সিল্করুট

ঢাকাই শাড়ির সাতকাহন

শফিকুল কবীর চন্দন

ছবি: লেখক

আবহমান কে বুনেছো সোনার ধান?

কে রুপনারায়নে দিয়েছো অথৈ পাড়ি?

মাটির দেয়াল কে গেঁথেছো গাঁয়ে গাঁয়ে?

কে তাঁত চালাও বোনো রামধনু শাড়ী?১ 

নারীর শাড়ি সারি সারি। নারী আর শাড়ি এক সুতোয় গাঁথা দুটি শব্দ। বিশেষ করে বাঙালি নারীর যেন আসল রমণীয় সৌন্দর্য শাড়িতেই ফুটে ওঠে। নানা রঙের, নানা ঢঙের নকশার বস্ত্রখণ্ডটি দিয়ে নিজেকে সাজাতে ভালোবাসেন নারী। ‘‌শাড়ি’ শব্দের উৎস ‘‌শাট’ বা ‘‌শাটক’ শব্দজাত ‘‌শাটিকা’। শাটক শব্দের মূল অর্থ ছিল ফালির মতো সরু দৈর্ঘ্যের জোড়া দেয়া কাপড়। আচার্য সুকুমার সেনের পরিবেশিত তথ্যানুযায়ী তখনকার দিনে বেশি বহরের কাপড় একবারে বোনার মতো তাঁতযন্ত্রের প্রচলন ছিল না। শাটক জোড়া দিয়ে যে বস্ত্র তৈরি হতো, তা নারী পুরুষ উভয়েই পরত।

কারো মতে, সংস্কৃত ‘শাটি’ বা ‘শাটী’ শব্দের অর্থ ‘বস্ত্র সম্ভার’, যা কালক্রমে ‘শাড়ি’ শব্দ রূপে রূপান্তর হয়েছে। ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাই করা কাপড় পরার রেওয়াজ আদিমকালে ছিল না। এ সেলাইবিহীন অখণ্ড বস্ত্র পুরুষের ক্ষেত্রে ‘ধুতি’ ও মেয়েদের বেলায় ‘শাড়ি’ নামে অভিহিত হয়। এ উপমহাদেশে শাড়ির ইতিহাস প্রায় ৫ হাজার ৫০০ বছর পূর্ণ বলে ধারণা করা হয়। সিন্ধু ও মেহেরগড়ের মতো অনার্য সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে যে চিত্র পাওয়া যায় তাতে নারীর অঙ্গাবরণ হিসেবে শাড়ির মতো বস্ত্রখণ্ড ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়।

কবি নারীর অঙ্গাবরণ শাড়ি নিয়ে তাই কাব্য মাধুর্য্যে শাড়ি ও প্রিয়ার স্তূতি করেছেন—

শাড়িতে তোমাকে মানায় সবচে বেশী 

এবং তা যদি স্বদেশের তাঁত হয়

নগ্ন দেহের শ্যামল প্রকৃতি ঘিরে 

নদীর মতো জড়িয়ে থাকে শাড়ি।

বঙ্গ নারীর প্রানরঙা পরিধান ঐতিহ্য শাড়ি।

শাড়ির ভাঁজে আর অবগুণ্ঠনে নারীর রূপসুধা, মাতৃত্ব, প্রিয় গন্ধ মাদকতা ভরা। নারী রূপসাধনে বঙ্গজ ঐতিহ্যের জামদানি শাড়ি অনন্য স্মারক। সেখানে রূপের ঠমক গমক যেমন, তেমনি শিল্পজ্ঞানের সুষমা, রঙের প্রাণোজ্জ্বলতা আর বয়নশিল্পীর বস্ত্ররূপ নির্মাণের পরম্পরা, নন্দন কারিগরি।

শস্যের স্বপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পাবি

আরো বেশি ঢেলে দেবো আন্তরিক দরদ,

সলাজ সাহস নিয়ে ধরে আছি পট্টময় শাড়ি

সুকণ্ঠি কবুল করো, এ অধমই তোমার মরদ।২

রংপুরের জাগের গানা আছে শাড়ি নিয়ে রঙঢঙের কথা! মরদের কথা!

‌নীল শাড়ি চুরি করি বসেছিল ঠ্যালে।

আজ তার পত্তিশোধ দিমো রাতির কালে।।

নীল মেঘের মতো হয় কালীয়ার রং।

নীল শাড়ী করমো তারে করমো বড় রং।।

দেবীর জন্য বিশ্বকর্মা যে বস্ত্র বুনেছিলেন, তার ‘‌রূপার পড়্যান আর হেমগুনা টানা’-অর্থাৎ রুপার পোড়েন ও স্বর্ণের সুতোর টানা। তবে এ বস্ত্রের নাম কী ছিল তা জানা না গেলেও ‘‌শিরিন জবান তথা মিষ্টি ভাষা ফারসি আমাদের কার্পাসের কাব্য মসলিনের জন্য জুগিয়েছিল শ্রুতিমধুর নাম।’৩

শুধু মসলিনই বা বলি কেন, নারী পুরুষের প্রাত্যহিক ব্যবহৃত বস্ত্রের কত নাম! সব ছাপিয়ে নারী পরিধেয় শাড়ির নাম ছড়িয়েছে অগুনতি সংখ্যায়। বাংলায় কত রকম বস্ত্র হতো তাদের নাম কী কী ছিল? এমন প্রশ্নের উত্তর সুনির্দিষ্টভাবে দেয়া এককথায় অসম্ভব। আবার বলা যায় অসংখ্য। দুটো উত্তরই সঠিক বলে ধরে নেয়াই সংগত। শতশত বা বলি হাজার হাজার বছর ধরে বস্ত্রের অসংখ্য রকমফেরের পাথুরে প্রমাণ না থাকায় আমরা সেসবের তথ্য পাইনি। কালগর্ভে মনুষ্য কারিগরি ঐতিহ্য বস্ত্র সর্বদাই তার নাজুকতার জন্য হারিয়ে গেছে সবচেয়ে দ্রুততর সময়ে।

ঢাকাই বস্ত্রের বয়স কত? বা বলি ঢাকাই শাড়ির? এতদঞ্চলে এত বিচিত্র নামের বাহারি শাড়ি থাকতে ঢাকাই শাড়ি নাম হিসেবে কেন ঢের আদরণীয় হয়ে রইল? কিংবা এতসব বাহারি শাড়ি সবই ঢাকাই শাড়ি? প্রাচীনকাল থেকে ঢাকার বিস্তৃতি নানা সময়ে পাল্টেছে। তবে ঢাকার সমৃদ্ধ বস্ত্রযুগের সমুদয় অঞ্চলের বস্ত্র নির্মিতির ভৌগোলিক ব্যাপ্তি নিছকই আজকের ঢাকাকে বিবেচনা করলে হবে না। প্রাক-উপনিবেশিককালে কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ী, বাজিতপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল, কুমিল্লার চাঁদপুর, মতলবগঞ্জ, নোয়াখালীর যুগদিয়া, লক্ষ্মীপুর, বিক্রমপুর, সোনারগাঁ, কাপাসিয়া, ধামরাই, বাখেরগঞ্জ, টাঙ্গাইল অব্দি বিস্তৃত মোকাম উল্লেখযোগ্য। ঢাকাকে কেন্দ্র করে এ চৌহদ্দির বস্ত্র ও অন্যান্য বাণিজ্য কার্যক্রম পরিচালিত হতো। ফলে এ ঢাকা অঞ্চলের উৎকৃষ্ট শাড়ি বস্ত্রের নামই ঢাকাই শাড়ি হয়ে থাকবে। বিশেষ কোনো শাড়ি যে ঢাকাই শাড়ি আখ্যা পায়নি এমন মীমাংসায় আসা যেতেই পারে। অর্থাৎ কোনো বিশেষ একটি শাড়ি মানেই ঢাকাই শাড়ি নয়। সূক্ষ্ম, কোমল, ঘন বুনটের শাড়ি বস্ত্রই ঢাকাই শাড়ি। নানাবিধ রঙবাহারি নকশা, বুনট, বুননের তাঁত শাড়ি ঢাকাই শাড়ির আদরণীয় তকমা নিয়ে নারীদের পছন্দরাজ্য শাসন করেছে বহু বহু অতীত, যা এখনো চলমান।

এবার জানিস ঢাকাই শাড়ি কিনেছি ছয় জোড়া 

সেটা কিনা আপাদমস্তক সোনার জড়িতে মোড়া।৪

দুঃখজনক হলেও এ কথা স্বীকার করতেই হয় অদ্যাবধি ‘‌ঢাকাই শাড়ি’ বিষয়ে তেমন কোনো গবেষণা, লেখালেখি নেই! ফলে উপাত্তের সংস্থানও সহজলভ্য না হওয়ারই কথা। শুধু তা-ই নয়, তার সম্ভাবনাও যথেষ্ঠ ক্ষীণ! এ অবস্থায় এ প্রবন্ধে ঢাকাই শাড়ির তথ্য তালাশে নির্ভর করেছে লোককথা, কাব্য, গীত, গান তথা প্রাচীন-মধ্য ও আধুনিক যুগের সাহিত্য সূত্রে, যা পরম্পরা সাহিত্য, স্মৃতি শ্রুতি, ইতিহাস নিরপেক্ষ। যেখানে ব্যাপ্ত, ব্যাখ্যাত সূত্রের নিরিখে এ ঢাকাই শাড়ির বয়ান।

নারী শরীরে লেপ্টে থাকা সুতির তাঁতের শাড়ির নকশা রঙ ও লাবণ্যের ওম জড়ানো দিন! বয়ন প্রত্নভূমির স্মৃতির শেকড় পুনরাবিষ্কারের সন্ধান। বস্ত্রে। টানাপোড়নের প্রকরণে সৃষ্ট বাহারি ‘‌বস্ত্রচিত্রে’।

বাংলার নারীর চিরবরেণ্য শাড়ি বাংলাদেশের হস্তচালিত তাঁতশিল্পের কাছেই সর্বোপরি ঋণী। বিষ্ণু দের রবীন্দ্র উত্তরাধিকারের একটি ধারাবাহিক প্রতীক আশ্রিত ভাবনা-এ কথা বলাই যায়।

অন্ধ, খুঁজি চেনা মুখ যার পরণে ঢাকাই শাড়ি

কপালে সিঁদুর, ধলেশ্বরী

কোথায় শুকতারা অন্তরঙ্গ সেই আশাবরী!

অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায় বাঙালীর ইতিহাস আদিপর্ব বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘আজিকার দিনের বাঙালী নারীরা যেভাবে কোমরে এক বা একাধিক প্যাঁচ দিয়া আধোবাস রচনা করেন প্রাচীন পদ্ধতিও তদনুরূপ, তবে আজিকার মতন প্রাচীন বাঙালী নারী শাড়ির সাহায্যে উত্তরবাস রচনা করিয়া দেহ আবৃত করিতেন না; তাঁহাদের উত্তর-দেহাংশ অনাবৃত রাখাই ছিল সাধারণ নিয়ম।’ আবৃত নারীদেহ সৌষ্ঠব, দেহবল্লরী পরিবেশিত হয়ে সৌন্দর্য্যের সহাস্য উপস্থিতি মনোহর পরিভাষায় বিভায় মাত্রা যোগের কুশীলব ঢাকাই শাড়ি। বাঙালি নারীর পছন্দের সহাস্য স্বীকৃতি। অজ্ঞাত লোককবির বর্ণনায় সে কবে ঢাকাই শহাড়ি—

জ্যৈষ্ঠ মাসে ল্যাখলাম চিঠি

কইলকাতারইয়া বাড়ি।

আমার লাহিগ্যা আনবেন কিন্যা 

ঢাকাই তাঁতের শহাড়ি।

রামপ্রসাদ সেন তার বিদ্যাসুন্দর কাব্যে উল্লেখ করেছেন তৎকালীন প্রচলিত মূল্যবান বস্ত্রের নাম। সেখানে ঢাকাই বস্ত্রের ফিরিস্তি যেমন—

বনাত মখমল পট্ট ভূষণাই খাসা।

বুটাদার ঢাকাইয়া দেখিতে তামাশা।।

মালদই নলাটি চিকন সরবন্দ 

আর আর কত কব আমির পছন্দ।।

কালের পরিক্রমায় অঞ্চলভেদে বস্ত্র কারিগরদের মুনশিয়ানায় সুতায়, রঙে, নকশায়, তথা শাড়ি বয়নের কৃৎকৌশলে পরিবর্তন ঘটেছে। এ পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় বস্ত্রপণ্য হিসেবে শাড়ির নামকরণও হয়েছে নানাবিধ। প্রাচীন গল্প, গাথা, ইতিহাস ঐতিহ্যের, লোককথায় বিচিত্র সব নামের শাড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। গঠন বৈচিত্র্যে, নকশার তারতম্যে, সূক্ষ্মমতায়, বয়ন পটুত্বের, সুতার গঠন, কারুকার্য্যে শাড়ি বস্ত্র শিরোমনি। নারী, শাড়ি সারি সারি। অসংখ্য নামের শাড়ির অস্তিত্ব জানান দেয় বাংলার বস্ত্র বয়ন মাহাত্ম্য।

ঢাকাই শাড়ী কিন্যা দিছে, হাঁসলী দিছে নাকি,

এত করে এখন কেন শাদীর রাখিস বাকি?৫

আরো কিছু শাড়ির নাম উল্লেখ করেছেন কবি জসীমউদ্‌দীন। তার ‘পূর্ববঙ্গের নক্সী কাঁথা ও শাড়ি’ প্রবন্ধে ময়মনসিংহ অঞ্চলে গত শতকের ত্রিশ-চল্লিশের দশকে প্রচলিত এসব বস্ত্রের নাম হলো কাদিরের শাড়ি, জামের শাড়ি, ফরাসি শাড়ি, লক্ষ্মীবিলাস, কৃষ্ণ নীলাম্বরী, সোনাঝুরি, মধুমালা, কলমীলতা, গোলাপ ফুল, কুসুম ফুল, রাসমঙ্গল, জলে-ভাসা, এক-পাছুল্লা, কাচ পাইড়, কালপিন, গাল পাইড়, কুনারি, বাঁশি পাইড়, চোদ্দরসী, কাঁকড়ার ছোপ, আয়না ফোঁটা ইত্যাদি। প্রবন্ধটিতে কবির সংগৃহীত ওতলা সুন্দরীর পালাগানেও রয়েছে কিছু শাড়ির নাম।

সুবর্ণের গোল মল পড়িয়াছে পায় 

পড়েছে ঢাকাই শাড়ি অঙ্গ দেখা যায়। 

কবির এ বর্ণনার শাড়ি সূক্ষ্ম ঢাকাই মসলিন না হয়ে যায় না।

হাতেবোনা তাঁতের শাড়ি প্রসঙ্গে অবধারিতভাবে ঢাকাই শাড়ি অগ্রগণ্য। ঢাকাই শাড়ির উদাহরণ হিসেবে আমরা জামদানির উল্লেখ করতে পারি, যা ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এখনো টিকে আছে। একদা জামদানি ছাড়াও ঢাকায় আরো বহু ধরনের শাড়ি তৈরি হতো। বুননকৌশলের দক্ষতা ও মিহি বস্ত্রের জন্য ঢাকাই শাড়ির খ্যাতি সর্বজনবিদিত।

পরায়ে দেও কন্যায় ঢাকাই শাড়ী 

হাতেতে পরায়ে দাও বেলোয়াড়ি চুড়ি

সাকুল্যে নামের ভিড়ে ঢাকাই মসলিন, ঢাকাই জামদানি হাল আমলেও নাম হিসেবে বাণিজ্যদস্তুর! তবে সুদীর্ঘ ইতিহাসের সব কালে ঢাকাই বস্ত্র তথা ‘‌ঢাকাই শাড়ি’ কতটা আদরণীয়, কাঙ্ক্ষিত সব বয়েসী নারীদের তা বিস্ময়ের! প্রেমে, অনুরাগে, বিয়ে, ফুলশয্যায় সর্বত্র তার একচেটিয়া আধিপত্য। ফলে কবি সাহিত্যিক, পালাকার, গায়ক প্রত্যেকের রচনায় দেদীপ্যমান এ ঢাকাই শাড়ি। অভিমানী নারীর আবদার, প্রেমময় প্রকাশে পুরুষের, দয়িতার, দুলহার একক পছন্দ হয়ে রচিত হয়েছে ঢাকাই শাড়ির স্তূতি। কবে কখন কীভাবে ঢাকায় শাড়ি একাই সর্বংসহা বস্রাধিপতি বনে গেল অলক্ষ্যের সে খবর কাগজের পাতায় দিন তারিখ দিয়ে লেখা না থাকলেও পরম্পরার ইতিহাস তা সগর্বে বহমানতা জারি রেখেছে। শাড়ির কৌলিন্য ঢাকাই সুতির শাড়ি।

ময়মনসিংহ গীতিকায় সোনা মিয়া ফুলকুমারীকে বলে—

ঢাকা থাইকা আইনা দিমু 

ঢাকাই মিহি শাড়ী 

সোনা-হীরায় তোমার সকল 

অঙ্গ দিমু বেড়ী।

শিঘ্রি কইরা চলো রে কন্যা 

(আমি) পরাণ ধরতে নারি।’

বিশ্বনাথ হয়তো বুঝবেন এ দুরাশায় বলে ফেলেছিলেন ‘‌জান ছোটো বৌয়ের ফুলশয্যার ঢাকাই শাড়ি আইসে।’

‘‌তো?’ বিশ্বনাথ সত্যি বিভ্রান্ত বোধ করেন।

‘‌আমারে তো তোমরা শুধু কল্কাপাড় টাঙ্গাইল দিসিলা।

হা: হা: করে অট্টহাস্য করেছিলেন বিশ্বনাথ, ‘‌সত্যি তো ভারী অন্যায় হইসে। তোমার লাইগ্যা অখন, আনারসী আনুম ব্যানারসি আনুম।’ 

বিশ্বনাথের ঠাট্টায় তখনকার মতো কথাটা চাপা পড়ে গিয়েছিল।

আবার ক্ষোভটা বেরিয়ে এসেছিল দেবনাথের বিয়ে উপলক্ষে রচনা করা পদ্যে। প্রমীলার জন্য দামি শখের জিনিস যত সহজে সংসারে এসেছিল ননীবালার সাধ আহ্লাদের কথাটা তত সহজেই সবাই ভুলেছিল। ননীবালাও ভুলতে চেয়েছিলেন কারণ তাতেই শান্তি। শুধু বিয়ের পদ্যতে ঢাকাই শাড়ির উল্লেখ করেছিলেন এ বধূর কদর আলাদা সেটা বোঝাতে। সে কারণেই এতদিন বাদে পদ্যতা খানিক মনে থেকে গিয়েছে।

প্রমীলা দেবনাথ 

ধরিল হাতে হাত 

ঢাকাই শাড়ি পড়িয়া 

আঙ্গিনা উজ্জ্বল করিয়া 

বধূ আইল ঘরে...৬

গৃহস্থ বৌয়ের পাট ফসল যেমন পাকা বাড়ি করতে সাহায্য করেছে তেমনি ঢাকাই শাড়ি পড়ার সামর্থ্য জোগায়—

পাটে আমার ভাত কাপড়

পাটে ঢাকাই শাড়ী

পাটের দৌলতে আমার

ষান বান্দা বাড়ী।’

‘আমি আনতে পারি আলতা, চুরি,

ঢাকাই শাড়ি, গহনা;

চাই কী তোমার বুঝিয়ে বলো না।

গানটি ষাটের দশকের হলেও ঢাকাই বা জামদানি শাড়ির আবেদন মেয়েদের কাছে আজও অমলিন। এটাই জামদানির ‘জাদু’। এর বুননশৈলী ও সৌন্দর্য নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। এর সঙ্গে বাঙালির ঐতিহ্য বা সংস্কৃতির সম্পর্ক আদিকালের।

গ্রামের বিয়েতে লোকগানের কথায় উঠে আসে ঢাকাই শাড়ির কথা।

সোহাগ দি ফুল

আর মেয়ে গো সুন্দরী

পইরণে ঢাকাই শাড়ি-এগো মাগো

সোহাগ দি ফুল

যশোর অঞ্চলের বিয়ের গীত—

গাথোলো গাথোলো কন্যা 

ফেন্দো ঢাকাই শাড়ী, 

ঢাকাই শাড়ী ফিন্দা 

কন্যা যাবে শ্বশুর বাড়ী।

যৌনতার অমোঘ ইশারা, ঠোঁটে শরীরী আহ্বান প্রকাশিত গানে, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের রচনায় শহুরে বাঙালির পছন্দ উচ্চারণ, ‘‌এবার ম’লে সুতো হবো, তাঁতির ঘরে জন্ম লিব, পাছাপেড়ে শাড়ি হয়ে দুলবো তোমার কোমরে...।’

আবার উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া গানে শোনা যায় ঢাকাই শাড়ি কীর্তন-

‌আবো টপ্পাস কি টুপ্পুস করিয়া

আবো সগাঁয় বেড়ায় টারিটারি নীল শাড়ি পিন্দিয়া,

তোলা আছে ঢাকাই শাড়ি কাই যাইবে পিন্দিয়া।

ওকি ঢাসসাম কি ঢুসসুম ওকি ঘসসর কি ঘসসর করিয়া।

শাড়ি কেবল মান ভাঙানো, মন ভুলানোর জন্য অর্থাৎ রোমান্টিকতার লক্ষ্যেই নিবেদিত হয়নি। বাংলা প্রবাদে মা পুত্রবধূর প্রভাবে পুত্রের দ্বারা অবহেলিত ও লাঞ্চিত হওয়ার চিত্র প্রকাশে ঢাকাই শাড়ির উল্লেখ দেখা যায়। যেমন—

‌ বৌয়ের বেলায় ঢাকাই শাড়ি

মায়ের বেলায় গলায় দড়ি।

নাম এক চারণ কবির গানে বিধৃত হয়েছে ঢাকায়ই জামদানি শাড়ির কথা। যেখানে প্রিয়তমা শাড়ি হাটে যাওয়ার পথে তার বন্ধুকে ঢাকাই জামদানি শাড়ি আনতে বলছে—

‌কত রঙ বেরঙ এর

শাড়ি দিলাম নাম নাহি জানি 

হাটের পথে বন্ধু কয়

আইনো ঢাকাই জামদানি।

বনদুর্গার ব্রতগীতে সই পাততে শাড়ি তথা ঢাকাই শাড়ির উল্লেখ দেখা যায়। সইয়া যেহেতু ঢাকায় ব্যবসা করে, ফলে তার পক্ষে ঢাকাই শাড়ি জোগাড় করা সহজ। তাই সইয়াকে আগেই ঢাকাই শাড়ি কেনার জন্য বলে রাখতে জানাচ্ছে—

‌বেদুনী সই চল যাই সই পাতিবারে

আমারও সইয়াগো ঢাকারও ব্যাপারী।

সইয়ারে কইও শাড়ি কিনিবারে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার মালঞ্চ উপন্যাসে উল্লেখ করেছেন—

‌নীরজা বললে, ‘‌রোশনি, দে তো ওকে আলনার ঐ কাপড়খানা।’

রোশনি সবলে মাথা নেড়ে বললে, ‘‌সে কি কথা, ও যে ঢাকাই শাড়ি!’

‘‌হোক না ঢাকায় শাড়ি। আমার কাছে আজ সব শাড়িই সমান। কবেই বা আর পরবো।’

চটকা গানে ঢাকাই শাড়ির মাহাত্ম্য উচ্চারিত হয়েছে, যেমন—

‘সগায় বেড়ায় টারি টারি, নাল শাড়ি পিন্দিয়া

তোলা রিসে ঢাকাই শাড়ি কায় যাবে পিন্দিয়ারে

ও কি খসসড় কি মসসড় করিয়া

ও কি খসসড় কি মসসড় করিয়া।

ঢাকাই শাড়ি আর ঢাকাই জামদানি অনেক ক্ষেত্রেই একীভূত হয়ে প্রকাশ পায়। যেমন—

অমলিন ঐ জামদানিটা ঢাকাই জামদানি

মিশর তুলার বুনন হাতের পুজোর আমদানি।

ঢাকা এবং গ্রামবাংলা অথবা শহর কলিকাতা;

ফাঁকা সবি, আমজনতা পসরা পিষ্ঠজাঁতা।’৭

‘‌এমন মেঘ রঙের ক্রেপের শাড়ি কোনদিন পরেনি মাধুরী, এমন করে এত লম্বা আঁচলও মাধুরীকে কখনো লুটিয়ে দিতে দেখেনি শতদল। বেড়াতে যাবার সময় মাধুরীকে অবশ্যই পরতে হতো তাঁতের শাড়ি, ঢাকায় বা অন্য কিছু, চলতে গেলে যে শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে ফিসফিস করে অদ্ভুত এক শব্দের সুর শিহরিত হয়। আঁচলে অবশ্যই মাখতে হতো এক ফোঁটা হাসনুহেনার আরক। সে সুর ও সৌরভ হয়ে শতদলের পাশে চলতে হতো মাধুরীকে, নইলে শতদলের মন ভরত না।’৮

‌আর এক নারী বেচে কার্পাসের বাস।

বেশে দেয় পরিচয় ঢাকায় নিবাস।।

বিমল বারির স্রোত নাম আবরোঁয়া।

পুরাথান বশবিলে সুখে যায় থোয়া।।

অনুপম শবনম সূক্ষ্ম অতিশয়।

নিশীর শিশিরে যাহা দৃশ্য নাহি হয়।। 

বিবিধ বিচিত্র পুষ্পদাম বিখচিত।

জামদান কামদান রমণী রচিত।।

মজায় বিলীন সেই বুক মজলীন।

সন্তানক কুসুম স্বরূপ অমলিন।। 

শাবাশ শাবাশ তোরে ঢাকা জনপদ।

শিল্প চাতুরীতে তোর অতুল সম্পদ।। 

পরাভূত সবে বটে কৈল বাস্পকল। 

কিন্তু জয়ী তব শিল্প-চাতুর্য্য, কৌশল।।৯ 

শুধু ঢাকাই শাড়িই নয় দূতিবিলাস বইয়ে ভবানীচরণ নায়ক শ্রীদেবীকে কীভাবে সাজিয়েছেন তা লক্ষ করার মতো—

কালা কল্কাদার ধুতি উত্তম ঢাকাই।

পড়িয়াছে সেই বস্ত্র যার সম নাই।।

উপনিবেশিক ইংরেজ তার বাষ্পীয় কলে তৈরি সুতায় বোনা কাপড় বাংলায় আসে ঢাকায় বস্ত্রের নকল হয়ে! তেমনি আরো নানা জনপ্রিয় বস্ত্রের নকলে নাকাল সস্তা কাপড়ে ছেয়ে গেল বাজার। লেখক বস্ত্রের সেই নকলবাজি নিয়ে বলছেন—

ঢাকাই বস্ত্র রইল ঢেকে, শান্তিপুরের ভ্রান্তি দেখে, রকম রকম বিলাতি পাড়! কাশি পেড়ে রেল পেড়ে, রকম রকম পাছা পেড়ে, কাপড়ের কি হয়েছে বাহার।১০

‘‌সিপাই পেড়ে ঢাকাই শাড়ি, মালকোচা করে পরা,

তারকেশ্বরে ছোবান গামছা হাতে বিল্বপত্রে বাঁদা সুতা।

—হুতোম পেঁচার নকশা (টেকচাঁদ ঠাকুর)

১৮৫৭ খ্রি. সিপাহি বিদ্রোহের পর ঢাকার তাঁতিরা নতুন ফ্যাশন চালু করে সিপাই পেড়ে শাড়ি ও ধুতি। সে কথাই এখানে উল্লেখিত।

‘কলকাত্তাইয়া ইংরেজি শিক্ষিত ভদ্রলোক আর মিহি কাপড়ের অশ্লীলতার দায় ঢাকার বস্ত্র।’১১

‘‌বিলিতি যন্ত্রের কাপড় ছেড়ে ঢাকার দিশি তাঁতের কাপড় অসংকোচে এবং গৌরবের সঙ্গেই কিনব। সেই কাপড়ের সুতোয় বাংলাদেশের বহুযুগের প্রেম এবং কৃতিত্ব গাথা হয়ে আছে।’১২

যতোই ঝাড়ো ঢাকাই শাড়ী

একটি হ’লেও থাকবো বিঁধে

চোরকাঁটা ঐ সবুজ শাড়ীর ভাঁজে,

যতোই মাখো রিঠা-সাবান

ছোঁয়া হয়েই থাকবো মিশে

শ্যামলবরণ দেহের গোপন খাঁজে।’১৩

শাড়ি হয়ে উঠেছে প্রেম অনুরাগের অনুষঙ্গ। কথায় কাব্যে ঠারে তার প্রকাশিত—

‘এ গান যেখানে সত্য/অনন্ত গোধূলিলগ্নে/ সেইখানে/

বহি চলে ধলেশ্বরী; তীরে তমালের ঘনছায়া; আঙিনাতে/যে আছে অপেক্ষা করে, তার/পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।

ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া...

পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর॥’১৪

দয়িতাকে সুখে পাকা ঘরে রেখে ঢাকাই শাড়িতে সজ্জিত করে বাড়ি বাড়ি বেড়াতে যাবে, তাতে দেখে লোকে আফসোস করবে সে কথা বলা হচ্ছে—

দোতালাতে রাখবো তোরে খেড়া ঘরে রাখবো না লো।।

কিন্যা আনমু ঢাকাই শাড়ি পিন্ধ্যা যাবি বাড়ি বাড়ি 

রাস্তার লোকে দেইখ্যা তোরে বুক থাপড়াইয়া মরবে ওলো।।১৫

পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া অঞ্চলের ভাদু গানের বানিতেও উপস্থিত ঢাকায় শাড়ি—

ভায়ে বলে আনব বুনকে ভাজে বলে কি দিব

আমি রানিগঞ্জের ঢাকাই শাড়ি বুনকে বিদায় করিব। ও ভাদু।

রানিগঞ্জের ঢাকাই শাড়ি পরেছি আর পরব না 

তুমি গেছিলে শ্যাম ভবের বাজার বিষয় পাঁয়ে ভুল না। ও ভাদু।১৬

শাড়ি জমিন, তার রঙ ধোলাই নিয়েও ঢাকাই শাড়ির বিশেষত্ব বর্ণনা পাওয়া যায় কাব্যে—

ঢাকাই বোনা গুলবাহার,

কোরায় করে ব্যবহার,

ঘুরিয়ে আনলে ধোপার দ্বার,

মাড় থাকেনা তার আর,

ধোপ-দোস্ত দিস্তে সরে 

জমি হয় খাপ। 

পরলে পরে আড়ং ধোপে,

খইয়ের মাড় আর নীলের ছোপে,

মিস্তিরির ইস্তিরির চাপে,

ধপধপে হয়ে শাড়ি দাঁড়ায় 

বেশ সাফ।১৭

হেয়ালিও হয় শাড়ির কথায়—

(ভাবি) খাওয়া খেলা আদর 

ঢাকাই ধুতি চাদর,

মাটির বুড়ো শোলার বাঁদর,

এ নিয়েই কাটবে অতঃপর।।১৮

ময়মনসিংহের লোককথায় ছোট বউয়ের দামি ঢাকাই শাড়ি ছিঁড়ে যাওয়ার বর্ণনাও বেশ রসালো ভঙ্গিমায় উপস্থাপিত—

ছোট ভাইয়ের বউগো তুমি 

নামটি তোমার হীরা।

চৌদ্দ সিকার ঢাকাই শাড়ি 

কেমনে গেল চিরা।।

কেচা বাঁশের বেড়া ছিল।

ঘন ঘন গিরা।

ভাসুর দেইখ্যা ঘোমটা দিতে 

আঁচল গেছে চিড়া।। ১৯ 

এ বাখানান্তে বলা বিধেয়, বাঙালি নারীর শরীর থেকে শাড়ি উবে যাওয়ার আগে শাড়ির সঙ্গে বাংলার অজেয় বস্ত্র প্রকৌশলী তাঁতির বেঁচে বর্তে থাকার বিকল্প নেই! 

তাঁতীর নিন্দে করলি ওরে যাদুধন, 

তাঁতী না থাকিলে তোর হত না বসন।

আর হ্যাঁ, শাশ্বত বাঙালি নারীর রূপবৈচিত্র্যের অবশ্যম্ভাবী অনুষঙ্গ মনোলোভা শাড়ি তৈরি করে দেয়ার কথা তো তাঁতিকেই বলা দস্তুর।

‌কুলহি মুড়ায় তাঁতিঘর।

কাপড় বুনে ছরছর।।

মার মাহতান বলে দিবি তাঁতিকে।

আঁচলে কদমের ফুল দিতে।।২০

পাবনা অঞ্চলে প্রচলিত গানের কথায় আছে—

বাড়ির কাছে তাঁতিয়া ভাইরে

শাড়ি খান বুনে দে।

সেই কথা শুনিয়ারে তাঁতি

মনে মনে হাসতাছে

কি-বা রঙের বুনবো শাড়ি

ছবি খান দেখায়া দেয়।’

 জয় বাঙলার শাড়ি।

জয় ঢাকাই শাড়ি।

উদ্ধৃতি সূত্র 

১. পূর্ণেন্দু পত্রী, লোকসংগীত।

২. আল মাহমুদ, সোনালী কাবিন।

৩. প্রাচীন শিল্প, তোফায়েল আহমেদ, পৃষ্ঠা ৪৮।

৪. নিত্যানন্দ বসাক, টাঙ্গাইল শাড়ি সনাতনী।

৫. নকশী কাঁথার মাঠ, জসীমউদ্দিন।

৬. অগ্নিসম্ভব, ঋতা বসু।

৭. পরিধান, মহাদেব কর।

৮. অন্যপ্রেম, উজ্জ্বলকুমার মজুমদার।

৯. শূরসুন্দরী (রাজস্থানীয় বীরবালা-বিশেষের চরিত্র) তৃতীয় সর্গ, পৃষ্ঠা ৪৫, শ্রীযুক্ত রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক অনুকীৰ্তিত, কলিকাতা ১৮০৮।

১০. স্ত্রী-ভূষণ বিসম্বাদ ও ঘোর কলির অনুবাদ, শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষাল।

১১. উনিশ শতকের কলকাতা ও সরস্বতীর ইতর সন্তান, সুমন্ত্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

১২. রবীন্দ্রনাথ ও লোকসংস্কৃতি, সলিলকুমার মুখোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা-২১৬, নবযাত্রা প্রকাশন, কলকাতা ১৯৮৩।

১৩. রোজনামচা (রঙীন ভাদ্র), জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়।

১৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাঁশি।

১৫. বাংলা একাডেমি পত্রিকা, ভলিউম ৫৭, পৃষ্ঠা-১১০, ২০১৩। 

১৬. বাঁকুড়া জেলা থেকে সংগৃহীত ভাদু গান, লোকসাহিত্য: গাথা-ডক্টর সুকুমার সেন, বেতার জগৎ, ১৯৫৩।

১৭. বাংলাদেশের সঙ প্রসঙ্গে, বীরেশ্বর বন্দোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা-২৯৩।

১৮. দেশের দুর্দশা, বাঙালী কোথায়?

১৯. প্রচলিত ছড়া।

২০. প্রচলিত, পাতা নাচের গান, জামবনি।

শফিকুল কবীর চন্দন: লেখক