আরলার মান বজায় রেখেই বাংলাদেশের কারখানায় চলে গুঁড়া দুধের প্যাকেজিং

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি: আরলা ফুডস বাংলাদেশ লিমিটেড

আরলা ফুডস বাংলাদেশ লিমিটেড পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম বহুজাতিক ডেইরি কোম্পানি আরলা ফুডসের বাংলাদেশস্থ অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। যদিও এ প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড “ডানো”-এর গুঁড়া দুধ ১৯৬১ সাল থেকে এই অঞ্চলের বাজারে পাওয়া যায়, তবে আরলা ফুডস বাংলাদেশ লিমিটেড ২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে দেশে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাংলাদেশে আরলা ফুডসের স্থানীয় সহযোগী হিসেবে কাজ করছে মিউচুয়াল গ্রুপ।

এদেশে আরলা ফুডসের সবচেয়ে জনপ্রিয় পণ্য 'ডানো' গুঁড়া দুধের ইতিহাসের শুরুটা ছিল ডেনমার্কভিত্তিক খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘এমডি ফুডস’-এর একটি পণ্য হিসেবে। শুরুতে কিছু বড় ব্যবসায়ীর হাত ধরে বাংলাদেশের বাজারে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) পৌঁছানোর পর খুব দ্রুতই ভোক্তার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায় ডানো। দেশের বাজারের অব্যাহত চাহিদা মেটাতে আশির দশকের শেষ ভাগে বাংলাদেশে নিজেদের লিয়াজোঁ অফিস খোলে এমডি ফুডস। তখন ডানোর একমাত্র আমদানিকারক হিসেবে লাইসেন্স পায় মিউচুয়াল ট্রেডিং লিমিটেড। চাহিদা বাড়ায় পরে বাংলাদেশেই স্থাপিত হয় গুঁড়া দুধের প্যাকেজিং কারখানা। ডেনমার্কে উৎপাদিত গুঁড়া দুধ সরাসরি চলে আসে গাজীপুরে, সেখানেই গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন আকারের প্যাকেটে পূর্ণ করা হয় দুধ। 

পরে এমডি ফুডসের সঙ্গে সুইডেনের আরলা কো-অপারেটিভের একীভবন ঘটলে উভয়ে একত্রে আরলা ফুডস নামে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ শুরু করে। আরলার বৈশ্বিক গুণগত মান বজায় রেখেই বাংলাদেশের কারখানায় চলে গুঁড়া দুধের প্যাকেজিং।

গাজীপুরের এই কারখানায় প্রাথমকিভাবে রি-প্যাকেজিং করা হলেও সম্প্রতি ইউএইচটি দুধ উৎপাদন করা হচ্ছে। ইউএইচটি দুধ উৎপাদনের অংশটি এই বছরের ৬ জুন উদ্বোধন করা হয়। সর্ম্পূণ কারখানাটি প্রায় ২ দশমিক ৫ একর জমির ওপর অবস্থিত। কারখানায় বর্তমানে কোনো বিদেশী কর্মী কাজ করছেন না, বরং সম্পূর্ণ দেশীয় দক্ষ কর্মীর মাধ্যমে আরলা ফুডসের পণ্যের আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করা হচ্ছে। 

আরলা ফুডস প্রতিশ্রুতিবদ্ধতার পরিচয় ধরে রেখে এফএসএসসি ২২০০০ (ভার্সন ৫ দশমিক ১) এবং আইএসও ৯০০১:২০১৫ সনদপ্রাপ্ত বর্তমান ফ্যাক্টরিটি নিরাপদ এবং পুষ্টিকর দুগ্ধজাত পণ্য সরবরাহ করছে। 

উল্লেখ্য, কারখানাটির বার্ষিক ৪০ লাখ লিটার পানি সাশ্রয় এবং ২২০ টন কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের সক্ষমতা রয়েছে। পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের এ উদ্যোগ। এছাড়া কারখানার আধুনিক বর্জ্য পানি শোধনাগারটি মেমব্রেন বায়ো রি-অ্যাক্টর প্রযুক্তি ব্যবহার করে ৮০-৮৫ শতাংশের বেশি রাসায়নিক নিঃসরণ হ্রাস করবে। কারখানা সংলগ্ন জনপদের নিরাপত্তায় পানি শোধনাগারটি যেন কোনো রকম গন্ধ নিঃসরণ না করে তা নিশ্চিত করা হয়েছে। বর্জ্য পানি শোধনাগারটি পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্ধারিত মান অনুযায়ী বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড ও টোটাল সাসপেন্ডেড সলিডের মাত্রা ১০-এর নিচে বজায় রাখে। 

ভোক্তাদের নিরাপত্তা এবং শতভাগ নিরাপদ পণ্য নিশ্চিত করতে অ্যাসেপটিক স্টেরাইল সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে কারখানায়। ভবিষ্যতে ফ্যাক্টরিতে টেকসই সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বার্ষিক ৪০৫ টন কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছে আরলা ফুডস বাংলাদেশ।   

প্রাথমিকভাবে সর্বোত্তম কার্যকারিতা ও সক্ষমতা নিশ্চিত করতে আরলা ফুডস বাংলাদেশ তাদের পুরো কারখানাকে আরলার বৈশ্বিক মাপকাঠিতে ঢেলে সাজিয়েছে। স্থাপনার গঠনের সঙ্গে মিল রেখে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং সর্বোত্তম সুরক্ষা নিশ্চিত করে কারখানার কার্যক্রম পরিচালনা নিশ্চিত করা হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো হাইড্রেন্ট লাইনসহ অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা।

আরলা ফুডস বাংলাদেশের ফ্যাক্টরিতে দুটি অত্যাধুনিক বিশেষায়িত ইউনিটের মাধ্যমে কার্যক্রম পরচিালনা করা হয়। প্রথম ইউনিটটি ব্যবহার করা হয় পাউডার ফিলিং এবং প্যাকেজিংয়ের জন্য। প্যাক সাইজের ওপর ভিত্তি করে জার্মান প্রযুক্তির মেশিন হাসিয়া-রেডাট্রন অথবা রোভেমা মেশিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

দ্বিতীয় ইউনিটটি ব্যবহৃত হয় ইউএচটি (আল্ট্রা হাই টেম্পারেচার) প্রক্রিয়াকরণের জন্য। পণ্যের মান ধরে রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ আরলা ফুডসের 'ডানো' ব্র্যান্ড টানা নয় বছর সেরা মিল্ক ব্র্যান্ড হিসেবে সম্মাননা লাভ করেছে।

প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আরলা ফুডস বাংলাদেশ তার কর্মীদের জীবনমান উন্নয়ন এবং সুরক্ষায় অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। এর আওতায় কারখানার কর্মীদের জন্য রয়েছে স্বাস্থ্য বীমা ও চিকিৎসার খরচ প্রদান, যথাযথ মাতৃত্ব ও পিতৃত্বকালীন ছুটি এবং স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করার সুবিধা। প্রয়োজনে কর্মীরা তাদের বাসা থেকে হোম অফিস সুযোগ নেয়ার মাধ্যমে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী কাজ করতে পারেন। শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নানা সহযোগিতা ও সুবিধা দেয়া হয় কর্মীদের। ফ্যাক্টরিতে কর্মরতদের জন্য সুরক্ষামূলক প্রস্তুতি ও পোশাক ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয় পালনীয় হিসেবে গুরুত্ব দেয়া হয় এবং তাদের কর্মস্থল থেকে বাসায় যাওয়া-আসার সুবিধার্থে পরিবহন ব্যবস্থাও রয়েছে। 

আরলা ফুডস তাদের সব কর্মীর প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত জীবনের মাঝে সামঞ্জস্য বজায় রাখার জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। কর্মীদের মাঝে মেলবন্ধন সৃষ্টি এবং কাজের যথাযথ স্বীকৃতি প্রদানে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বার্ষিক “সেফটি ডে”, “অ্যানুয়াল রিকগনিশন”, “ফ্যামিলি ডে”, “ফ্যাক্টরি পিকনিক” এবং ”ওয়ার্ল্ড ফুড সেফটি ডে”-এর আয়োজন করা হয়। এছাড়া কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানো এবং আত্মোন্নয়নে দেশে-বিদেশে অনলাইন বা অফলাইন নানা প্রশিক্ষণের সুযোগ দেয়া হয়।

আরলা ফুডসের ইতিহাস শত বছরেরও বেশি পুরনো। ১৮৮০-এর দশকে প্রায় একই সময়ে ডেনমার্কে এবং সুইডেনে বড় বড় ডেইরি ফার্মগুলো একীভূত হয়ে ব্যবসা করতে শুরু করে। এই ফার্মগুলো ছিল সম্পূর্ণ খামারিদের মালিকানায়। সেই থেকে সময়ের আবর্তে সুইডিশ আরলা কো-অপারেটিভ আর ড্যানিশ এমডি ফুডস একত্র হয়ে আরলা ফুডসে পরিণত হলেও বদলায়নি মালিকানার ধরন, এটি এখনো সম্পূর্ণরূপে খামারিদের মালিকানাভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। পনির, মাখন, ইউএইচটি, দই, গুঁড়া দুধসহ অনেক পণ্য রয়েছে আরলার। ডানো ছাড়াও আরলার কিছু জনপ্রিয় ব্র্যান্ড রয়েছে যেমন—লুরপাক, ক্যাস্টেলো, পাক, এপেটিনা, কোকিও ইত্যাদি।

স্ক্যান্ডিনেভিয়ান বহুজাতিক কোম্পানি আরলা বাংলাদেশে এসে যেন বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানেই পরিণত হয়েছে। আরলার পণ্য হলেও বাংলাদেশে ‘ডানো’ ব্যান্ড নামটির বিপুল জনপ্রিয় হওয়ায় ডানোই বাংলাদেশে আরলার প্রতিচ্ছবি। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন