চলচ্চিত্রের কবি স্ট্যানলি কুবরিক

সাবরিনা স্বর্ণা

ছবি: মুবি ডটকম

চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে সেরা কে? কিংবা চলচ্চিত্রের কবি কে? সিনেমাপ্রেমীদের সঙ্গে চায়ের কাপের আড্ডায় হরহামেশাই এসব প্রসঙ্গ উঠে আসে। কিন্তু কেন বা কখন একজন সিনেমা নির্মাতাকে সেরা বলব বা বলব না, সে উত্তর আসলে আপেক্ষিক। তবে এটা বলা যায়, ব্যক্তি বিশেষে সেরা পরিচালকের তালিকায় যাদের নাম থাকে, তাদের সেরা না বলার খুব বেশি অবকাশ থাকে না। চলচ্চিত্র জগতে তেমনই এক পরিচালকের নাম ‘স্ট্যানলি কুবরিক’।

সাল ১৯২৮। এ বছর ২৬ জুলাই কুবরিক জন্মগ্রহণ করেন ম্যানহাটনে। মৃত্যুবরণ করেন ১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ। তখন তার বয়স ৭০ বছর। তিনি প্রায় ৫০ বছরের সুদীর্ঘ চলচ্চিত্র জীবনে নির্মাণ করেছেন ১৬টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। সংখ্যাটি অনেকের কাছে কম মনে হলেও আজ ২০২৪ সালে এসেও আমরা তার চলচ্চিত্র দেখি, তাকে নিয়ে আলোচনা করি। কারণ প্রতিটি সিনেমাকেই বলা হয় সিনেমা সম্পর্কিত পড়াশোনার একেকটি সেমিস্টার। 

কুবরিকের সিনেমার সবকিছু বড়ই মনোরম। যেখানে তার সমসাময়িক নির্মাতারা মনস্তাত্ত্বিক বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছিলেন মানুষের মনন বোঝার জন্য, সেখানে কুবরিক প্রাধান্য দিয়েছেন সমাজবিজ্ঞানকে। অর্থাৎ একজন মানুষের মন কীভাবে সমাজ কাঠামোর মধ্যে মিথস্ক্রিয়া করে। যেমন A Clockwork Orange সিনেমায় কুবরিক সুচতুরভাবে একটা সাইকেডেলিক বা বিকারগ্রস্ত চরিত্র ‘অ্যালেক্স’-এর মাধ্যমে দেখিয়েছেন রাষ্ট্রযন্ত্র কীভাবে মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রণ বা তাদের জীবনপ্রণালিতে হস্তক্ষেপ করে। কিংবা 2001: A Spece Odesy-তে দেখিয়েছেন মানুষের বিবর্তনের গল্প। 

সিনেমাটোগ্রাফি ও দৃশ্যায়নের আলাপ করা যাক। ক্যামেরার শট বা ফ্রেমিংয়ের ওপর নির্ভর করে একটি দৃশ্য আমরা কোন দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখব; শান্তি, উত্তেজনা না ভয়ের, নাকি অন্য কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে। ক্যামেরা হাতেও সফল কুবরিক। বর্তমানে আমরা যেটাকে ‘ক্লোজ শট’ বলি, তার সর্বোত্তম ব্যবহার করেছেন তিনি। 

2001: A Space Odesy ভিজুয়াল ক্যাটাগরিতে অর্জনও করে নিয়েছে অস্কার। অসাধারণ ফ্রেমিং তার সিনেমার আরেক বিস্ময়, যা সিনেমাকে সেরা করে তুলেছে দৃশ্যপ্রেমীদের কাছে। আলোকসজ্জাও তেমনি জরুরি, ফ্রেমিংকে সুন্দর করে তোলার জন্য। আলোকশৈলীও ছিল অসাধারণ কুবরিকের সিনেমায়। ‘ব্যারি লিন্ডন’ সিনেমাটি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এছাড়া সেট নির্মাণেও তিনি ছিলেন অসাধারণ। সাহস দেখিয়েছেন প্রথাগত মিউজিক বা সাউন্ডের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। যখন ‘হাল ৯০০০’ তার বিদ্রোহ শুরু করে ‘স্পেস ওডিসি’তে, তখন কুবরিক উত্তেজনা বাড়ানোর জন্য মিউজিক ব্যবহার করেননি। বরং প্রথাগত পদ্ধতির বাইরে নিঃশব্দতা দিয়ে উত্তেজনাকে ফোকাস করেন।

১৯৫১ সালে Flying Padre নামের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে হাতেখড়ি স্ট্যানলি কুবরিকের। এরপর Fear and Desire নামের অসাধারণ এক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। মাত্র ৬২ মিনিটের ওই ছবি দিয়ে ফিচার ফিল্মের জগতে প্রবেশ তার। একে একে নির্মাণ করেন The Killer’s kiss, The Killing, Paths of Glory, Spartacus-এর মতো অসাধারণ সব সিনেমা। ‘দ্য শাইনিং’ নির্মাণ করেন ১৯৮০ সালে। এরপর দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৮৭ সালে কুবরিক নির্মাণ করেন Full Metal Jacket এবং তারও একযুগ পরে তিনি নির্মাণ করেছেন তার শেষ ছবি Eyes Wide Shut. মূলত সব সিনেমা নির্মাণের জন্যই কুবরিক দীর্ঘ সময় নিয়েছেন। 

তিনি পুরো সময় একজন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন। অনেকে তাকে পৃথিবীর প্রথম ‘স্বাধীন চলচ্চিত্রকার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কুবরিক বলতেন, “A filmmaker has almos t the same freedom as a novelis t has when he buys himself some paper.”

তিনি একাধারে নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক, চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক ও আলোকচিত্রী। কুবরিক সিনেমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই আমাদের গল্প শুনিয়েছেন; বিশ্বসাহিত্যকে সুনিপুণ দক্ষতায় চলচ্চিত্রের রূপ দিয়েছেন। শেষ করব তার একটি উক্তি দিয়েই-

‘If it can be written or thought, it can be filmed’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন