লাওকুন থেকে রাফায়েল ভ্যাটিকানের দুর্লভ ভাণ্ডার

রুহিনা ফেরদৌস

স্কুল অব এথেন্স ছবি: লেখক

রোমা তেরমিনি স্টেশনের বাইরে পা রেখেই মনে হলো ভুল করে ঢাকার আশপাশের কোনো শহরে চলে এসেছি কিনা! চারপাশে চলছে নির্মাণকাজ। স্টেশনের উল্টো দিকের খাবারের দোকানগুলোর সামনে দেখছি নানরুটি আর কাবাবের ছবি। দুই-একজনকে আবার বাংলায় কথা বলতেও শুনলাম। বাহ্! বেশ তো! গুগল ম্যাপের নির্দেশ মেনে আমি আমার হোটেলের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। ১০-১৫ মিনিটের পথ। পৌঁছে দেখলাম এ হোটেলের উল্টো দিকেও চলছে রাস্তা সংস্কার। তবে কোনো শব্দ, দূষণ বা শোরগোল নেই।

আমার ভ্যাটিকান মিউজিয়ামে যাওয়ার টিকিট ২৭ জুনের। দুঃসংবাদটা শুনলাম আগের রাতে। কানাডিয়ান রুমমেট সেদিনই ভ্যাটিকান দেখে ফিরেছে। ভীষণ উচ্ছ্বসিত। তবে মন খারাপ করে জানাল, বিশেষ জুবিলি উপলক্ষে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দর্শনার্থীরা পিয়েতাকে দেখতে পাবে না। হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল। আমার ভ্যাটিকান দেখার আগ্রহের প্রথম দুটি কারণের একটি পিয়েতা।

তাছাড়া ফ্লোরেন্সে মাইকেলেঞ্জেলোর ডেভিড দেখার ঘোর তখনো কাটেনি। ডেভিড না পিয়েতা—কোনটি মাইকেলেঞ্জেলোর সেরা সৃষ্টি? নাকি সিসটিন চ্যাপেলের মানব ইতিহাসের আদি ও অন্তিমের মহাজাগতিক ম্যুরাল এঁকে রেখেছেন, তা?

শুনলাম, নানা কারণেই এবারের জুবিলি বিশেষ। প্রতি ২৫ বছর পর পর পবিত্র বছর উপলক্ষে লাখ লাখ মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে রোম ও ভ্যাটিকানে আসে। ২০২৫ সালের এবারের জুবিলির শুরুটা হবে আগামী ২৪ ডিসেম্বর থেকে। এ সময় রোম ও ভ্যাটিকানের গির্জাগুলো বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও প্রার্থনার আয়োজন করে। তবে জুবিলি কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়, রোম শহরের পর্যটন ও সংস্কৃতির জন্যও বড় আয়োজন হিসেবে দেখা হয়। যেহেতু অসংখ্য তীর্থযাত্রী জুবিলিতে অংশ নিতে আসবেন, তাই রোম ও ভ্যাটিকানে চলছে রাস্তা মেরামত, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার আর ঐতিহাসিক শিল্পকর্ম, স্থাপনা সংরক্ষণ ও সুরক্ষার কাজ। বিশেষ করে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা আর মাইকেলেঞ্জেলোর পিয়েতার সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদারের কাজ চলছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। 

তাছাড়া ৫২ বছর আগের দুর্ঘটনার কথাও ভ্যাটিকান ভোলেনি। ১৯৭২ সালে মানসিকভাবে অসুস্থ একজন অস্ট্রেলিয়ান দর্শনার্থী মাইকেলেঞ্জেলোর পিয়েতার ওপর হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করায় ভাস্কর্যের কিছু অংশ, বিশেষ করে মেরির নাক ও হাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলো মেরামত করা হলেও দুর্ঘটনার দাগ মোছেনি।

এ ঘটনার পর থেকেই পিয়েতাকে অতিরিক্ত নিরাপত্তা সুরক্ষায় রাখা হয়েছে। সংরক্ষণের স্বার্থে মাঝে মাঝেই প্রদর্শনী থেকেও সরিয়ে নেয়া হয় এটি। সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা ও ভাস্কর্যটির ভঙ্গুর অবস্থা বিবেচনা করেই নেয়া হয় এ ব্যবস্থা। জুবিলি উপলক্ষে শাটার ও বুলেটপ্রুফ নয়টি কাচের প্যানেল দিয়ে তৈরি একটি সুরক্ষা চাদরে মোড়ানো থাকবে পিয়েতা। তবে নকশা এমনভাবে করা হচ্ছে পিয়েতাকে স্পস্টভাবে দেখতে যেন কারো অসুবিধা না হয়।

আমি একটু তাড়াহুড়ো করছি। ভ্যাটিকানে আমার গাইডেড গ্রুপ ট্যুর। ঠিক সময়মতো লাইন ধরে ঢুকতে না পারলে ট্যুর শুরু হয়ে যাবে। এদিকে নিজেকে সামলাতে না পেরে পথে পাওয়া বিয়ালেত্তির কফির শো রুমে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে দিয়েছি। একদম কাঁটায় কাঁটায় এসে পৌঁছলাম। শুরু হলো আমার ভ্যাটিকান যাত্রা।

মূল মিউজিয়ামে ঢোকার আগে চোখে পড়বে ইতালিয়ান ভাস্কর আরনাল্ডো পোমোদোর গোলকের মধ্যে গোলক নামের একটি ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য। আধুনিক ভাস্কর্যটির বিশেষত্ব হচ্ছে এটাকে আপনি চাইলে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে পারেন। তবে এখানে বেশি সময় ব্যয় না করে আমাদের গাইড প্রথমে নিয়ে গেলেন ভ্যাটিকানের দুর্লভ সব ভাস্কর্য সংগ্রহ দেখাতে।

গ্রিক দেবী অ্যাথেনা খ্যাত প্রজ্ঞা, যুদ্ধ ও শিল্পের প্রতীক হিসেবে। গ্রিক ক্ল্যাসিক্যাল আর্টের অন্যতম ভাস্কর ফিডিয়াসের দেবী অ্যাথেনার দেখা পেলাম শুরুতেই। ভ্যাটিকান মিউজিয়ামের এ রুমে অ্যাথেনার পাথরের ভাস্কর্যসহ বেশকিছু উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে প্রাচীন গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর ভাস্কর্য। আলাদা করে বলতে হয় লাওকুন অ্যান্ড হিজ সনস বা লাওকুন ও তার পুত্রেরা, হারকিউলিসসহ রোমান দেবতা ও নায়কদের প্রাচীন সব প্রতিমূর্তি, যা দেখে রোমান সমাজ ও সাংস্কৃতির সময়গুলো ছোঁয়া যায়। এছাড়া অন্যান্য সংস্কৃতি, ভাস্কর্য; যা প্রাচীন সভ্যতার জীবনধারা আর ঐতিহ্যকে তুলে ধরে, এমন সব সংগ্রহের অনন্য ভাণ্ডার ধারণ করে আছে ভ্যাটিকান; যা দর্শককে বিভিন্ন সাংস্কৃতি, প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ধারণা দেয়।

এছাড়া ভ্যাটিকানের ভাস্কর্যগুলো বিভিন্ন শিল্পশৈলীর প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন ক্ল্যাসিক্যাল, হেলেনিস্টিক কিংবা রেনেসাঁ। আবার বিভিন্ন সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট মিলেমিশে আছে এতে। দেখতে দেখতে মনে হয় ভ্যাটিকান মিউজিয়ামের সংগ্রহগুলো শুধু শিল্পের নিদর্শন নয়, বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি আর মানবিক অভিজ্ঞতার প্রতীক।

প্রায় নয় মাইলের ভ্যাটিকানজুড়ে রয়েছে মাইকেলেঞ্জেলো, লিওনার্দো, রাফায়েল, জিওট্টো, পেরুজিনো ও কারাভাজ্জোসহ রেনেসাঁ যুগের বিখ্যাত শিল্পীদের মাস্টারপিস, মধ্যযুগীয় মানচিত্র ও ট্যাপেস্ট্রি আর বিখ্যাত কক্ষ—যেমন সিসটিন চ্যাপেল। এখানে ২৬টির মতো সংগ্রহশালা রয়েছে। বছরে ৪০ লাখেরও বেশি দর্শনার্থী দেখতে আসেন ভ্যাটিকান। ভ্যাটিকান জাদুঘর শুরু করেছিলেন পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস। তার সংগৃহীত ভাস্কর্য থেকেই ভ্যাটিকান মিউজিয়ামের সূচনা। এর সবচেয়ে পুরনো গ্যালারি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয় ১৭৭৩ সালে। পোপ চতুর্দশ ক্লেমেন্ত এ সিদ্ধান্ত নেন। পরে পোপ চতুর্থ পায়াস জাদুঘরকে আরো সম্প্রসারণ করেন। এরপর ভ্যাটিকান ক্রমে সমৃদ্ধ হতে থাকে।

বলা হয় প্রাচীন গ্রিক ভাস্কর্য শিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন লাওকুন ও তার পুত্ররা। হেলেনিস্টিক ভাস্কর্যটি ইতালির প্রাচীনতম ও সর্বাধিক আলোচিত নিদর্শনগুলোর একটি। এটি কে তৈরি করেছিলেন, কোথায় ও কখন তা নিয়ে এখনো প্রচুর বিতর্ক রয়েছে। ভাস্কর্যটি ট্রয় নগরের পুরোহিত লাওকুন ও তার দুই পুত্রের, যারা সাপের আক্রমণের শিকার হয়েছেন, লড়াই করছেন। একসময় রোমের সম্রাট টাইটাসের প্রাসাদে রাখা ছিল। দীর্ঘদিনের জন্য হারিয়ে যায়। শোনা যায় মাটির নিচে চাপা পড়া অবস্থা থেকে ভাস্কর্যটিকে উদ্ধার করা হয়েছে। মানুষের শরীরের নিখুঁত গড়ন আর নিখাদ যন্ত্রণার প্রকাশ যেন এটি। হাজার হাজার বছর আগে মানুষের হাতে এত জীবন্ত ও গতিশীল কিছু তৈরি হয়েছিল, যা সত্যিই বিস্ময়কর।

গাইড আমাদের জানালেন সিসটিন চ্যাপেলে ঢোকার আগে আমরা যাব রাফায়েল রুমে। সিসটিন চ্যাপেল বা রাফায়েল রুম ছাড়াও ভ্যাটিকানের উল্লেখযোগ্য প্রদর্শনী কক্ষের মধ্যে রয়েছে মানচিত্রের গ্যালারি, বোর্গিয়া অ্যাপার্টমেন্ট, নিকোলিন চ্যাপেল, পিনাকোথেকা আর্ট গ্যালারি, নিরোর স্নানাগার।

আমরা যাচ্ছি রাফায়েল রুমের দিকে। চারটি কক্ষ নিয়ে রয়েছে রেনেসাঁর এ শিল্পীর কাজ। কক্ষগুলো পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসের প্রাসাদে অবস্থিত। তার ব্যক্তিগত অ্যাপার্টমেন্টের অংশ ছিল। আমি মনে মনে খুঁজছি স্কুল অব এথেন্স। রাফায়েলের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজগুলোর একটি। শিল্পী যেখানে ৫২ জন গ্রিক দার্শনিককে একটি ক্যানভাসে ধারণ করেছেন। ফ্রেস্কো মাধ্যমের কাজটি রাফায়েল করেন ১৫০৯-১১ সালে। এটি রেনেসাঁ শিল্পের একটি চূড়ান্ত উদাহরণ। দর্শন, বিজ্ঞান, শিক্ষা, মানবতাবাদী চিন্তার উজ্জ্বল সংমিশ্রণ। স্কুল অব এথেন্সের দার্শনিকদের সমাবেশে বিভিন্ন যুগের মহান দার্শনিক, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, চিন্তাবিদদের হাজির করেছেন রাফায়েল। যেখানে প্রধান চরিত্র হিসেবে দেখা যায় প্লেটো আর অ্যারিস্টোটলকে। যারা রয়েছেন ক্যানভাসের কেন্দ্রে। প্লেটোর হাতে তাইমিয়াস (প্লেটোর সংলাপ নামের বইটি), ওপরের দিকে ইশারা করছেন তিনি। পাশেই আছেন অ্যারিস্টোটল, হাতে নিকোমেকিয়ান এথিকস। বই নিয়ে দুজনেই উচ্ছ্বসিত। যুবক দার্শনিকদের সঙ্গে আলাপে মগ্ন সক্রেটিস। বামদিকে পিথাগোরাস তত্ত্ব নিয়ে মশগুল। কম্পাস হাতে ইউক্লিড জ্যামিতির ছাত্রদের দেখাচ্ছেন কিছু একটা। আছেন ইতালির সাহিত্যিক দান্তে, রোমান কবি ভার্জিল, আর রাফায়েল নিজে। ভিড়ের মধ্যে মধ্যে মিশে থেকেও রাফায়েল সরাসরি তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে।

স্কুল অব এথেন্স স্রেফ একটি শিল্পকর্ম নয়; দর্শন ও প্রজ্ঞার প্রতীক। রাফায়েল তার কল্পনা ও কাজের মাধ্যমে সময়ের কালজয়ী চিন্তকদের মধ্যে একটি জাদুকরী সংযোগ তৈরি করেছেন, যা আধুনিক চিন্তার ভিত্তিও গড়ে দেয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন