পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু—একটি অবহেলিত জাতীয় সংকট

ড. মো. ইদ্রিস আলম

ছবি: বণিক বার্তা

শিশু-কিশোরদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ পানিতে ডুবে মৃত্যু যা বর্তমানে একটি অবহেলিত জাতীয় সংকটবিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বছরে ২ লাখ ৩৬ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায় যার ৯০ শতাংশ ঘটছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোয়বৈশ্বিক তথ্য অনুযায়ী এক-চার বছরের শিশুরা পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি মারা যায় এবং দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ বয়স হলো পাঁচ-নয় বছর। ডব্লিউএইচওর ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ছেলে বাচ্চারা মেয়ে বাচ্চার তুলনায় দ্বিগুণ পানিতে ডুবে মারা যায়পানিতে মৃত্যু পরিহারযোগ্য তবে পানিতে ডুবে মৃত্যু পরিহারে প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে অপেক্ষাকৃত কম

বাংলাদেশের প্রথম স্বাস্থ্য এবং তথ্য জরিপ (২০১৩) অনুযায়ী, ১-১৭ বছরের শিশুদের অপমৃত্যুর প্রধান কারণ হলো পানিতে ডুবে মৃত্যু যা যৌথভাবে নিউমোনিয়া, অপুষ্টি এবং কলেরামৃত্যুর চেয়েও বেশিবাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাস্থ্য এবং তথ্য জরিপ (২০১৬) অনুযায়ী, বছরে ১৪ হাজার ৪৩৮ জন (১-১৭ বছর বয়সী) শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়শিশু মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো—১. বয়স্কদের তত্ত্বাবধানের অভাব, ২. গ্রামে শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রের অভাব, ৩. অতিদারিদ্র্য, ৪. পুকুর-জলাধারে নিরাপত্তা বেষ্টনির অভাব এবং ৫. সাঁতার না জানাবাংলাদেশে প্রায়৮-১০  বছরের বাচ্চাদের সাঁতার না জানার কারণে পানিতে ডুবে মারা যেতে দেখা যায় যদিও একটি সুস্থ বাচ্চাকে চার-পাঁচ বছর বয়স থেকে সাঁতার শেখানো উচিতপুকুর, ডোবা, খাল, বালতি এবং বাকেট ইত্যাদি জায়গায় বিভিন্ন বয়সী শিশুরা মারা যায়হোসাইন এবং তার সহযোগীরা (২০২২) গবেষণায় দেখান, পাঁচ বছর বয়সীদের ৮০ শতাংশ পানিতে ডুবে মৃত্যু ঘটে বসতঘর থেকে ২০ মিটার দূরত্বের মধ্যে পুকুর-জলাশয়ে আরো দুঃখজনক যে বাংলাদেশে একসঙ্গে একাধিক শিশু পানিতে ডুবে মারা যেতে দেখা যায়। একই পরিবারের জোড়া শিশু একই স্থানে পানিতে ডুবে মারা যায় সাধারণত একটি শিশু অন্য শিশুকে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার সময় বাঁচাতে গিয়ে একসঙ্গে মারা যায়এতে বোঝা যায়, শিশুকে পানি থেকে নিরাপত্তা কৌশল বিশেষত নিরাপদ উদ্ধার কৌশল সঠিকভাবে শিক্ষা দেয়া হয় না

ডিজাস্টার অ্যাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (দাদু) কর্তৃক ২০০৪ সালের মার্চে সন্দ্বীপে এক জরিপে দেখা যায় যে প্রতি ১০ পরিবারের মধ্যে অন্তত সাত পরিবারে কোনো না কোনো ধরনের পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। জরিপের ফল বিশ্লেষণ করে আরো দেখা যায়, পানিতে ডোবার ঘটনার সময়কালে শিশুর মা কোনো না কোনো পারিবারিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। অর্থাৎ শিশুটি কোনো অভিভাবক বা বড়দের তত্ত্বাবধানে ছিল না মায়েদের কর্মব্যস্ত সময়, বিশেষ করে সকাল ৯টা থেকে  বেলা ১টার মধ্যে শিশুদের একাকী খেলতে দেয়া হয়। একইভাবে দাদু কর্তৃক রংপুরে আরেকটি গবেষণায় দেখা যায়, শিশুদের মৃত্যুর পূর্ববর্তী কার্যক্রম ছিল তারা খেলছিল। খেলতে গিয়ে পানিতে ডুবে এই মৃত্যুকে পারিবারিকভাবে খুব গুরুত্ব দেয়া হয় নাসচেতনতার মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের ব্যস্ততার সময়ে শিশুরা এভাবে বাইরে একাকী খেলতে গিয়ে মৃত্যু অবশ্যই পরিহার করা সম্ভব

সচেতনতার অভাব, বয়স্কদের শিশু তত্ত্বাবধানের অভাব এবং অবহেলাকে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে গণ্য করা হয় ডব্লিউএইচও (২০১৭) পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু নিবারণে ছয়টি প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে যেমন—১. প্রাক-স্কুল বয়সী শিশুদের পানি থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ ২. পানিতে গমন পথে বেষ্টনী প্রদান ৩. সাঁতার শেখানো এবং পানি থেকে নিরাপত্তা কৌশলে প্রশিক্ষণ প্রদান ৪. বন্যা ও যেকোনো দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা ৫. পানি থেকে শিশুদের নিরাপদে উদ্ধার এবং সিপিআর প্রশিক্ষণ প্রদান ৬. বোট, জাহাজ এবং ফেরিতে নিরাপদে যাতায়াতে কার্যকর বিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন এবং প্রতিষ্ঠাকরণ। ওপরে উল্লিখিত ছয়টি নিবারণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে ডব্লিউএইচও চারটি কৌশল প্রণয়নের সুপারিশ করে যেমন—১. বিভিন্ন সেক্টরের কর্মকাণ্ডে সমন্বিতভাবে পানিতে ডুবে মৃত্যুর কথা বিবেচনা করা, ২. কৌশলগত যোগাযোগের মাধ্যমে গণসচেতনতা বৃদ্ধি, ৩. তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং গবেষণার মাধ্যমে পানিতে ডুবে মৃত্যু নিবারণে সৃজনশীল কৌশল প্রণয়ন, ৪. জাতীয় নিরাপত্তা নীতি প্রণয়ন করা ডব্লিউএইচও (২০১৭) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পানিতে ডুবে মৃত্যুহারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণসহ সাংবাদিক এবং গণমাধ্যমের কর্মীদে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের কথা বলেছেন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিক পানিতে ডুবে মৃত্যু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করছে২০২৩ সালের প্রতিবেদনে পানিতে ডুবে মৃত্যু সংশ্লিষ্ট মানবিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির দিক উল্লেখ করে নিবারণ কৌশল বাস্তবায়নে জোর দিয়েছেজাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার আমন্ত্রণে ডব্লিউএইচও বিশ্বব্যাপী পানিতে ডুবে মৃত্যু বিষয়ে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনে সম্মত হয়েছেএকই সঙ্গে ২০২৩ সাল থেকে প্রতি বছর ২৫ জুলাই বিশ্ব পানিতে ডুবে মৃত্যু পরিহার দিবস পালনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ডব্লিউএইচও জনস্বাস্থ্য কর্মসূচির আওতায় পানিতে ডুবে মৃত্যু পরিহার বিষয়ে জনসচেতনতা কার্যক্রম চালিয়ে যাবে২০২৩ সালের পানিতে ডুবে মৃত্যু নিবারণ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো-যে কেউ-ই পানিতে ডুবে যেতে পারে, কারো ডুবে যাওয়াই কাম্য নয়।’

প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি সংশ্লিষ্ট মৃত্যু মোকাবেলায় দেশব্যাপী বিভিন্ন প্রস্তুতি এবং নিবারণমূলক কার্যক্রম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে থাকলেও পানিতে ডুবে মৃত্যু বিষয়ে কার্যক্রম অত্যন্ত অপ্রতুলসেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) ২০০৬ এবং ২০১৩ সময়ে রায়গঞ্জ, শেরপুর এবং মনোহরদী উপজেলায় পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করে কমিউনিটি ডে কেয়ার সেন্টার (আঁচল) এবং সাঁতার প্রশিক্ষণকে কম খরচে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু নিবারণের কার্যকর কৌশল হিসেবে চিহ্নিত করছেউপর্যুক্ত দুটি নিবারণ কৌশলের সঙ্গে জনসচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করলে আরো বেশি সুফল পাওয়া সম্ভবপাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যু নিবারণে বাস্তবায়িত আরো একটি প্রকল্পে কোনো এলাকায় একই সঙ্গে বেষ্টনীযুক্ত খেলাঘর এবং শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র বাস্তবায়ন করলে শিশু মৃত্যু নিবারণে ভূমিকা রাখার প্রমাণ পাওয়া যায়বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালের স্বাস্থ্য নীতিতে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুকেও একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেশিশু নিরাপত্তায় পাইলট প্রকল্পে পানিতে ডুবে মৃত্যুও বিবেচনা করলেও সরকার কর্তৃক বাস্তবায়িত প্রকল্প এখনো সীমিত

ডিজাস্টার অ্যাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (দাদু) পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু নিবারণে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, জনসচেতনতা এবং মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সাঁতার প্রশিক্ষণ এবং জলাধার থেকে সুরক্ষা কৌশল শেখানো, অনিরাপদ জলাধারে বেষ্টনী প্রদান এবং কমিউনিটি ডে কেয়ার স্থাপনে কাজ করছে অর্থ সংকট, বাস্তবায়নের সক্ষমতার অভাব এবং অন্যান্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণে ডব্লিউএইচও কর্তৃক প্রদানকৃত নিবারণ কৌশলকে দেশব্যাপী বাস্তবায়নে সময়ের প্রয়োজন হতে পারে এ অবস্থায় ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমের মাধ্যমে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু নিবারণে ভূমিকা পালন করা যেতে পারে সমাজের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে আমরা সবাই শিশু মৃত্যু নিবারণে ভূমিকা পালন করতে পারিযেমন—১. শিক্ষা ঘর থেকে শুরু হয়—পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর বিষয়টি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেয়ার করা, ২. বাড়িতে শিশু পানি থেকে নিরাপদ কিনা পর্যবেক্ষণ, ৩. পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ভয়াবহতা পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন এবং প্রতিবেশীর সঙ্গে আলাপ, ৪. বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনার আড্ডায় অন্য বিষয়ের সঙ্গে এ বিষয়টি উপস্থাপন, ৫. প্রতিবেশীদের বাচ্চারা নিরাপদ কিনা পর্যবেক্ষণ, ৬. উঠান বৈঠকের ব্যবস্থা, ৭. জলাধারের পাশে বেষ্টনী প্রদানের ব্যবস্থা, ৮. নিজে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার এবং অন্যকেও উৎসাহিত প্রদান, ৯. আর্থিক সক্ষমতা থাকলে দরিদ্র পরিবারকে বেষ্টনীযুক্ত খেলাঘর প্রদান, ১০. শিশুদের সাঁতার শেখানোর ব্যবস্থা করুন (একটি সুস্থ বাচ্চা চার-পাঁচ বছর বয়স থেকে সাঁতার শেখা শুরু করতে পারে), ১১. ইউটিউ এবং স্বীকৃত প্রশিক্ষণকারীর কাছ থেকে সিপিআর প্রশিক্ষণ ১২. আপনার এলাকায় যুবকদের সমন্বয়ে ক্যাম্পেইন দল গঠন ১৩. জাতীয় জনসচেতনতা ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ ১৪. আপনার এলাকায় কমিউনিটি ডে কেয়ারের সম্ভাব্যতা যাচাই এবং পারলে বাস্তবায়ন করুন

পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু নিবারণে সরকারি ছাড়াও এনজিও, কমিউনিটি অর্গানাইজেশন এবং বেসরকারি খাতের কার্যক্রম এখনো সীমিতপানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু নিবার কৌশল বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ এবং অবদান রাখা জরুরি

ড. মো. ইদ্রিস আলম অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রধান নির্বাহী, ডিজাস্টার অ্যাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (দাদু)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন