাঙ্ক এর ইতিহাস, বিশেষ করে হর্ষবর্ধনের সঙ্গে তার বৈরিতা এবং শশাঙ্কের ধর্মনীতি সম্পর্কে জানার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ উৎস। হিউয়েন সাঙ শিবের উপাসক শশাঙ্কের বেশকিছু বৌদ্ধবিরোধী কার্যকলাপের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন। তিনি পূর্ববাংলায় তখন সমৃদ্ধ বৌদ্ধ স্থাপনা ও সম্প্রদায়ের বিবরণ দিয়ে গেছেন।

ইতিহাসবিদ ড. আবদুল মমিন চৌধুরী লিখেছেন, ‘‌‍আদিকাল থেকেই (খ্রিস্টজন্মের কাল থেকে তো নিশ্চয়ই) বাংলার সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নৌ ও স্থলপথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বাণিজ্যিক স্থলপথের উল্লেখ চৈনিক বিবরণে রয়েছে। বাংল থেকে এই পথ আসাম ও মনিপুর হয়ে উত্তর মিয়ানমারের (বার্মার) ভেতর দিয়ে চীনের দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আরো দুটি স্থলপথের উল্লেখ পাওয়া যায়: ১. বাংলার সমতট অঞ্চল থেকে সুরমা ও কাছাড় উপত্যকা হয়ে লুসাই পাহাগ, মনিপুর, উত্তর মিয়ানমার (বার্মার) মধ্য দিয়ে মধ্য বার্মার প্যাগান পর্যন্ত এবং ২. বাংলার চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আরাকানের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ বার্মার শ্রীক্ষেত্র পর্যন্ত। এই দুইটি পথ ধরেই বার্মার প্যাগান ও শ্রীক্ষেত্র রাষ্ট্রদ্বয়ের ও বাংলার সমতট-হরিকেল অঞ্চলের রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।’ 

বাণিজ্য সম্পর্ক ও পথ ধরে বৌদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষা, স্থাপত্য ধারা বাংলা হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তৃত হয়। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, ধর্মীয় আচারে ব্যবহৃত বস্তু, চিত্র, ধর্মনীতির মাধ্যমে এ দুই ভৌগোলিক অঞ্চল যুক্ত হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাটিতে বৌদ্ধ ধর্ম পৌঁছেছিল মোটামুটি দ্বিতীয় শতকে—বিশেষত মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে। লিখিত আকারে বৌদ্ধ সাহিত্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাওয়া যায় পঞ্চম শতাব্দী থেকে। এ থেকে বোঝা যায় ততদিনে বৌদ্ধ ধর্ম সে অঞ্চলে জায়গা করে নিয়েছে। এখানে মহানাবিক বুদ্ধগুপ্ত নামে পরিচিত খোদাই লিপির কথা উল্লেখ করা যায়। মালয় উপদ্বীপে ওয়েলসলি জেলার একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে শ্লেট পাথরে উৎকীর্ণ একটি লিপি আবিষ্কৃত হয়। পঞ্চম শতাব্দীতে উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রচলিত লিপিতে উৎকীর্ণ শিলালেখটিতে একটি বৌদ্ধ স্তূপের প্রতিকৃতি অংকিত হয়েছে মাঝখানে এবং এর দুই পাশে উৎকীর্ণ লিপিতে রক্তমৃত্তিকায় বাস্তব্য মহানাবিক বুদ্ধগুপ্তের সর্বপ্রকারে, সকল বিষয়ে এবং সর্ব উপায়ে সকলে সিদ্ধযাত্রা হউক—এ রকম একটি প্রার্থনা উৎকীর্ণ হয়েছে। ধারণা করা হয় কোনো বৌদ্ধ ধর্মগুরু বা সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে এ প্রার্থনা করা হয়েছিল। ড. আবদুল মমিন চৌধুরী এ প্রসঙ্গে মূল্যায়ন করেছেন, ‘‌‍খোদাই করা লিপিটি রক্ষাকবচের মতো বুদ্ধগুপ্তের সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যাত্রার প্রক্কালে এই ধরনের ব্যবস্থা তো বাংলায় বহুল প্রচলিত।’

কে আর হলের মত, ‌দশম শতক নাগাদ দুনিয়াতে বৌদ্ধ ধর্মের তিনটি কেন্দ্র উজ্জ্বল হয়ে ছিল—বিহার-বাংলা, যা তিব্বত ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল, শ্রীলংকা এবং তৃতীয়টি চীন। এই বড় ভৌগোলিক অঞ্চলের সঙ্গে বিশেষভাবে একটি এলাকাকে যুক্ত করতে হবে—আজকের বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে অবস্থিত—সমতট (কুমিল্লা ও নোয়াখালী) ও হরিকেল (চট্টগ্রাম)। এ এলাকাগুলো ছিল মহাযান বৌদ্ধদের শক্তিশালী কেন্দ্র। সমতটের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগের ইতিহাসের মূল সূত্র চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙয়ের ভ্রমণবৃত্তান্ত। তিনি লিখেছেন, ‘‌সেখান থেকে উত্তর-পূর্বে গিয়ে আমরা সমুদ্রের পাশে অবস্থিত শ্রীক্ষেত্র (মায়ানমার) রাজ্যে যাই। দক্ষিণ-পূর্বে সমুদ্রের সীমান্তে আমরা যাই কমলঙ্কা (পেগু) রাজ্যে। আরো পূর্বে অবস্থিত দ্বারবতী রাজ্য (শ্যাম)। আরো পূর্বে অবস্থিত দেশের নাম ইশানপুর এবং তার পূর্বে মহাচম্পা (ভিয়েতনাম), যা অনেকটাই লিন-ইর মতো। এর দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত যবনদ্বীপ।’ মুদ্রা শিল্পকলার তুলনামূলক বিশ্লেষণ থেকে হিউয়েন সাঙয়ের বক্তব্যের সত্যতা নিশ্চিত করা যায়। অন্যদিকে হরিকেল থেকে বঙ্গোপসাগরে সমুদ্র নেটওয়ার্কের কথা উঠে এসেছে হিউয়েন সাঙয়ের পরে সপ্তম শতাব্দীতে বাংলায় আসা চৈনিক পরিব্রাজক আই সিঙয়ের বর্ণনায়। তিনি জাভা ও মালয়ের সঙ্গে হরিকেলের সমুদ্র যোগাযোগের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি তান-কোং নামে একজন চীনা পুরোহিতের কথা জানিয়েছেন, যিনি সাগরপথে হরিকেল এসেছিলেন এবং হরিকেলের রাজার অনেক সহায়তাও পেয়েছিলেন।

এসএম রশিদ: লেখক ও অনুবাদক