দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি এখন বাংলাদেশে

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার

ছবি : বণিক বার্তা

নানা উদ্যোগেও বিগত সরকার দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। কারণ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুখে নানা উদ্যোগের কথা বললেও কাজকর্মে তার প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়নি সে সময়। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতাসহ তথ্য জালিয়াতি করে মূল্যস্ফীতির হার কম দেখানোর মতোও ঘটনা ঘটেছে। এ তথ্য জালিয়াতির জন্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোও (বিবিএস) অনেকাংশেই দায়ী। কেননা বিবিএস মূল্যস্ফীতির যে তথ্য প্রকাশ করেছে তার সঙ্গে বাজারের বিস্তর ব্যবধান লক্ষ করা গেছে। আমদানিসহ সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছে কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে। ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে দেশের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বিশেষত শ্রীলংকা ও পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ সফলতা দেখালেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে মূল্যস্ফীতি কমে আসার কথা। কিন্তু এখনো বাজারে তেমন প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। এর মূল কারণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখনো বাজারে সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। তবে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেগুলোর সুফল পেতে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নেয়া জরুরি। বাজার ব্যবস্থায় সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়ার পাশাপাশি সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধ করতে সরকারকে তৎপরতা বাড়াতে হবে। 

মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা খুবই জরুরি। কিন্তু দেশের বাজারে পণ্যের সরবরাহ ঠিক থাকলেও সিন্ডিকেটের প্রভাবে সাধারণ মানুষ বাজারে ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে পারছে না। সিন্ডিকেট করে কৃত্রিমভাবে পণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে। তাই বিবিএসের তথ্যের যথার্থতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অনেক দেশেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এসব দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বড় অর্থনীতির দেশগুলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে পারলেও বাংলাদেশ এখনো পারেনি। এছাড়া বাংলাদেশের প্রতিবেশী শ্রীলংকা, পাকিস্তান, নেপাল ও ভারত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। এর মধ্যে শ্রীলংকা অন্যতম। দেশটি বাজার সিন্ডিকেট ভাঙা ও সুশাসন নিশ্চিত করার কারণে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে পেরেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের জন্য শ্রীলংকা, ভারত ও নেপাল উদাহরণ হতে পারে। 

ডলারসহ অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাবে মূল্যস্ফীতি উসকে ওঠা দেশগুলোর একটি ছিল শ্রীলংকা। দুই বছর আগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটির মূল্যস্ফীতির হার ঠেকে ৭০ শতাংশে। বৈদেশিক দায় পরিশোধে ব্যর্থতায় নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করা দেশটির মূল্যস্ফীতি এখন ১ শতাংশেরও নিচে। গত আগস্টে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল দশমিক ৫ শতাংশ। ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক সে পরিস্থিতি দ্রুতই কাটিয়ে উঠছে শ্রীলংকা। পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতির হার দীর্ঘদিন ধরেই ছিল দুই অংকের ঘরে। অর্থনৈতিক সংকটে থাকা দেশটিতে ২০২৩ সালের আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ২৭ শতাংশেরও বেশি। কিন্তু গত মাসে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশে দাঁড়ায়। 

নব্বইয়ের দশকে কখনো কখনো মূল্যস্ফীতি বাড়লেও তা বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। এক বছর বাড়লেও পরের বছরই তা কমে গেছে। কিন্তু দুই বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিদ্যমান। নব্বইয়ের দশকে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর সর্বনিম্ন ছিল ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে ২ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এর পরের দশকের শুরুতে ২০০০-০১ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ছিল ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ। ওই দশকে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। গত দশকে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি দেখা গেছে ২০১১-১২ অর্থবছরে, যার হার ছিল ১০ দশমিক ৬২ শতাংশ। আর সর্বনিম্ন ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ ছিল ২০১৬-১৭ অর্থবছরে। চলতি দশকের প্রথম দুই অর্থবছর ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ৫৬ ও ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরেই তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আগস্টে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে উঠেছিল। যদিও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

দেশে মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ অর্থ পাচার ও বাজার সিন্ডিকেট। এছাড়া ব্যাংক খাতে অস্বাভাবিক খেলাপি ঋণ, ব্যাংক লুটপাট, ব্যয়বহুল প্রকল্প বাস্তবায়ন, ডলার ও রিজার্ভ সংকটে দেশের অর্থনীতি নাজুক হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক এ সংকটের মধ্যেও সরকারের ব্যয় কমেনি, বরং বেড়েছে। এ অর্থ সংস্থানে নির্ভরতা বাড়াতে হয়েছে দেশীয় ও বিদেশী ঋণের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা ছাপানোর মতো পদক্ষেপে বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়ায় টাকা মূল্যমান কমে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। 

বিগত সরকারের শাসানামলে দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। সরকারের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির বর্ণনার প্রচারের কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম বিবিএস। সংস্থাটিকে ব্যবহার করে জনসংখ্যা, জিডিপির আকার-প্রবৃদ্ধি থেকে শুরু করে অর্থনীতির প্রতিটি খাতেই ভুল ও প্রশ্নবিদ্ধ পরিসংখ্যান তৈরি ও উপস্থাপন করা হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পরও বিবিএস থেকে মূল্যস্ফীতির যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে সেটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পরও আগস্টে মূল্যস্ফীতি কমে যাওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক। এজন্য বিবিএসকে ঢেলে সাজানোসহ সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশে সরকারের পদক্ষেপ নেয়া দরকার। কেননা যেকোনো সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সঠিক পরিসংখ্যান অত্যাবশ্যকীয়। আশা করি, সরকার এ বিষয়ে গুরুত্ব দেবে। 

সিন্ডিকেট ভেঙে সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করে দ্রুততম সময়ে বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরানো জরুরি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনে দেশের সাধারণ জনগণকে স্বস্তি দিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তৎপরতা বাড়াতে হবে। এটি না করে শুধু অভিযান পরিচালনা কিংবা অন্য কোনো পদক্ষেপে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না। বাজারে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীর তৎপরতা আমরা 

দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষ করছি। সরকার পরিবর্তনের পর সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয় রয়েছে। কেবল ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে। তাই বাজারে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার। বাজারে খাদ্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখার পাশাপাশি প্রয়োজনে আমদানিকারকের সংখ্যা বাড়িয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন