সিল্করুট

শাড়ি বাংলার আত্মপরিচয়ে স্বতন্ত্র স্বাক্ষর

আহমেদ দীন রুমি

১৮২৭ সালে চার্লস ডয়েলির চিত্রকর্মে ঢাকার এক তাঁতি ছবি: ব্রিটিশ লাইব্রেরি/উইকিমিডিয়া কমনস

খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর দিকে লেখা হয় অর্থশাস্ত্র। লিখেছেন মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্য। তিনি বঙ্গ ও পুণ্ড্র অঞ্চল তথা বর্তমান বাংলাদেশের একাধিক তাঁত শিল্পের প্রশংসা করেন। দুকূল, পত্রোর্ণ, ক্ষৌম ও কার্পাসিক নিয়ে অন্তত চার ধরনের কাপড়ের প্রশংসা করেছেন তিনি। সম্প্রতি আবিষ্কৃত উয়ারি বটেশ্বর সভ্যতার মাধ্যমে প্রাচীন বাংলায় নগরায়ণ প্রমাণিত হয়। কার্বন-১৪ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটিতে মানববসতি খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী বলে চিহ্নিত হয়েছে। এদিকে বগুড়ার মহাস্থানগড়ের বয়স নির্ধারণ হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী। সেখানে প্রাপ্ত ফলকে সূক্ষ্ম বস্ত্রের নিদর্শন পাওয়া গেছে। উভয় অঞ্চলেই মানববসতি আরো পুরনো হওয়া সম্ভব বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা। ফলে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দী থেকেই বাংলাদেশে তাঁত শিল্পের বিকশিত রূপ থাকা স্বাভাবিক। মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকার ইশারা খোদ অর্থশাস্ত্রতেই পাওয়া যায়। তাছাড়া খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে সিল্ক রোডও অনেকটা চালু হয়ে গেছে। ফলে বাংলার তাঁত পণ্য সে সময় থেকেই প্রথিবীর বিভিন্ন অংশে রফতানি হতো। আর তাঁত পণ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল শাড়ি। 

প্রাচীন বাংলার বস্ত্র শিল্পের অন্য বড় দলিল প্লিনির বিবরণ। তিনি দাবি করেছেন, প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে যাওয়া পণ্যের মধ্যে বাংলার রেশম ও সুতি বস্ত্র ছিল অন্যতম। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে লেখা The periplus of Erythraen Sea গ্রন্থে গঙ্গাতীরবর্তী অঞ্চলের তাঁত শিল্পের আলোচনা আরো স্পষ্ট। সেখানে বলা হয়েছে There is a river near it called the Ganges, on its bank is a market-town which has the same name as the river Ganges. Through this place are brought malabathrum and gangatic spikenard and pearls and muslins of the finest sorts, which are called Gangetic.

মসলিনের সমৃদ্ধি এখানকার তাঁত শিল্পের সমৃদ্ধিকেই প্রতিফলিত করে। আর গ্রিক ঐতিহাসিকদের দেয়া গঙ্গারিডির সমৃদ্ধির যে বর্ণনা, সেখানে বয়ন নিয়ে প্লিনির বিবরণ মোটেও অবাস্তব নয়। গ্রিক ঐতিহাসিক টলেমির বিবরণীতেও বাংলাদেশের তাঁত বস্ত্রের প্রশংসা আছে। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে লেখা বৌদ্ধ সাহিত্য মিলিন্দপঞহ গ্রন্থেও বঙ্গকে সামুদ্রিক বন্দরনগরী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘ঢাকাই মসলিন’ গ্রন্থে আবদুল করিম দাবি করেছেন, ‘রোমান আমলে এবং পেরিপ্লাস ও টলেমির যুগে বাংলাদেশের বস্ত্র শিল্পের সুনাম ছিল এবং এ দেশীয় সুতার কাপড় রোম সাম্রাজ্যে ও মিশর প্রমুখ দেশে রফতানি করা হয়।’ কেবল রোম বা গ্রিস নয়, সেলাই আবিষ্কৃত হওয়ার আগে মূলত একখণ্ড লম্বা কাপড়ই ছেলে ও মেয়ে নির্বিশেষে পরিধান করত। প্রাচীন সভ্যতাগুলোর ভাস্কর্য ও খোদাই চিত্র থেকে তা প্রমাণিত। যেহেতু সে সেলাইবিহীন বস্ত্রখণ্ডটিই শাড়ি হিসেবে আধুনিক সময় পর্যন্ত টিকে রয়েছে, ফলে বাংলার শাড়ির ইতিহাস এখানকার প্রাচীন নগরসভ্যতা কিংবা বস্ত্র শিল্পের বিকাশ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। 

খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে চীনা পর্যটক ফা হিয়েন ও সপ্তম শতাব্দীতে হিউয়েন সাং ভারতে আসেন। তাদের সফরের অন্তর্ভুক্ত ছিল বাংলা। সে সময়কার বৌদ্ধ অধ্যুষিত বাংলায় কাপড়ের সমৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা এসেছে। নবম শতাব্দীর আরব সওদাগর সোলেমান রহমি দেশের বিবরণ দিতে গিয়ে সেখানকার সূক্ষ্ম বস্ত্রের প্রসঙ্গ এনেছেন। আরব ভূগোলবিদ ইবনে খুরদাদবিহও জানিয়েছেন রহমি দেশের কার্পাস বস্ত্র ও আগরু কাঠের কথা। পশ্চিমা পণ্ডিত ইলিয়ট এ রহমি রাজ্যকে বাংলাদেশ বলে চিহ্নিত করেছেন। অন্যদিকে ঐতিহাসিক আবদুর রহিম দাবি করেছেন, আজকের রামুই প্রাচীনকালের সে রহমি রাজ্য। এর স্বপক্ষে আরো একটা প্রমাণ দেখা যায় আঠারো শতকের শেষ ভাগে। উত্তপ্ত সে সময় চট্টগ্রাম থেকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করেন চাকমা রাজা শের দৌলত খান ও তার সেনাপতি। সে সময়কার ইতিহাসে চট্টগ্রামকে লবণ ও কার্পাসের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে দেখা যায়।  

ত্রয়োদশ শতাব্দীর দিকে ইতালীয় পর্যটক মার্কো পলো ভারত সফর করেন। তিনি গুজরাট, কাম্বে ও মালাবারের পাশাপাশি বাংলাদেশকে তুলা উৎপাদনের কেন্দ্র হওয়ার কথা বলেছেন। তার মতে, বাংলাদেশের মানুষ প্রচুর কার্পাস উৎপাদন করে এবং তাদের কার্পাসের ব্যবসা ছিল সমৃদ্ধ। মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলায় আসেন চতুর্দশ শতাব্দীতে। তিনি বাংলাদেশের তাঁত শিল্পের প্রশংসা করেছেন। তার সফরনামায় উঠে এসেছে দাম পর্যন্ত। তার দাবি, বাংলায় লম্বা মিহি সুতার তৈরি কাপড় মাত্র দুই দিনারে বিক্রি হয়। ইবনে বতুতা বিশেষভাবে বাংলায় শাড়ি-কাপড়ের কথা বলেছেন। ১৪০৪ সালে চীনা পরিব্রাজক মা হুয়ান বাংলায় আসেন। তিনি তুলে ধরেন চট্টগ্রাম ও সোনারগাঁ শহরের বিবরণ। তার মতে, ছয় প্রকারের সূক্ষ্ম কার্পাস বস্ত্র প্রস্তুত হতো এখানে। কাপড়গুলো সাধারণত প্রস্থে দুই ও দৈর্ঘ্যে ১৯ হাত থাকত। সহজেই অনুমেয়, এখানে শাড়ির ব্যাপারে বলা হচ্ছে। মা হুয়ান পি-পো শাড়ির কথা উল্লেখ করেছেন, যা নানা রঙের সুতায় তৈরি, এর দৈর্ঘ্য ৫৬ ফুট ও প্রস্থ তিন ফুট। অন্যদিকে মান-চে-টি শাড়ির রঙ হতো অনেকটা হলুদ। এর দৈর্ঘ্য ৫০ ফুট ও প্রস্থ চার ফুট। সে সময় বাংলার তাঁত শিল্পের গৌরবময় সময়। ইউরোপীয় বণিক ও লেখকদের থেকেও তখনকার বাংলা অঞ্চলের তাঁত শিল্পের খবর পাওয়া যায়। ১৫০৩-০৮ সালে পর্তুগিজ লেখক লুই ভার্থেমা জাহাজযোগে বাংলায় আসেন। তার বিবরণ অনুসারে, বাংলায় সুতি ও রেশম বস্ত্রের বাণিজ্য ছিল পর্যাপ্ত। তিনি মনে করেন, ‘পশমি ও রেশমি কাপড়ের প্রাচুর্য বাংলায় এত ব্যাপক যে আমার মনে হয়, এসব জিনিসের উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলার সমকক্ষ আর কোনো দেশ নেই।’ বার্থেমো এখানে যেসব বস্ত্রের নাম উল্লেখ করা হয়, সেগুলো হলো বৈরাম, মামনে, লিজাটি, সিয়ানটার, দোয়াজার ও সিনাবাফ। আরেক পর্তুগিজ পর্যটক দুয়ার্তে বারবোসা ১৫১৮ সালে বাংলা সফর করেন। তিনি বলেছেন, তার বর্ণিত কাপড়ের নামগুলো হলো মেমোনা, দুতগজা, চৌতার, সিনাবামা ও বিটিলহা। ‘সোশ্যাল হিস্ট্রি অব দ্য মুসলিম ইন বেঙ্গল’ গ্রন্থে ড. আবদুল করিম জানান, বারবোসার বর্ণিত কাপড়গুলো যথাক্রমে রিবন্দ, মখমল, দোগজি, চাদর, সিনাবন্দ ও বুটিদার কথা জানানো হয়েছে। বারবোসা এখানকার নারী ও পুরুষ উভয়কেই বস্ত্রের চরকায় সুতা কাটতে দেখেছেন। ইংরেজ পরিব্রাজক রালফ ফিচ ১৫৮৬ সালে সফর করেন বাংলায়। তিনি সোনারগাঁ সম্পর্কে বলেছেন, Sinnergam is a town six leage from sirrepore where there is the best and finest cloth made of cotton that is in all india. প্রাচীনকাল থেকে বাংলা যে বস্ত্র শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল, সে ধারাবাহিকতা যে ষোড়শ শতাব্দীতেও অক্ষুণ্ন ছিল; তার বড় প্রমাণ রালফ ফিচের বক্তব্য। 

মোগল আমলে বাংলার তাঁত শিল্প পৃষ্ঠপোষকতা পায় ব্যাপক মাত্রায়। পরিব্রাজক টাভারনিয়ারের লেখা থেকে জানা যায়, ইরানের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আলী বেগ ভারতবর্ষ থেকে ফেরার সময় সম্রাটকে উপহার দেয়ার জন্য একটি ক্ষুদ্র নারকেলের খোল নিয়ে গিয়েছিলেন। ইরানের সম্রাটের কাছে মণিমুক্তাখচিত নারকেলের খোলটি উপহার দেন। খোলটার আকার ছিল উটপাখির ডিমের মতো। বের করার পর দেখা গেল, নারকেলের খোলের ভেতর রয়েছে ৬০ হাত দীর্ঘ ঢাকাই মসলিন। প্রায় একই রকম গল্প প্রচলিত রয়েছে সম্রাট আওরঙ্গজেবের কন্যা জেবুন্নেসাকে ঘিরে। একবার সম্রাট কন্যার সামনে হাজির হয়ে তাকে বে-আব্রু থাকার জন্য সতর্ক করেন। জবাবে জেবুন্নেসা পিতাকে বলেন, ‘জাঁহাপনা, আমি তো সাত ফের্তা বাংলার মসলিন পরি’। অর্থাৎ বাংলার মসলিন এতটাই সূক্ষ্ম ও মিহি ছিল যে সাত ফের্তাতেও সম্রাটকন্যার আব্রু রক্ষা হচ্ছিল না বলে মনে হয়েছে। মোগল দরবারের ঐতিহাসিক আবুল ফজল লিখেছেন, ‘সরকার সোনারগাঁ’-এ অত্যন্ত মিহি মসলিন তৈরি হয়। সুবাদার ইসলাম খানও সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় সম্রাটকে সোনারগাঁ থেকে মসলিন পাঠিয়েছেন বলে জানা যায়। 

ইউরোপীয়রা মোগল আমলেই বাংলায় আসা শুরু করে। বাংলাদেশের যেসব পণ্যকে তারা বণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করত, তার মধ্যে অন্যতম ছিল তাঁত। পর্তুগিজরা ১৫৩০ সালে কুঠি স্থাপন করে সাতগাঁও ও চট্টগ্রামে। ১৬১৬ সালে ঢাকায় স্থাপন করে কুঠি। ১৬৪০ সালে বাংলায় এসে এখানকার সুতি কাপড়ের বর্ণনা দিয়েছেন পর্তুগিজ বণিক সেবাস্তিন মানরিক। ১৬৬৬ সালে আসা ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ারও কাপড় নিয়ে প্রশংসা করেছেন। এদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নথি থেকে জানা যায়, ঢাকা ছাড়াও মসলিনের প্রসিদ্ধ কেন্দ্র ছিল সোনারগাঁ, তিতাবাদী, জঙ্গরবাড়গী, ধামরাই ও বাজিতপুর। ১৭৭৬ সালে কেবল ঢাকা জেলায়ই বয়ন শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন প্রায় দেড় লাখ মানুষ। নবাবি আমলে ঢাকায় বস্ত্রশিল্পকে কাঠামোবদ্ধ করা হয়। মুর্শিদ কুলি খানের সময়ই ভাগ করা হয়েছিল নানা দপ্তরে। সেখানে ঢাকার আড়ং থেকে জামদানি ও সিল্কের কাপড় যেত। সোনারগাঁ, বাজিতপুর ও জঙ্গলবাড়ি থেকে যেত সাদা কাপড়। ১৭৪৭ সালেও বাংলার বস্ত্র বাণিজ্যের মোটামুটি চিত্র ওঠে এসেছে। ইংরেজ ও পর্তুগিজদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ফরাসিরাও বাংলায় বস্ত্র বাণিজ্যে যুক্ত হয়েছিল। ওলন্দাজরা ১৬৬৩ সালে ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় কুঠি স্থাপন করে। ফরাসিরা ঢাকার নায়েবে নাজিমের কাছ থেকে একটা গঞ্জ বসানোর অনুমোদন নেয়। যেটা প্রথমে ফ্রেঞ্চগঞ্জ ও পরে ফরাশগঞ্জ হিসেবে পরিচিতি পায়। বাংলার তাঁত শিল্পের কদর ইউরোপে বেশি ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলার কাপড় ছিল প্রভাবশালী। উইলিয়াম মিলবার্নের ওরিয়েন্টাল কমার্স বইতে বাংলা থেকে যুক্তরাজ্যে যাওয়া বস্ত্র সম্পর্কে একটা ধারাবাহিক বিবরণী আছে। ১৭৬৫ সালে বাংলার দিওয়ানি লাভের পর অতিরিক্ত কর ও একচেটিয়া বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য তাঁত শিল্পের অবনতি ঘটতে থাকে। তাঁতিরা বাস্তুচ্যুত হতে থাকেন। কেউ ত্যাগ করতে থাকেন পেশা। তার পরও উনিশ শতকজুড়ে বাংলার তাঁত শিল্প সুনাম ধরে রেখেছিল। 

আধুনিকায়নের তোপে পোশাকের রুচিতে পরিবর্তন এলেও শাড়ি এখনো বাংলা অঞ্চলের প্রিয় পোশাক। মধ্যযুগে প্রথমবার মা হওয়া উপলক্ষে নারীরা যে শাড়ি পরিবার থেকে উপহার পেতেন, তার নাম ছিল ‘অধ্যয়া’। এ শাড়ি হতো লাল রঙের। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পরা হতো নীল শাড়ি, যার নাম ছিল ‘ব্রশতী’। কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘দোছটী করিয়া পরে বার হাত শাড়ি’-এ কথায় মহিলাদের বস্ত্রের দৈর্ঘ্য বোঝা যায়। এছাড়া মনসামঙ্গল বা পদ্মপুরাণের অন্যতম কবি বিজয়গুপ্ত মনসার গোয়ালিনী রূপের সজ্জার যে বিবরণ দিয়েছেন, সেখানেও পাওয়া যায় শাড়ির উল্লেখ। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম তার কাব্যে বিভিন্ন ধরনের শাড়ির কথা তুলে এনেছেন; যাদের মধ্যে সুরঙ্গ পাটের শাড়ি, তসরের শাড়ি, ক্ষীরোদক শাড়ি, খুঞার ধুতি ও খুঞার শাড়ি অন্যতম। পনেরো-ষোলো শতাব্দীতে বাংলার নারীদের শাড়ি ব্যতীত ঊর্ধ্বাঙ্গে তেমন কোনো বস্ত্রের প্রচলন ছিল না বলেই মনে করা হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত বাংলার টেরাকোটা মন্দিরগুলোর অলংকরণেও অনেক নারীকে উর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত রেখে নিচে কোঁচা দেয়া ধুতি পরতে দেখা যায়। কাঁচুলির প্রচলন সম্ভবত মুসলমান আমলে। মোগল যুগে বাঙালি মেয়েরাও কাঁচুলি ব্যবহার করতেন। ব্রিটিশ আমলে নারীরা অন্তঃপুর থেকে বের হওয়া শুরু করেন। ব্রিটিশদের রীতি অনুসরণ করতে গিয়ে পরিবর্তন আসতে থাকে নারীর শাড়িতে। ১৮২২ সালে ফ্যানি পার্কস কলকাতা ভ্রমণ করে বাঙালি নারীদের পাতলা, স্বচ্ছ শাড়ির বিষয়টি পর্যবেক্ষণ ও তার লেখায় উল্লেখ করেছেন। উনিশ শতকের শেষ দিকে লাগে পরিবর্তনের ছোঁয়া। নারীরা নিজেদের পশ্চিমা পোশাক, বিশেষত গাউনে সজ্জিত করলেন। বিশ শতকের প্রথম ভাগে শাড়ির আরো পরিশীলিত রূপ চালু হয়ে গেল।

ইতিহাসের পুরো সময় বাংলা ছিল বস্ত্রের কেন্দ্র। শিল্পবিপ্লবের পর ক্রমে ঢাকা, কাপাসিয়া, সোনারগাঁও, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, নোয়াখালী, কুষ্টিয়া, খুলনা ও কুমিল্লা প্রসিদ্ধি অর্জন করে কাপড়ের জন্য। গোলাম হোসেন সলীমের লেখা ‘রিয়াজুস সালাতিন’ গ্রন্থে সোনারগাঁয় মসলিন উৎপাদন হতো বলে উল্লেখ আছে। সাদুল্লাপুর, নিশ্চিন্তপুর, আমিনপুর জেলায় বিখ্যাত ‘পাবনাই পাড়’ কাপড় তৈরি হতো। সুনাম অর্জন করেছিল কুমারখালী ও সাতক্ষীরার শাড়িও। মগ রমণীদের সুতি ও রেশমি বস্ত্রবয়নের কথা লেখা আছে হান্টার ও বার্ডউডের বইয়ে। এখানকার মসলিন ও জামদানির খ্যাতি তো অনেক আগে থেকেই বিশ্বজোড়া। সুতিবস্ত্রের মতোই বিখ্যাত হয়েছিল বাংলার রেশমি বস্ত্র। ১৮৪০ সালে বস্ত্রশিল্প যখন ধ্বংসের মুখে তখনও ঢাকায় ৩৬ রকমের কাপড় বোনা হতো। ক্রমে যান্ত্রিক উৎপাদনের প্রসার ও নানা জটিলতায় তাঁত শিল্প সীমিত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সব পরিবারের নারীরা শাড়ি পরেন। যদিও শাড়ি পরার ধরন এবং শাড়ির মানের মধ্যে ব্যবধান অনেক। বিষয়টি পরিবারের আর্থিক সংগতি, সামাজিক প্রতিপত্তি ও ব্যক্তিগত রুচিবোধের ওপর নির্ভর করে। বর্তমান বাজারে হরেক রকমের শাড়ির আবির্ভাব ঘটেছে। শাড়ির তালিকায় রয়েছে বেনারসি, জামদানি, সিল্ক, তাঁত, মিল, সুতি, জর্জেট, শিফন, টাঙ্গাইল, পাবনাই, ঢাকাই ও অন্যান্য নাম। রয়েছে বাটিক, বুটিক, টাই-ডাই, ব্লক-প্রিন্ট, ফেব্রিক, নকশি কাঁথাসহ হাজারো রকম শাড়ি। সাধারণত আটপৌরে ব্যবহার্য শাড়িগুলো হয় সুতির ও জর্জেটের। কাতান, জামদানি, সিল্ক, বেনারসি হয় অনুষ্ঠানে পরার জন্য। অবশ্য সেক্ষেত্রেও আর্থিক সংগতির বিষয়টিই অনেকাংশে নির্ভর করে। বিয়ে, বৌভাত, মেহেদি অনুষ্ঠান, গায়ে হলুদ ইত্যাদি অনুষ্ঠানে শাড়িই থাকে প্রধান পোশাক। বিয়ের অনুষ্ঠানে কনেকে উজ্জ্বল রঙের বেনারসি কিংবা কাতান শাড়ি পরিয়ে সাজানো হয়। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে ছেলে পক্ষ ও কনে পক্ষ একই রঙের অথবা সম্ভব হলে দুই রঙের বাহারি শাড়িতে নিজেদের সাজাতে চান। মিলাদ মাহফিল, ওয়াজ মাহফিল, ঈদুল আজহা, ঈদুল ফিতর, শবে বরাত, শবে কদর প্রভৃতি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পরা হয় সাদা, হালকা ও ধূসর রঙের শাড়ি। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে যেকোন ধরনের উজ্জ্বল শাড়ি পরার রেওয়াজ এখনো আছে। বাংলা নববর্ষ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও একুশে ফেব্রুয়ারির মতো দিনে থাকে বিশেষ ধরনের শাড়ি। বাংলা নববর্ষে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরার রীতি দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত, অন্যদিকে একুশে ফেব্রুয়ারিতে কালো পাড়ের সাদা শাড়ি পরা হয়। 

বর্তমানে বাংলাদেশী শাড়ির মধ্যে তাঁতের শাড়িই প্রধান, পাশাপাশি ব্যবহৃত হচ্ছে মিলের শাড়িও। মসলিন এতকাল প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গেলেও বর্তমানে নতুন আঙ্গিকে কিছু মসলিন তৈরি হচ্ছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জামদানিতেও আনা হয়েছে বৈচিত্র্য ও নিত্যনতুন নকশা। দেশের প্রায় সব জায়গায়ই শাড়ি তৈরি হচ্ছে তাঁতে ও মিলে। নতুন রূপে হাজির হচ্ছে টাঙ্গাইল ও পাবনার তাঁতের শাড়ি। যদিও শাড়ি কেবল বাঙালি নারীর পরিধেয় নয়, তবু বর্তমানে বিশেষভাবে বাঙালি রমণীর পোশাক হিসেবেই শাড়ি বেশি পরিচিত। অতিপ্রাচীন কাল থেকেই শাড়ি পরিণত হয়েছে বাংলার স্বতন্ত্র পরিচয়ে। 


আহমেদ দীন রুমি: লেখক