দেড় দশকে রেল ও সড়কের স্থানীয় শীর্ষ ঠিকাদার

সবচেয়ে বেশি অর্থের কাজ পেয়েছে ম্যাক্স তমা এনডিই

শামীম রাহমান

ছবি : বণিক বার্তা

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উন্নয়ন বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেত পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামো খাত। নতুন সড়ক, সেতু, রেলপথ নির্মাণ, সংস্কার ও উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। খাতটিতে বিভিন্ন বিদেশী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেছেন স্থানীয় ঠিকাদাররাও। গত দেড় দশকে স্থানীয় ঠিকাদারদের মধ্যে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে সবচেয়ে বেশি টাকার কাজ করেছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ও তমা কনস্ট্রাকশন। অন্যদিকে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরে শীর্ষ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (এনডিই)। 

তালিকার শীর্ষ দশের মধ্যে থাকা অন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো হলো রানা বিল্ডার্স, হাসান টেকনো বিল্ডার্স, মোজাহার এন্টারপ্রাইজ, ময়েনউদ্দিন (বাঁশি) লিমিটেড, মাসুদ হাইটেক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স ও মুহাম্মদ আমিনুল হক। 

বাংলাদেশ রেলওয়েতে কাজ করা স্থানীয় ঠিকাদারদের মধ্যে টাকার অংকে সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। লাকসাম-চিনকি আস্তানা, কাশিয়ানি-গোপালগঞ্জ রেলপথসহ রেলওয়ের একাধিক অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নের কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে রেলের চলমান দুটি প্রকল্পে কাজ করছে ম্যাক্স। এর মধ্যে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে ৩ হাজার ৫০২ কোটি টাকার। আর আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ প্রকল্পে চীন ও বাংলাদেশের দুই প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে ৩ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকার কাজ করছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। 

প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর। অভিযোগ আছে বিগত সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাওয়া ঠিকাদারদের অন্যতম তিনি। এ বিষয়ে জানতে গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করেও গোলাম মোহাম্মদ আলমগীরের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

রেলওয়ে ছাড়াও সম্প্রতি ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে ২ হাজার ৩২০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ পেয়েছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। চীনের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে সড়কটির একাংশের নির্মাণকাজ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

রেলের আরেক শীর্ষ ঠিকাদার তমা কনস্ট্রাকশন। দোহাজারী-কক্সবাজার ও আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে ৬ হাজার ১৬১ কোটি টাকার কাজ করছে তমা। প্রতিষ্ঠানটির মালিক আতাউর রহমান ভূঁইয়া। 

একসময় নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে পরাজিত হন তিনি। তমা কনস্ট্রাকশনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

অন্যদিকে স্থানীয় ঠিকাদারদের মধ্যে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে শীর্ষে রয়েছে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (এনডিই)। সরকারি ক্রয়সম্পর্কিত তথ্যভাণ্ডার সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরের পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে ১১৩টি কার্যাদেশ পেয়েছে। এসব কাজের চুক্তি মূল্য ৫ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকার বেশি। সড়ক, সেতুর পাশাপাশি বিদ্যুৎ, আবাসনসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের কাজও করে এনডিই। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আশরাফ উদ্দিন সরকার।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আরেক শীর্ষ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রানা বিল্ডার্স। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে ৪২২টি কার্যাদেশ পেয়েছে। এসব কাজের চুক্তি মূল্য ৫ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা। রানা বিল্ডার্সের মালিক মো. আলম। 

বণিক বার্তার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, চার দশকের বেশি সময় ধরে ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত মো. আলমের উত্থান হয়েছে মূলত গত এক দশকে। এর আগে সওজসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার ছোট ছোট কাজ করত রানা বিল্ডার্স। ২০১০ সালের পর থেকেই সওজের বড় বড় উন্নয়নকাজ পেতে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। পটুয়াখালীর শেখ রাসেল সেতু, খেপুপাড়া সেতু, মহিপুর সেতু, জিঞ্জিরা-দোহার মহাসড়ক, যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর মহাসড়ক, জয়দেবপুর-টাঙ্গাইল-জামালপুর মহাসড়ক, কাঁচপুর-ভৈরব-সিলেট-জাফলং মহাসড়ক, দৌলতদিয়া-খুলনা-যশোর মহাসড়ক, লাকসাম-মাইজদী মহাসড়ক, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েসহ একাধিক বড় বড় প্রকল্পের কাজ করেছে রানা বিল্ডার্স।

রানা বিল্ডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. আলমের ভাগনে নাজমুল হাসান (পাখি)। তার মালিকানায় থাকা হাসান টেকনো বিল্ডার্স ২০১৫ সালের অক্টোবরের পর থেকে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে ৪২০টি কাজ পেয়েছে, যেগুলোর চুক্তি মূল্য ৪ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। একইভাবে আলমের ভাতিজা জুলফিকার হোসেন মাসুদ ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে ৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে।

রানা বিল্ডার্সের মালিক মো. আলমের দাবি, তারা সব ধরনের নিয়মকানুন মেনেই কাজ পেয়েছেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমরা যেসব কাজ পেয়েছি, সবই যথাযথ দরপত্র অনুযায়ী হয়েছে। কোথাও কোনো গরমিল কেউ পাবে না। ২০২০ সালের পর আমাদের কাজের পরিমাণ কমে এসেছে। এজন্য মূলত সরকারের ক্রয় পদ্ধতি (ইজিপি) দায়ী। সড়কে অনেক ঠিকাদার রয়েছে, যাদের কাজ বেশি কিন্তু মূল্য কম। অথচ দরপত্র প্রক্রিয়ায় যাদের কাজের পরিমাণ বেশি, তাদেরই কাজ দেয়া হয়। এ সুযোগে অনেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিগত সময়ে অস্বাভাবিকভাবে কাজ পেয়েছে।’

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আরেক শীর্ষ ঠিকাদার মোজাহার এন্টারপ্রাইজ। সিপিটিইউর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি ১ হাজার ১৭৬টি কাজ পেয়েছে। এসব কাজের চুক্তি মূল্য ৪ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। 

মোজাহার এন্টারপ্রাইজের মালিক কাজী মোজাহারুল হকের বাড়ি খুলনায়। তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থক স্থানীয় একটি প্রভাবশালী পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে ঠিকাদারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির পর থেকে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে ৬৪১টি কার্যাদেশ পেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ময়েনউদ্দিন (বাঁশি) লিমিটেড। এসব কাজের চুক্তি মূল্য ৪ হাজার ৬০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের নভেম্বরের পর থেকে স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে ৩ হাজার ১৮৯ কোটি টাকার কার্যাদেশ পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান খান মো. আফতাব উদ্দিন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের শীর্ষ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে উঠে এসেছে নওগাঁর মুহাম্মদ আমিনুল হক লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির মালিক নওগাঁর আমিনুল হক। নব্বইয়ের দশকে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ২০১৫ সালের আগ পর্যন্ত আমিনুল হকের পাওয়া কাজের সংখ্যা হাতে গোনা। এরও একটি অংশ আবার তিনি পেয়েছিলেন অন্য কোম্পানির সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে।

সিপিটিইউর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে ৩ হাজার ৮১১টি কার্যাদেশ পেয়েছে আমিনুল হক লিমিটেড। এসব কাজের চুক্তি মূল্য ২ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা।

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে গতকাল আমিনুল হকের সেলফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের শীর্ষ ঠিকাদারের মধ্যে আরো রয়েছে এমএম বিল্ডার্স, মাহফুজ খান, ওরিয়েন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড বিল্ডার্স ও আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন। এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কয়েকটির বিরুদ্ধে জাল সনদ ব্যবহার করে কার্যাদেশ বাগিয়ে নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। অনুসন্ধান করে এ অভিযোগের সত্যতা পেয়ে মোজাহার এন্টারপ্রাইজ, আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন, মাসুদ হাইটেক, ময়েনউদ্দিন (বাঁশি) লিমিটেড, রানা বিল্ডার্স, হাসান টেকনো বিল্ডার্সের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশের বিভিন্ন স্থানে কালো তালিকাভুক্ত করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর।

অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌আমরা অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিচ্ছি। এখন কিন্তু এক ঠিকাদারের বেশি কাজ পাওয়ার ঘটনা অনেকটাই কমে এসেছে। এটা চলমান প্রক্রিয়া। ভবিষ্যতে আরো কমে আসবে। আর দেশে কাজের বিপরীতে ঠিকাদারের সংখ্যা কিন্তু কম। তাই অনেক ঠিকাদার বেশি বেশি কাজ করতেই হবে।’

বিদ্যমান সরকারি ক্রয় পদ্ধতি বাংলাদেশে ঠিকাদারদের বড় একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌প্রত্যেক ঠিকাদারেরই নিজস্ব সক্ষমতার একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ঠিকাদারের যে পরিমাণ আর্থিক সক্ষমতা, জনবল ও যন্ত্রপাতি রয়েছে, তার চেয়ে তার কাজের পরিমাণ বেশি হলে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হয়। কাজ বিলম্বিত হয়। মান খারাপ হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে যে ঠিকাদার বেশি কাজ পায়, সে তৃতীয় পক্ষকে সেটা হস্তান্তর করে। এ ধরনের ঘটনা কাজের গুণগত মান আরো খারাপ করতে ভূমিকা রাখে। এ ধরনের জটিলতা এড়াতে দরপত্র পদ্ধতিতে মৌলিক কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি। আহ্বান করা দরপত্রের শর্ত কিছুটা শিথিল করে বেশি বেশি ঠিকাদারদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিলে এ খাতে প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। এর বাইরে প্রত্যেক ঠিকাদারের কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা সীমারেখা বেঁধে দেয়া উচিত।’

*ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর দাবি করেন বিদেশী অর্থায়ন থাকা প্রকল্পগুলোতেই মূলত বেশি কাজ করে ম্যাক্স। তিনি বণিক বার্তা অনলাইনকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই আমরা কার্যাদেশগুলো পেয়েছি। বিদেশী অর্থায়নের প্রকল্পে কাজ করায় আমাদের চুক্তিমূল্যও বেশি। স্থানীয় অর্থায়নের কাজগুলোতে আমরা খুব একটা অংশগ্রহণ করি না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আমরা স্থানীয় অর্থায়নে একটি কার্যাদেশ পেয়েছি, যা পরে বাতিল করে দেয়া হয়েছে। আন্ধারমানিক সেতু নির্মাণ প্রকল্পে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে।’ ম্যাক্স গ্রুপ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো বাড়তি সুবিধা নেয়নি বলেও দাবি করেন তিনি।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন