আলোকপাত

সাম্প্রতিক বন্যা ও কিছু অতিরিক্ত ভাবনা

ড. মাসফিকুস সালেহীন

ছবি : বণিক বার্তা

সম্প্রতি দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বড় বন্যা হয়ে গেল, যার ধকল এখনো পোহাতে হচ্ছে লাখ লাখ মানুষকে। গোমতী, মুহুরী ও ফেনী নদীর উজানে তাদের ক্যাচমেন্টে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ছিল সাম্প্রতিক এ বন্যার জন্য দায়ী। ক্যাচমেন্টগুলোর আকার ছোট এবং ভূমির ঢাল বেশি হওয়ায় বৃষ্টির পর কিছু সময়ের মধ্যেই নদীর পানির লেভেল দ্রুত বেড়ে যায়, আবার বৃষ্টির পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে নদীর পানি দ্রুত নেমেও যাওয়ার কথা। এজন্যই এ নদীগুলোকে আমরা বলি ফ্ল্যাশি নদী। নদীর পানি কমে গেলেও প্লাবনভূমির পানি কিন্তু এখনো কমেনি।

দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সাম্প্রতিক এ বন্যাকে কোনোভাবেই ঠেকানো যেত না। তাহলে আমরা কীভাবে এ বন্যার ইমপ্যাক্ট বা ক্ষতি কমাতে পারতাম? মানুষের পূর্ব প্রস্তুতির জন্য দরকার বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ, যা এ রকম ফ্ল্যাশি নদীর জন্য সহজ নয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ফ্লাড ফোরকাস্টিং ও ওয়ার্নিং সেন্টারের (এফএফডব্লিউসি) পুরো বাংলাদেশের জন্য ফোরকাস্টিং বা পূর্বাভাস মডেল আছে, গোমতী, মুহুরী, ফেনী, হালদা, মাতামুহুরী, সাংগু এসব পাহাড়ি, ছোট ও ফ্ল্যাশি ক্যাচমেন্ট ছাড়া। বড় ক্যাচমেন্ট বা বেসিনের (যেমন—ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা) জন্য এ কাজটি সহজতর কারণ এসব নদীর পানির লেভেল তুলনামূলক ধীরে বাড়ে (একদিনে হয়তো সর্বোচ্চ ৪০-৫০ সেমি)। বেসিনের আকার বড় হওয়ার কারণে বেসিনের বৃষ্টি ও নদীর উজানে পানির লেভেলের ডাটা দিয়ে এক-পাঁচদিন আগে ফোরকাস্ট দেয়া সম্ভব হয়। অন্যদিকে ফ্লাশি ক্যাচমেন্টগুলোয় ২৪ ঘণ্টারও অনেক কম সময়ে পানির লেভেল বাড়তে পারে (বৃষ্টির পরিমাণ ও ক্যাচমেন্ট বিশেষে) ৩-৫ মিটার। এসব ক্যাচমেন্টে বন্যার পূর্বাভাস দেয়ার জন্য প্রয়োজন হয় আগে বৃষ্টি কত হতে পারে তার পূর্বাভাস জানতে পারা। তবে বৃষ্টি নির্ভুলভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা দুরূহ। 

ফ্লাড বা আকস্মিক বন্যার জন্য নদীতে পানির লেভেল কত হবে তার এত অ্যাকুরেসি বা নির্ভুলতার প্রয়োজন নেই, বরং প্রয়োজন হচ্ছে বলতে পারা কোথায় কোথায় আকস্মিক বন্যা হতে পারে, আর তা কী মাত্রার হতে পারে। বিভিন্ন অবস্থানে ঘটে যাওয়া বৃষ্টি ও সম্ভাব্য বৃষ্টির ওপর ভিত্তি করে একটা ক্যাচমেন্টভিত্তিক অপারেশনাল ফ্লাড অ্যালার্ট সিস্টেম করা সম্ভব, যাতে কোন এলাকাগুলো সময়ের সঙ্গে কী রকম ঝুঁকির মধ্যে আছে তা সবাই জানতে পারে। এতে অন্তত কয়েক ঘণ্টা লিড টাইম বা আগাম সময় পাওয়া যেতে পারে যা মানুষকে নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তর এবং অন্যান্য প্রস্তুতিতে কিছুটা হলেও সহায়তা করবে। ভারতের ফোরকাস্টিং ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যাবে এ রকম একটা সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে, যেখানে তারা ঘণ্টায় ঘণ্টায় ডাটা আপডেট করে। 

পুরো বাংলাদেশের জন্য তৈরি করা আধুনিক বন্যা পূর্বাভাস মডেলের মতো কিছু এখানে সম্ভব না, এবং প্রয়োজনও নেই। প্রয়োজন হচ্ছে প্রথমত, বৃষ্টির আগাম বার্তা পরিমাণগতভাবে এবং স্থানভিত্তিক আরো সুনির্দিষ্ট করা। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ৮৯ মিমি-এর চেয়ে বৃষ্টিকে প্রবল বৃষ্টি হিসেবে বিভাগভিত্তিক পূর্বাভাস দেয়া ছোট পাহাড়ি ক্যাচমেন্টগুলোর জন্য খুব উপকারী না; ৯০ মিমি বৃষ্টি আর ২০০ বা ৩০০ মি মিঃ বৃষ্টির মধ্যে অনেক তফাত। প্রয়োজন হচ্ছে এই রেঞ্জের উঁচু মাত্রার বৃষ্টিকে আরো সুনির্দিষ্ট করা, যেমন ১০০-১৫০, ১৫০-২০০, ২০০-২৫০ মিঃ মিঃ, ইত্যাদি এবং ক্যাচমেন্ট হিসাবে বলতে পারা। ইন্ডিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টের (আইএমডি) এ রকম ক্ল্যাসিফিকেশন আছে। বিএমডি ও আইএমডির ডাটা সমন্বয় করে এর ওপর ভিত্তি করে ক্যাচমেন্টভিত্তিক ফ্লাড অ্যালার্ট সিস্টেম তৈরি করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। এর মাধ্যমে এ মুহূর্তে বন্যার পরিস্থিতি কী (নাউকাস্টিং) এবং আগামী ১২ ঘণ্টা বা ২৪ ঘণ্টা পরে কী পরিস্থিতি হতে পারে (ফোরকাস্টিং) তার একটা অনুমান পাওয়া সম্ভব হবে। আমি আরো মনে করি, খুব সহজ হাইড্রোলজিক‍্যাল মডেল দিয়ে পানির সম্ভাব্য প্রবাহ ও লেভেল কতটুকু এবং কত দ্রুত বাড়তে পারে, কিছু অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও একটা পর্যায়ে বলা সম্ভব। 

এ রকম একটা অ্যালার্ট সিস্টেম ভালো কাজ করার জন্য ভারতের ডাটা প্রয়োজন, কারণ ক্যাচমেন্টগুলোর বেশির ভাগ অংশ ভারতের মধ্যে অবস্থিত। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ডাটা শেয়ারিংয়ের প্রোটকল অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশকে দিনে দুবার গোমতী নদীর হাইড্রোলজিক ডাটা ট্রান্সমিট করে। এবারো করেছে। এ ধরনের ক্যাচমেন্টের জন্য বন্যার সময় দিনে দুবারের বেশি ডাটা পেলে ভালো হয়। প্রাপ্ত ডাটা এবং ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য কাজে লাগিয়ে আমাদের উচিত হবে ভারতের মতো আমাদেরও অ্যালার্ট সিস্টেম দ্রুত তৈরি করা। বন্যার প্রভাব কী রকম হতে পারে তা বোধগম্য ভাষায় মানুষের কাছে অতিদ্রুত পৌঁছাতে হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে এটি করতে পারা খুব কঠিন হওয়ার কথা নয়। উত্তরবঙ্গে কিছু ফ্লাড শেল্টার ও উপকূলীয় অঞ্চলে সাইক্লোন শেল্টার নির্ধারিত আছে, কিন্তু দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এসব নদীর প্লাবনভূমিতে বসবাসকারী জনগণের জন্য কোনো নির্ধারিত ফ্লাড শেল্টার নেই। ফ্লাড শেল্টার নির্ধারণ করার পাশাপাশি বন্যা আসার আগে অতিদ্রুত শেল্টারে স্থানান্তরের জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করা অতিজরুরি। বন্যার সময় এফএফডব্লিউসি, বিএমডি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের (ডিডিএম) একটা টিম হিসেবে একসঙ্গে কাজ করা দরকার। এজন্য টিমের সক্ষমতা ও জনবল বাড়ানোর প্রয়োজন হবে।

আরো দুটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। প্রথমত, ৩১ বছর পর দ্বিতীয়বারের মতো ভারতকে ডুম্বুর ড্যামের পানি অতিরিক্ত পানি রিলিজ করতে হয়েছে। ড্যামের পানি রিলিজ করার জন্য বাংলাদেশে গোমতী নদীতে বন্যার তীব্রতা বাড়েনি সত্যি, কিন্তু ড্যামের পানি রিলিজ করার প্রয়োজন হয়েছে ভারতের কাছ থেকে এ তথ্যও বাংলাদেশের জন্য অনেক উপকারী হবে এই কারণে, তুমুল বৃষ্টির কারণে একটা বড় বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে এটি বোঝা যাবে। দ্বিতীয়ত, আমি সবসময় ভারত-বাংলাদেশের একটা সমন্বিত বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে অ্যাডভোকেসি করি। এটি মুহুরী, গোমতী, ফেনী, মনু, খোয়াই—এসব ছোট ক্যাচমেন্টগুলোয় করাটা এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং দুই দেশের জন্য সহযোগিতা করা সহজতর।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশে একটি চমৎকার কাঠামো আছে। দুর্যোগ-ঝুঁকি কমানোর জন্য স্ট্যান্ডিং অর্ডার অন ডিজাস্টার্স (এসওডি) গাইডলাইন অনেক আগেই তৈরি হয়েছে এবং সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এটি আপডেটও করা হয়েছে। গাইডলাইনে কোন সময়ে কার কী দায়িত্ব তার পরিষ্কার বর্ণনা আছে। এবারের এই আকস্মিক বন্যায় এটি ভালো কাজ করেনি। আকস্মিক বন্যাকে ফোকাস করে এটি আরো আপডেট করার প্রয়োজন তৈরি হয়েছে। 

বৃষ্টি কমেছে, নদীর পানিও বিপৎসীমার অনেক নিচে নেমেছে, কিন্তু সে অনুযায়ী প্লাবনভূমির পানি দ্রুত কমেনি। বন্যা যাতে দীর্ঘস্থায়ী না হয় সেজন্য পানি নামার পথগুলো সচল রাখা খুব জরুরি। বেশির ভাগ জায়গায় নদী-ড্রেনেজ-খাল দখল একটি বড় সমস্যা। এগুলোকে পুনরুদ্ধার এবং ভরাটকৃত জলাশয় এবং নিচু জায়গাগুলোকে আগের মতো বন্যার সময় পানি ধারণ করার অবস্থায় নিয়ে আসা অতিপ্রয়োজন। এছাড়া ড্রেনেজ স্ট্রাকচারগুলো সময়মতো এবং জোয়ার-ভাটার সঙ্গে মিল রেখে খোলার ব্যবস্থা করা জরুরি। 

সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণকারী বাঁধ (নদীর পারের সমান্তরালে নির্মিত স্ট্রাকচার যা প্লাবনভূমিকে বন্যা থেকে রক্ষা করে) এর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল হওয়ার কারণে বাঁধগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দুর্বল এবং বাঁধের উচ্চতা ডিজাইন (নকশা) লেভেলের নিচে নেমে থাকে। এর ফলে মাঝারি মাত্রার বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসেই বাঁধ ভেঙে ব্যাপক ক্ষতির সৃষ্টি হয়। রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ার একটি বড় কারণ এর জন্য বরাদ্দ বাজেটের অপ্রতুলতা। উদাহরণস্বরূপ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্ট্রাকচারগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয় বাজেটের মাত্র ১০-১২ পার্সেন্ট সচরাচর বরাদ্দ দেয়া হয়। 

আমাদের সমস্যা হলো বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনার কাজে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আমরা অনেক সময়ই বিনিয়োগ করি না। উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো বিশাল অংকের বাজেটে শুধু ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রকল্প বাস্তবায়ন করে; তাদের বিনিয়োগ পলিসিতে রক্ষণাবেক্ষণ বাজেটের বিধান নেই, যা সরকারের ওপর একটা বড় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। রক্ষণাবেক্ষণ বরাদ্দ দেয়া হয় রেভিনিউ বাজেট থেকে, যা অত্যন্ত অপ্রতুল। আমাদের গবেষণায় এটি পরিষ্কার যে অনেক জায়গাতেই বাঁধের উচ্চতা বাড়ানোর চেয়ে বাঁধগুলো মেরামত করে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে ডিজাইন লেভেল বজায় রাখা বেশি জরুরি। এজন্যই এখনকার স্লোগান হওয়া উচিত: Maintenance, maintenance, and maintenance.

এবার ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ডাটা শেয়ারিং সম্পর্কে কিছু কথা বলা যাক। যৌথ নদী কমিশনের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, কিন্তু ভারতের কাছ থেকে ডাটা পাওয়ার ব্যাপারে নেগোসিয়েশনে তাদের বড় দুর্বলতা ছিল তা বলা যাবে না। অনেক বছর যখন আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়নি, দুই দেশের যৌথ নদী কমিশন কিন্তু আলাপ চালিয়ে গেছে, এবং পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে গত ৮-১০ বছর ভারতের বেশ কয়েকটি অতিরিক্ত পর্যবেক্ষণ স্টেশন থেকে বাংলাদেশ ডাটা পাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপর চারটি, গঙ্গার ওপর দুটি, বরাকের ওপর দুটি, তিস্তার ওপর দুটি আর মনু ও গোমতী নদীর ওপর একটি করে মোট ১৪টি হাইড্রোলজিক স্টেশন। এছাড়াও বৃষ্টির তথ্য (৫০ মিমি-এর বেশি হলে) পাওয়া যায় বেশ কয়েকটা স্টেশন থেকে। এর ফলে আমরা ২০১৪ সাল থেকে মূল নদীগুলোয় তিনদিনের জায়গায় পাঁচদিনের ফোরকাস্ট বা আগাম বার্তা দিতে পারছি। কয়েক বছর ধরে ভারত বেশ কয়েকটি স্টেশনে একদিনের পূর্বাভাস ডাটাও দিচ্ছে। এ বিষয়গুলো সায়েন্টিফিক কমিউনিটির অনেকের কাছেই অজানা। এ ব্যাপারে যৌথ নদী কমিশনকে আরো ট্রান্সপারেন্ট হতে হবে।

আমরা মনে করেছি আরো কয়েকটি স্টেশনের বৃষ্টি, নদীর পানির প্রবাহ ও লেভেলের ডাটা পেলে আমাদের বন্যা পূর্ভাবাস এবং সতর্কীকরণ আরো কার্যকর হবে। সেজন্য অতিরিক্ত ডাটার ব্যাপারে ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, যা এখনো আলোচনার পর্যায়ে। এসব ডাটা চাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা নদীর সীমান্তের নিকটবর্তী জেলাগুলোয় তিন-পাঁচদিনের আগাম পূর্বাভাসের নির্ভুলতা বাড়ানো এবং ফ্ল্যাশি নদীগুলোয় বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ সিস্টেমকে উন্নত করা। এছাড়া ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা নদীতে ভারত-বাংলাদেশ সমন্বিত বন্যা পূর্বাভাস মডেলের (ইন্টিগ্রেটেড ফ্লাড ফোরকাস্টিং সিস্টেম) জন্য ভারতকে লিখিত প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তবে আগেই বলেছি এ রকম সমন্বিত মডেল এখন বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে পাহাড়ি ছোট ক্যাচমেন্টগুলোর জন্য।

আন্তঃনদী বিষয়ে বন্যা সময়কালীন সহযোগিতার অনেক গুরুত্ব আছে এটি তো পরিষ্কার বোঝা গেল। কিন্তু আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শুষ্ক মৌসুমে আমরা কতটুকু পানি পাচ্ছি। ভারতের সঙ্গে দাবি-দাওয়া বলি অথবা নেগোসিয়েশন বলি, এটি হচ্ছে একটি অন্যতম বিষয়।

প্রথমেই ব্যারাজ ও ড্যাম নিয়ে ক্যাটাগরিক্যালি কিছু কথা বলি। ফারাক্কা হলো একটি ব্যারাজ, যার অর্থ নদীর আড়াআড়ি বেশসংখ্যক গেট বসানো হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে (ডিসেম্বর থেকে মে মাস) গেটগুলোকে বন্ধ করার মাধ্যমে গেটের ওপরে পানির লেভেল বাড়িয়ে ডাইভারশন খাল দিয়ে পানি ডাইভার্ট করা হয় (ফারাক্কার ক্ষেত্রে এটি হলো হুগলি-ভাগিরথী নদী)। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে যৌথ নদী কমিশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ারগণ ফারাক্কায় গিয়ে ভারতের যৌথ নদী কমিশনের সঙ্গে প্রতিদিন পানি পরিমাপ এবং চুক্তি অনুযায়ী পানি বণ্টন করে।

ব্যারাজের কোনো স্টোরেজ রিজার্ভার নেই, পানি সংরক্ষিত হয় নদীর মধ্যে, যাকে আমরা ইন-স্ট্রিম স্টোরেজ বলি, যার পরিমাণ অত বেশি নয়। বর্ষার শুরু থেকেই (জুন শেষ বা জুলাইয়ের শুরু) পর্যায়ক্রমে গেট খোলা শুরু হয় ব্যারাজের সেফটি লেভেলের কথা চিন্তা করে। আর ডাইভারশন খালেরও একটা সর্বোচ্চ ক্যাপাসিটি আছে। পানির প্রবাহ দ্রুত বাড়ার ফলে সেফটি লেভেল অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে ব্যারাজেরও সব গেট খোলা হয়ে যায়। অতএব ফারাক্কার সব গেট খুলে দেয়ার কারণে বাংলাদেশে বন্যা হচ্ছে—এ কথাটি ঠিক নয়। বর্ষার যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সে সময় গেটগুলো খোলা থাকে। প্রকৃত পক্ষে ১৯৯৮ সালের পর আমাদের গঙ্গা নদীর মাধ্যমে কোনো মাঝারি বা বড় বন্যা হয়নি বরং কিছু বছরে গঙ্গার প্লাবনভূমিতে যমুনা নদীর পানি ঢুকে গিয়ে বন্যার সৃষ্টি করেছে।

তবে ফারাক্কা ব্যারাজের কারণে আমাদের যে অনেক অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে এটা সবারই ভালোভাবে বোঝা দরকার। এর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদীগুলোর অনেকটুকু উজান পর্যন্ত লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ, যার জন্য মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে কৃষি উৎপাদন, মাটির লবণাক্ততা বেড়েছে বহু গুণ, লবণাক্ত জমির পরিমাণও বেড়েছে ক্রমশ, এবং সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে। 

আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ফারাক্কা ব্যারাজ দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের নদীগুলোয় পলি জমা ও এর ফলে নদীর বুক উঁচু হয়ে শুষ্ক মৌসুমে নদী মৃতপ্রায় হয়ে পড়া এবং জলাবদ্ধতা বৃদ্ধি, এ সমস্যাকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। গবেষণায় এটি এখন পরিষ্কার, শুষ্ক মৌসুমে যদিও তুলনামূলক কম পরিমাণ পলি জোয়ারের পানির সঙ্গে নদীগুলোর ভেতরে প্রবেশ করে, ফারাক্কার কারণে ওপর থেকে পানি কম আসার ফলে এর বেশির ভাগই নদীতে জমা হয়, যার পরিমাণ বন্যা মৌসুমে পলি পড়ার চেয়ে বেশি। অতএব, ফারাক্কা ব্যারাজ বাংলাদেশের বন্যার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত না হলেও পরোক্ষভাবে এর ভূমিকা আছে প্লাবনভূমির পানি নিষ্কাশন না হতে দেয়ার মাধ্যমে। এছাড়া ব্যারাজের ওপর বিহারের নদীতে ধীরে ধীরে পলি জমে এখন ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি করেছে; নদীর পানি পরিবহন করার ক্যাপাসিটি কমে যাওয়ায় বিহারে নিয়মিত বন্যা হচ্ছে। 

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে এবং ভবিষ্যতে আরো বাড়বে। এর ফলে নদী ভরাট ও লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ আরো বেড়ে ভবিষ্যতে একটা হাইড্রো-ইকোলজিক্যাল বিপর্যয় ঘটবে যদি আমরা দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে পানির প্রবাহ বাড়াতে না পারি।

অতএব, আমাদের যদি বলা হয় আমরা যা পানি পাচ্ছি তা তো আমরা ব্যবহার না করে সমুদ্রেই যেতে দিচ্ছি, তখন নিশ্চয়ই আমাদের অনেক অকাট্য যুক্তি থাকবে। আমাদের এখন প্রস্তুতি নিতে হবে ফারাক্কা পানি চুক্তি যা ২০২৬ সালে নবায়ন হবে তার জন্য। চুক্তির একটি বিষয় হলো পানিবণ্টন হয় ফারাক্কা পয়েন্টে কতটুকু পানি পাওয়া যায় তার ওপর ভিত্তি করে। সমস্যা হলো এটা নির্ভর করবে ওপরে কতটুকু পানি ব্যবহার হয়েছে তার ওপর। এছাড়া বাংলাদেশের প্রাপ্যতার বিষয়ে কোনো গ্যারান্টি ক্লজ নেই, যেটা আগেকার অ্যাগ্রিমেন্টে ছিল। 

আমাদের বড় দুশ্চিন্তা ও আক্ষেপের বিষয় তিস্তায় শুষ্ক মৌসুমে প্রাপ্য পানি না পাওয়া এবং তিস্তা চুক্তি এত বছরের মধ্যেও স্বাক্ষর না হওয়া। ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের মাধ্যমে তিস্তা থেকে পানি সরিয়ে নেয়ার কারণে শুষ্ক মৌসুমে আমাদের অংশের পানি শূন্যের কোটায় থাকে। এর জন্য আমাদের দাবি আদায়ের চেষ্টা করে যেতেই হবে। বিষয়টি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিমবঙ্গের সরকারের মধ্যে সমঝোতার ব্যাপার বলা হচ্ছে। আমি মনে করি, এ বিষয়ে ভারত সরকারের আরো অনেক করণীয় আছে।

এছাড়া আমাদের করণীয় হচ্ছে অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন চুক্তি দ্রুত সম্পাদনের চেষ্টা করা। গঙ্গা পানি চুক্তিতে এ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে বলা ছিল, কিন্তু আমাদের সে অনুযায়ী অগ্রগতি কম। তবে দুই দেশের মধ্যে বেশকিছু নদীর ডাটা বিনিময় হয়েছে, যা পর্যালোচনার কাজ চলছে।

এবার একটু আলোচনা করি ড্যাম নিয়ে। ড্যাম পাহাড়ি এলাকায় নদীর আড়াআড়ি স্থায়ী শক্ত স্ট্রাকচার, যা বর্ষার সময় ড্যামের উজানে স্টোরেজ রিজার্ভারে পানি ধরে রাখে, এবং ড্যামের নিচে নদীতে নিয়ন্ত্রিতভাবে পানি ছাড়া হয়। অতিজরুরি অবস্থায় ড্যামের পানি রিলিজ করলে তার প্রভাব বন্যার ওপর কতটুকু হবে, তা নির্ভর করবে ড্যামের পানি ধারণক্ষমতা, ড্যাম থেকে দূরত্ব এবং কী পন্থায় পানি রিলিজ করা হচ্ছে, এগুলোর ওপর। বড় ড্যামগুলো বেশির ভাগই একাধিক কাজে লাগানো হয়, যার মধ্যে রয়েছে ড্যামের নিচের অংশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বর্ষায় জমাকৃত পানি শুষ্ক মৌসুমে নিচে ছেড়ে দিয়ে নদীতে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি (যা কৃষকদের সেচ, খাবার পানির সরবরাহ, ভারী নৌযান চলাচল ও অন্যান্য সুবিধা দেয়) এবং ইলেকট্রিসিটি উৎপাদন। তবে ড্যামের অনেক নেগেটিভ প্রভাব আছে, যেমন অনেক মানুষের স্থানচ্যুতি, নদীর ইকোসিস্টেমে ব্যাঘাত ও অধঃপতন এবং নদীর পলি বহনে বাধা ও পলি হ্রাস। গবেষণায় এটি পরিষ্কার, ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা নদী দুটির বাংলাদেশে পলি পরিবহন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এটি ডেল্টা বিল্ডিং, মেঘনা নদীর মোহনায় পরিকল্পিত ক্রস ড্যামের মাধ্যমে জমি পুনরুদ্ধার, প্লাবনভূমিতে পলি অবক্ষেপণ এবং উপকূলীয় অঞ্চলের ল্যান্ড সাবসিডেন্স বা ভূমি অবনমনের ভারসাম্য রক্ষা—এসব চ্যালেঞ্জকে আরো বাড়িয়ে দেবে।

অতএব, বন্যার পাশাপাশি আরো অনেক বিষয় আছে যার সাথে আঞ্চলিক আলোচনা এবং সহযোগিতার বিষয় যেমন জড়িত, একই সঙ্গে এসব বিষয়ে আমাদের নিজেদেরও অনেক করণীয় আছে। আমাদের একটা বড় সমস্যা হলো আন্তঃসীমানা পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে ন্যাশনাল কনসেনসাস নেই। কোনো ওপেন ফোরামে এ বিষয়ে খুব আলোচনা হয় না। যদিও ব্যাপারটি এত সহজ নয়, আমরা পানি নিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা থেকে বহুপক্ষীয় আলোচনা ও বেসিনব্যাপী পানি ব্যবস্থাপনায় উত্তরণ চাচ্ছি। এর জন্য প্রয়োজন সঠিক ডিপ্লোম্যাসি।  

ড. মাসফিকুস সালেহীন: অধ্যাপক, পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন