টিকে গ্রুপ আজ সুপরিচিত ‘‌ফাস্ট মুভার’

রাশেদ এইচ চৌধুরী

ছবি: টিকে গ্রুপ

পণ্যের মান তৈরি করার সময় একটি পার্থক্য গড়ে দেয়ার মিশন নিয়ে দুই ভাই মোহাম্মদ আবু তৈয়ব ও মোহাম্মদ আবুল কালাম মিলে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন টিকে গ্রুপ। টিকে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছেন মোহাম্মদ আবুল কালাম। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ভোগ্যপণ্য আমদানির মধ্য দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও ৫২ বছরে পা দেয়া দেশের শীর্ষস্থানীয় এ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এখন উৎপাদনমুখী কারখানার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে অর্ধশতাধিক। ১৯৮৩ সালে সয়াবিন তেল আমদানি হতো পরিশোধিত আকারে। সরকার থেকে লাইসেন্স বা নিবন্ধন নিয়ে কালুরঘাটে গড়ে তোলেন টিকে অয়েল রিফাইনারি। দুই দশকে ভোজ্যতেলের বাজারে শীর্ষে থেকে অনেকেই ছিটকে পড়লেও এ উত্থান-পতনে আজও শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে টিকে। শুধু পরিশোধনের কারখানা নয়, নারায়ণগঞ্জে সয়াবিন বীজ মাড়াই করে তেল ও প্রাণিখাদ্য উৎপাদনের কারখানায়ও বিনিয়োগ করেছে গ্রুপটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান। ভোজ্যতেল ছাড়াও গড়ে তুলেছে আটা-ময়দার কারখানা। পুষ্টি ব্র্যান্ড নামেই ভোজ্যতেল ও আটা-ময়দা বাজারজাত করছে গ্রুপটি। পণ্য বিপণন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে গ্রুপের শিল্পে এখন রয়েছে চা বাগান, ভোজ্যতেল শোধনাগার, রাসায়নিক কারখানা, কাগজ কারখানা, কণা বোর্ড কারখানা, চামড়া প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট, ভোক্তা ব্র্যান্ড, সিমেন্ট কারখানা, টেক্সটাইল, সুতাসহ আরো পণ্য। ব্যবসা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আজ অর্ধশতাধিক উৎপাদন ইউনিটে ছয় হাজার কর্মী একসঙ্গে কাজ করছেন। কেবল আকারেই নয় বৈচিত্র্যের প্রসার হয়েছে গ্রুপটির। পণ্যের পোর্টফোলিওতে ভোজ্যতেল, ময়দা, চা, সিমেন্ট, রাসায়নিক, কাঠের বোর্ড, হ্যাচারি থেকে শিপ বিল্ডিংয়ের মতো পণ্যসামগ্রী যুক্ত হয়েছে। প্রতিষ্ঠনটির সাফল্যের গল্পটি আজ বিশাল আকার ধারণ করে ব্যবসার জগতে সুপরিচিতি পেয়েছে ‘‌ফাস্ট মুভার’ হিসেবে।

৫০ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের গ্রুপটির বার্ষিক টার্নওভার এখন ১৮ হাজার কোটি টাকা। তবে সহযোগী প্রতিষ্ঠানের হিসাব ধরা হলে টার্নওভারের পরিমাণ আরো বাড়বে।

আজও গ্রুপের লক্ষ্য হলো ৫ পি পরিবেশন করে বিভিন্ন ব্যবসায় নেতৃত্ব নিশ্চিত করা। এগুলো হলো পিপল, পোর্টফোলিও, পার্টনার, প্রফিট ও প্রডাক্টিভিটি। লক্ষ্য অর্জনের পথে অবিচল থাকার জন্য মেনে চলা হয় নিজস্ব মূল মূল্যবোধগুলোকে। প্রতিষ্ঠনের কর্মীরা বিশ্বাস করে প্রতিটি অপারেশনে স্বচ্ছতা, পরিবর্তনের দিকে অভিযোজনযোগ্যতা, একটি সক্ষম পরিবেশ সৃষ্টি ও শ্রেষ্ঠত্বর জন্য সাফল্য।

শুরুর গল্প

মোহাম্মদ আবু তৈয়ব ও মোহাম্মদ আবুল কালামের বাবা মীর আহমেদ সওদাগর একসময় মিয়ানমারের রেঙ্গুনে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। সেখান থেকে চট্টগ্রামের চাক্তাই ফিরে আসেন। প্রথমে সেখানে দোকান খোলেন। এরপর ১৯৭২ সালে তার ছেলে মোহাম্মদ আবুল কালামকে ধান বিক্রির টাকা দেন ব্যবসার জন্য। ধান বিক্রির ১ হাজার ৮০০ টাকা হাতে নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন আবুল কালাম। ধীরে ধীরে খাদ্যশস্যের সঙ্গে বাণিজ্যের তালিকায় যুক্ত হয় ভোজ্যতেল ও মসলা। সঙ্গে ছিলেন বড় ভাই মোহাম্মদ আবু তৈয়ব। পরবর্তী সময়ে খাতুনগঞ্জে ট্রেডিং ব্যবসায় লাভ হতে থাকলেও শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার কথা ভাবতে থাকেন তারা। ১৯৮০-এর দশকে কাঠের বিকল্প পরিবেশবান্ধব পার্টিকেল বোর্ড তৈরির লক্ষ্য কালুরঘাটে গড়ে তোলেন টিকে পার্টিকেল বোর্ড মিলস। টিকে কারখানা করার পর থেকে এখন পর্যন্ত পার্টিকেল বোর্ডে নেতৃত্ব দিচ্ছে টিকের সুপার বোর্ড। দেশে মোট পার্টিকেল বোর্ডেরও সবচেয়ে বড় অংশ উৎপাদন হচ্ছে এ গ্রুপের কারখানায়। ১৯৮৩ সালে সয়াবিন পরিশোধনের কারখানা গড়ে তোলার লাইসেন্স নিয়ে প্রায় ১০০ টন পরিশোধনক্ষমতার কারখানা গড়ে তোলে টিকে গ্রুপ। টিকে অয়েল রিফাইনারি নামে ১৫০ জন কর্মী নিয়ে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে শুরু হয় এ যাত্রা। বেসরকারি খাতে বড় আকারের প্রথম কারখানা ছিল এটি। সয়াবিন পরিশোধনের কারখানার পর কাছাকাছি সময়ে ১৯৮৩ সালে টিকে রি-রোলিং মিলস নামের কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করলেও রডের পরিবর্তে ঢেউটিনে বিনিয়োগ করে তারা। পরে ১৯৮৭ সালে ফৌজদারহাটে গড়ে তোলা হয় ঢেউটিন তৈরির কারখানা এনআর স্টিল গ্যালভানাইজিং। বর্তমানে গ্রুপের দুটি কারখানায় ঢেউটিন উৎপাদন করে ঈগল ব্র্যান্ডের নামে বাজারজাত করছে গ্রুপটি। একসময় ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকেই শুধু এলপিজি সরবরাহ হলেও ১৯৯১ সালে এলপিজি রাখার সিলিন্ডার উৎপাদনের কারখানা গড়ে তোলে টিকে গ্রুপ। ভোজ্যতেল ও জ্বালানি পণ্য লুব্রিকেন্ট রাখার জন্য গড়ে তোলে বাংলাদেশে প্রথম ড্রাম কারখানা। ১৯৯১ সালে চিটাগাং সিমেন্ট ক্লিংকার অ্যান্ড গ্রাইন্ডিং কারখানা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হলে দরপত্রের মাধ্যমে টিকের নিয়ন্ত্রণে কারখানাটি আসে ১৯৯৩ সালে। সিমেন্ট শিল্পে ছাতকের পর দ্বিতীয় কারখানাটি ১৯৭৩ সালে চালু হওয়ার পর অবশ্য ২০০০ সালে হাইডেলবার্গ সিমেন্টের হাতে যায়। তবে টিকে গ্রুপ পরে যৌথ অংশীদারত্বে বিনিয়োগ করে প্রিমিয়ার সিমেন্ট কারখানায়। ট্যানারি শিল্পে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত রিফ লেদার কারখানাটি চামড়া প্রক্রিয়াকরণের প্রথম ধাপ ‘ওয়েট ব্লু’ ক্যাটাগরিতে প্রথম বৈশ্বিক মানসনদ অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান। পরে দ্বিতীয় ধাপে ‘‌ক্রাস্ট’ ও তৃতীয় ধাপে ‘ফিনিশড’ তিনটিতেই মানসনদ পায় কোম্পানিটি। আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোয় চামড়া রফতানি হচ্ছে রিফ লেদারের। নব্বইয়ের দশকেই চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বারমাসিয়া চা বাগান দিয়ে পথচলা এ খাতে। এরপর যুক্ত হয় আরো দুটি বাগান। পুষ্টি ব্র্যান্ড ও রাঙাপানি ব্ল্যাক টি নামে বাজারজাত হচ্ছে টিকের চা। একই বছরেই গড়ে তোলা হয়েছে টিকে কেমিক্যাল কমপ্লেক্স নামের কাগজের কারখানা। ২০০৩ সালে সোয়েটার কারখানায় সরবরাহের জন্য বাংলাদেশে প্রথম অ্যাক্রিলিক সুতা তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করে নাম লেখায় টেক্সটাইল খাতে। চীন হুং ফাইবার্স লিমিটেড নামের এ কারখানায় প্রতিদিন ৬০ টনের বেশি বিভিন্ন ধরনের সুতা উৎপাদন হয়।

২০০৫ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্শাল স্কুল অব বিজনেসে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর ২০০৫ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশে ফিরে ব্যবসায় যুক্ত হন মোহাম্মদ আবুল কালামের সন্তান মোহাম্মাদ মুস্তাফা হায়দার। তার নেতৃত্বেই প্রচলিত খাতের বাইরে এখন রাসায়নিক ও পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পেও নেতৃত্ব দিচ্ছে টিকে গ্রুপ। দেড় দশক আগে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে রাসায়নিক উৎপাদনের কারখানা ‘সামুদা কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেড’ গড়ে তোলেন তিনি। বাংলাদেশে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ও কস্টিক সোডা খাতে পথ দেখানো কারখানাও এটি। এ কারখানা বাংলাদেশে ৫০-৭০ শতাংশ ঘনত্বের হাইড্রোজেন পার অক্সাইড উৎপাদন করছে। এ রাসায়নিকের ব্যবহার বেশি মূলত টেক্সটাইল শিল্পে। উৎপাদন শুরুর পর হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রাসায়নিক পণ্যটি রফতানিনির্ভর পণ্যে পরিণত হয়। চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে ডাঙ্গারচরে জ্বালানি পণ্য উৎপাদনের বেসরকারি খাতের প্রথম কারখানা সুপার পেট্রোকেমিক্যালের মালিকানায় আসার পর গ্যাসের উপজাত কনডেনসেট ও ন্যাপথা প্রক্রিয়াজাত করে এ কারখানায় অকটেন, ডিজেল, জাইলিনসহ জ্বালানির পাশাপাশি নানা ধরনের জ্বালানিপণ্য উৎপাদন হচ্ছে। এ দুটি কারখানা ছাড়াও দেশের বড় একাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চলে বড় বিনিয়োগে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মুস্তাফা হায়দার। ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি বিনিয়ো গে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে মডার্ন সিনটেক্স টেক্সটাইল গ্রেডের প্লাস্টিক চিপস তৈরির কারখানার পাশাপশি সামুদা ফুড প্রডাক্টস লিমিটেড বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে রাসায়নিক দ্রব্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের কারখানায়ও বড় বিনিয়োগে যায়। মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ধলঘাটা) সুপার পেট্রোকেমিক্যাল লিমিটেড ৪১০ একর ও সামুদা কেমিক্যাল কমপ্লেক্সের ১০০ একর জমি নিয়ে শুরু হয়েছে কর্মযজ্ঞ।

টিকে গ্রুপের ডিরেক্টর মোহাম্মাদ মুস্তাফা হায়দার বলেন, ‘‌বাংলাদেশ একটি মুক্তবাজার অর্থনীতি যেখানে বেসরকারি খাত একটি শিল্প ভিত্তি প্রতিষ্ঠায় মূল ভূমিকা পালন করে। আমরা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে আমাদের শিল্প সম্প্রসারণেও সচেষ্ট। টিকে গ্রুপ বাংলাদেশের জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের উদ্যোগগুলো যেন দারিদ্র্য দূরীকরণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। আমাদের গ্রাহকের বিশ্বাস অর্জন করেই আজ দেশের অন্যতম ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত টিকে গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। আমরা বিক্রয় ও বিতরণ আউটলেট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গ্রাহকের দোরগোড়ায় আমাদের পণ্য ও পরিষেবা পৌঁছে দিচ্ছি। এক্ষেত্রে বলব মানবসম্পদই হলো আমাদের মূল সম্পদ।

টিকে গ্রুপের উদ্যোক্তা দুই ভাইয়ের একজন মোহাম্মদ আবু তৈয়ব ২০১৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার সহধর্মিণী লায়লা বিলকিস বর্তমানে গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। টিকে গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবু তৈয়বের তিন সন্তান হাসনাত মোহাম্মদ আবু ওবায়দা, আবু সাদাত মোহাম্মদ ফয়সাল ও তালহা বিন তৈয়বের হাত ধরেও গড়ে উঠেছে শতভাগ রফতানিমুখী ম্যাফ শুজ লিমিটেড, ম্যাফ নিউজপ্রিন্ট কারখানা, ম্যাফ ফার্মিংসহ নতুন নতুন শিল্প-কারখানা।

ব্যবসার পাশাপশি গ্রুপটি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সেবা খাতে নানাভাবে মানুষকে সহযোগিতা করে আসছে। পটিয়ায় টিকে গ্রুপের গড়ে তোলা একটি হাসপাতালে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার পাশাপাশি স্কুল, মেডিকেল কলেজসহ নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন