ভিজুয়ালেই মুগ্ধ করলেন মিয়াজাকি

মাহমুদুর রহমান

বকের সামনে মাহিতো ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। এর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে কিশোরী। পাশে ভালুকসদৃশ এক প্রাণী। কিন্তু দেখলে ভীতি জাগে না। কিংবা অশরীরী অনেক আত্মা। তার মাঝে হারানো বালিকা। তার মা-বাবা বদলে গেছে, রূপান্তর হয়েছে অচেনা কোনো বস্তুতে। এমনই সব গল্প আমরা দেখি মিয়াজাকির সিনেমায়। সিনেমা? অবশ্যই সিনেমা তবে অ্যানিমেটেড। অ্যানিমের দুনিয়ার মিয়াজাকি আর স্টুডিও ঘিবলি কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে বহু আগেই। মিয়াজাকি আবারো একবার তার দর্শককে মুগ্ধ করতে এনেছিলেন তার নতুন অ্যানিমেশন সিনেমা ‘দ্য বয় অ্যান্ড দ্য হেরন’। মিয়াজাকি ও তার সব ধরনের উপাদানই সিনেমায় উপস্থিত। কিন্তু তিনি যেন বিশেষভাবে মুগ্ধ করলেন তার ভিজুয়ালেই।

গল্প শুরু হয় আরো কিছু জাপানি অ্যানিমেশনের মতো করেই। যারা ‘গ্রেভ অব দ্য ফায়ারফ্লাইস’ দেখেছেন, তারা আরো বেশি রিলেট করতে পারবেন। মিয়াজাকির এ সিনেমায় প্রধান চরিত্র মাহিতোর মা একটি হাসপাতালে বোমা হামলায় মারা যায়। অর্থাৎ গল্প শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে। মাহিতোর মায়ের মৃত্যুর পর তার বাবা তাকে নিয়ে যায় মূল শহর থেকে দূরে। সেখানে তিনি পুনরায় বিয়ে করেছেন। মাহিতোর সৎ মা হচ্ছেন তারই খালা নাটসুকো। মাহিতোর বাবা একটি কারখানার বড়কর্তা। কারখানাটি তৈরি করে ফাইটার প্লেন। মাহিতো তার নতুন আবাসে নতুন করে নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারত, কিন্তু এর মধ্যে একটি ধূসর বক এসে অনেক কিছু বদলে দেয়। মাহিতো একসময় চলে যায় পরাবাস্তব এক দুনিয়ায়।

মিয়াজাকির অন্য সিনেমাগুলোর মতো এখানেও বিচিত্র সব জীব ও বিচিত্র এক দুনিয়ার গল্প দেখা যায়। মাত্র ১২ বছর বয়স মাহিতোর। আজকের দিনে আমরা বলতে পারি মায়ের মৃত্যুর ট্রমা থেকে তার অদ্ভুত কিছু কল্পনা হয়েছিল। কিন্তু মিয়াজাকির সিনেমা আমাদের জানায় এমন কিছু নয়। কেননা জাপানের পুরাণে এমন অনেক কিছুই আছে, যা বাস্তবের সঙ্গে মেলানো যায় না। সে কারণেই আমরা নাটসুকোর বাড়িতে দেখি কয়েকজন অদ্ভুতদর্শন বৃদ্ধা। তারা অদ্ভুতদর্শন হলেও ক্ষতিকর নয়। মাহিতোর দেখাশোনা করে তারা। নিরাপত্তার চেষ্টাও করে। কিন্তু অল্প বয়সী ছেলেটি তো কোনো রকম বাধা মানতে চায় না। সে চলে যায় ফরবিডেন টাওয়ারে। সেখান থেকে অন্য এক দুনিয়ায়। মাকে খুঁজতে।

মাহিতোর এ গল্প কোনো না কোনোভাবে মিয়াজাকির নিজের ছেলেবেলার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু একে ঠিক আত্মজীবনী বলা যায় না। ছেলেবেলায় মিয়াজাকি যে ধরনের কল্পনার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন তার কিছু ফুটে উঠেছে। যেমন মাহিতোর বাবার পেশা। মিয়াজাকির বাবাও কাজ করতেন ফাইটার প্লেনের কারখানায়। এছাড়া মিয়াজাকি তার সারা জীবনে যত সিনেমা নির্মাণ করেছেন তার কিছু ছাপ পাওয়া গেছে দ্য বয় অ্যান্ড দ্য হেরনে।

কিন্তু ‘সিনেমা’ হিসেবে মিয়াজাকির অন্য সব সিনেমা থেকে কিছুটা পিছিয়ে এটি। কেননা ৮০ বছর বয়স পেরোনো মিয়াজাকির কাছ থেকে এখন দর্শকের চাওয়া থাকে গোছানো একটা গল্প। মিয়াজাকি এ সিনেমায় যে গল্প বলেন, বক হয়ে টিয়া বাহিনীর হাতে বন্দি হওয়া এবং শেষে এক বুড়ো নিয়ন্ত্রকের পরিচয় ও তার সঙ্গে মাহিতোর পরিবারের যোগসূত্র, সবই ঠিক ছিল কিন্তু গল্পটা মিয়াজাকি বললেন এলোমেলো করে।

স্পিরিটেড অ্যাওয়ে কিংবা মাই নেইবার টোটোরোর গল্প গোছানো। একই কথা প্রযোজ্য হাউলস মুভিং ক্যাসলের ক্ষেত্রেও। গল্প একটা জায়গা থেকে শুরু হয়ে গন্তব্যে পৌঁছনোর পুরোটা সময় চলে সমুদ্রদ্রুতিতে। কিন্তু দ্য বয় অ্যান্ড দ্য হেরনের ক্ষেত্রে তা হয় না। গল্পটা কখনো দ্রুত, কখনো ধীর, কখনো যেন হারিয়ে যায় গতিপথ থেকে। মাহিতোর সঙ্গে দর্শক নিজেকে যুক্ত করতে পারেন না যেমনটা চিচিরো বা সাতসুকির সঙ্গে পেরেছিলেন।

কিন্তু এবারো ভিজুয়ালেই মুগ্ধ করেছেন মিয়াজাকি। হাসপাতালে বোমার পর আগুনের হল্কা থেকে শুরু করে মাহিতোর নতুন বাড়ি, ফরবিডেন ক্যাসল, বকের ঝাঁক সবই দারুণ জীবন্ত। মনে হয় বাস্তবও যেন এত জীবন্ত হওয়া সম্ভব নয়। গাছের পাতা থেকে শুরু করে মাহিতোর চোখের কাঁপন পর্যন্ত সূক্ষ্ম ডিটেলিংয়ে তৈরি করেছেন মিয়াজাকি। এছাড়া টিয়া বাহিনীকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তিনি, এ সিনেমা দেখার পর টিয়া পাখিকে নতুন দৃষ্টিতে দেখবেন দর্শক।

সিনেমার আরো একটি ভালো দিক এর কণ্ঠ অভিনেতারা। ইংরেজি ভার্সনে মাহিতোর কণ্ঠ দিয়েছেন লুকা পাডোভান। মাহিতোর বাবার চরিত্রে ক্রিশ্চিয়ান বেল ও ধূসর বকের কণ্ঠ দিয়েছেন রবার্ট প্যাটিনসন। দুই হলিউড তারকা এ সিনেমায় আবারো তাদের প্রতিভা দেখিয়েছেন। পরিস্থিতি, প্লট ও ঘটনার সঙ্গে তাদের কণ্ঠের ক্যারিসমা দর্শককে মুগ্ধ করে। কিন্তু মূল জায়গা থেকে মুগ্ধ করেছেন মিয়াজাকি, তার ভিজুয়াল দিয়ে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন