প্রতিক্রিয়া

আন্দোলনের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করা গেলে উদ্ভূত পরিস্থিতি এড়ানো যেত

এম শামসুল আলম

ছবি : বণিক বার্তা ( ফাইল ছবি)

গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে যে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষে দুই শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই শিক্ষার্থী, যা অত্যন্ত উদ্বেগের। আরো উদ্বেগের এজন্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ককে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করেছেন বলে আমরা গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানতে পেরেছি। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে বর্তমানে যে অভিযান চালানো হচ্ছে তা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নয়। 

সার্বিকভাবে শিক্ষার্থীদের আট দফা দাবি সরকারের কাছে বিবেচনাধীন। এর মধ্যে অন্যতম ‘কোটা সংস্কার’ যা মেনে নেয়া হয়েছে। যেখানে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ নিয়োগ করা হবে। নিঃসন্দেহে এটি একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে শিক্ষার্থীদের আট দফা দাবি যৌক্তিক এবং তা বাস্তবায়ন কঠিন নয়। এ বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করলে লক্ষণীয়, এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে যা দুর্ভাগ্যজনক। কারণ, সরকারের শাসন বিভাগ বা নীতিনির্ধারণের বিষয়টি সরকারের এখতিয়ারভুক্ত হলেও তারা সেই ক্ষমতাবলে সর্বোচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়নি। এতে সরকারের বড় একটি দুর্বলতা প্রকাশ পায়। এ দুর্বলতা থেকে উদ্ভূত অন্যান্য সমস্যা এবং আট দফা দাবির পরম্পরায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে সার্বজনীনভাবে বিবেচনা না করলে সরকারের কোটা পদ্ধতির সংস্কার করা, আট দফা দাবি মেনে নেয়া, এমনকি বাস্তবায়নও হবে ‘লোকদেখানো’ সমাধান।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে ছাত্ররা শহীদ হয়েছিলেন। সেই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তদানীন্তন সরকারের মধ্যে নানা পরিবর্তন এসেছিল। সেসব পরিবর্তন যদি পর্যালোচনা করে বর্তমান আন্দোলনের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করা যেত ও সমাধান করা হতো তাহলে হয়তো বিপুল পরিমাণ ক্ষতি ছাড়াই জাতীয় সমস্যাগুলোর রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব হতো। 

ইতিহাস স্মরণ করে বলা যায়,  কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে দুই শতাধিক মানুষ মারা গেল, যা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোরনের  প্রেক্ষাপট থেকেও ভয়াবহ। 

কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী সমাজ প্রবর্তনের কথা উঠে এসেছে। ছাত্ররা তাদের নিরপেক্ষ বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা রাষ্ট্রের বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চেয়েছে। যে বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের পূর্বসূরিরা শহীদ হয়েছিলেন। আজকে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে কোটা নিয়ে যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে এবং যার পরিণতিতে রাষ্ট্রকে এ রকম এক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হলো, সেই সার্বজনীন বৈষম্যের বিরুদ্ধে এই আন্দোলনকে না দেখলে ভুল হবে। 

দেশে সার্বজনীন বৈষম্য প্রকট। আর এর দ্রুত বিস্তার ও সম্প্রসারণের মূলে রয়েছে আজকের ব্যবসা বাণিজ্য, রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে আপামর সাধারণ মানুষ বৈষম্যের শিকার। এই একটি বৈষম্যের সূত্রে যে বিস্ফোরণ ঘটল সেখান থেকে এতগুলো মানুষ, এতগুলো নবীন শিক্ষার্থী তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে জীবন দিয়ে প্রমাণ করলেন যে তারা জীবন দিয়ে ভুল করেননি; তারা সঠিক ছিলেন। সবশেষে সরকার মেনে নিয়েছে যে তাদের দাবিগুলো যৌক্তিক এবং তা বাস্তবায়ন কঠিন ছিল না। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, কেন এতগুলো প্রাণ ঝরল? কেন এ কথাগুলো আরো আগে আমরা বলতে পারলাম না? এটা জাতীয় দুর্বলতা বা আমাদের জাতীয় দৈন্যের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে চিহ্নিত হোক। পাশাপাশি সেসব জায়গা বিবেচনা করতে এবং সেই মোতাবেক বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তুলতে সমাজ ও সরকার প্রেরণা পাক—এই প্রত্যাশা রইল। এর বাইরে আর দুটি বিষয় বলা যায়। 

প্রথমত, সুপ্রিম কোর্টে রায় ঘোষণার পর একজন সংসদ সদস্য বলেছেন, ‘মেঘ হয় একখানে, বৃষ্টি ঝরে সুপ্রিম কোর্টে।’ সরকারের প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং সক্ষমতার অভাব হলে এ ধরনের উপমার উদ্ভব হয় যা সরকারকে বুঝতে হবে। 

দ্বিতীয়ত, ‘‌গ্যালিলিও’ নাটকে শাসক শ্রেণীর সঙ্গে সমঝোতা করে গ্যালিলিও যখন ফিরে এলেন তখন তার শিষ্যরা আহাজারি করে বলেছিলেন, যে জাতির বীর পুত্র থাকে না সে জাতি হতভাগা। উত্তরে গ্যালিলিও বলেছিলেন, যে জাতির বীর পুত্রের দরকার হয়, সে জাতি হতভাগা। আজকের প্রেক্ষাপট স্মরণ করে বলতে হয়, বিশেষ একজনকে বারবার সামনে এনে তিনি সব করতে পারেন, তিনি সব করেন, আর কারোর কিছু করার বা বোঝার নেই—এ রকমভাবে বীর পুত্র দরকার ও প্রয়োজন হিসেবে জাতিকে নির্দেশনা দেয়ার অর্থই হচ্ছে এই জাতি হতভাগা।

আমাদের সবাই যদি ভালো-মন্দ দায়দায়িত্ব নেয়ার অক্ষমতা থেকে বেরিয়ে সক্ষমতা অর্জন করার দৃষ্টান্ত তৈরিতে সক্ষম হতাম তাহলে উদ্ভূত পরিস্থিতি খুব সহজে এড়ানো যেত। আমরা সবাই মিলে অনেক আগেই সমস্বরে বলতে পারতাম শিক্ষার্থীদের দাবি যৌক্তিক ছিল, এটা মেনে নেয়া কঠিন ছিল না; হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ বা গাইডলাইন বেঁধে দিতে হতো না। 

এম শামসুল আলম: ডিন, প্রকৌশল অনুষদ, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়

জ্বালানি উপদেষ্টা, কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন