বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার ভারত ও নেপালের চেয়ে দ্বিগুণ

শ্রীলংকায় মূল্যস্ফীতি মাত্র ১.৭ শতাংশ

ইয়াহইয়া নকিব

ছবি : বণিক বার্তা

দেশে জুনে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশে। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। জুনে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমলেও গ্রাম ও শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরেই ছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

বিবিএসের তথ্য বলছে, বিদায়ী অর্থবছরের শেষ দুই মাসে (মে-জুন) বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ছিল ভারত ও নেপালের চেয়ে দ্বিগুণ। আর শ্রীলংকার ছিল মাত্র ১.৭ শতাংশ। শুধু পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতির হার বাংলাদেশের চেয়ে কিছুটা বেশি। 

দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত অগ্রসরমাণ দেশ শ্রীলংকা নজিরবিহীন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলা করছে। দেশটি সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হয় ২০২২ সালে। দ্বীপরাষ্ট্রটির মূল্যস্ফীতি ঠেকে প্রায় ৬০ শতাংশে। রিজার্ভ সংকটে বন্ধ হয়ে যায় জ্বালানি তেলের মতো অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি। আমদানি দায় আর বিদেশী ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতায় নিজেদের দেউলিয়াও ঘোষণা করে শ্রীলংকা সরকার। কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক সে পরিস্থিতি দ্রুতই কাটিয়ে উঠছে শ্রীলংকা। মূল্যস্ফীতির হার কমতে কমতে গত জুনে নেমে আসে ১ দশমিক ৭ শতাংশে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, মে মাসে এ হার ছিল ১ শতাংশের নিচে। 

প্রতিবেশী দেশ ভারতের মূল্যস্ফীতিও দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমেছে। দেশটির নির্বাচনী মাস জুনের তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে ভারতের পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, মে মাসে দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। নেপালেও গত ৩১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে মূল্যস্ফীতি। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, মে মাসে নেপালের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। এক বছর আগে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৪১ শতাংশ। বাংলাদেশের চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি রয়েছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে থাকা পাকিস্তানে। দেশটির পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্যমতে, জুনে পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। 

কভিড-১৯ মহামারী আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ২০২২ সালের শুরুতে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১৩০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। অস্বাভাবিক হারে বাড়ে কয়লা, গ্যাসসহ অন্যান্য জ্বালানি পণ্যের দামও। ভোজ্যতেল, গমসহ অতিপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দামও ছিল ঊর্ধ্বমুখী। সঙ্গে যুক্ত হয় অস্বাভাবিক পরিবহন ব্যয়। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সংকটে পড়ে বিভিন্ন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। কিন্তু গত ছয় মাসে প্রায় সব দেশেরই মূল্যস্ফীতির চিত্র পরিবর্তন হয়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামও কমতে কমতে ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলারে নেমে এসেছে। ভোজ্যতেল, খাদ্যশস্য, সার, কৃষি খাতের কাঁচামাল, সার ও ব্যবহারিক বা শিল্প ধাতুর মূল্যও টানা কয়েক মাস ধরে কমছে। কিন্তু বিপরীত চিত্র দেশের বাজারে। বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্যসহ সব পণ্যের দাম এখনো অস্থিতিশীল। ফলে নিয়ন্ত্রণে আসছে না মূল্যস্ফীতির হার।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থবছরের শুরু থেকেই একের পর এক পদক্ষেপ নেয় সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংক খাতে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ থেকে কয়েক দফা বাড়িয়ে নেয়া হয় ১৪ শতাংশে। এখন বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ায় কোনো কোনো ব্যাংকে সুদহার ১৬ শতাংশের ওপরে উঠে গেছে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির অংশ হিসেবে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ প্রদানের নীতি থেকেও সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাজার নিয়ন্ত্রণে কয়েক দফায় নির্দিষ্ট কিছু নিত্যপণ্যের দরও নির্ধারণ করে দেয়া হয়। মজুদদারি নিয়ন্ত্রণে বারবার অভিযানেও নেমেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির অংশ হিসেবে নতুন অর্থবছরের বাজেটও আগের বছরের মতো সম্প্রসারণ করা হয়নি। এতসব প্রয়াস সত্ত্বেও দেশে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।

প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ দেরিতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করায় এমনটা হয়েছে বলে মনে করছেন গবেষণা ও নীতিসহায়ক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী। এছাড়া বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকেও একটি বড় কারণ হিসেবে দেখছেন তিনি। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এসব দেশ শক্ত হাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিয়েছিল। আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনায় অনেক দুর্বলতা রয়েছে। এখানে ক্ষমতাবান সিন্ডিকেট নিজেদের স্বার্থে বাজারের মূল্য শৃঙ্খলে প্রভাব বিস্তার করে। ফলে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। রাজস্ব ও অন্যান্য নীতিও সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।’

বিবিএসের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জুনে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি সামান্য কমেছে। তবে গ্রাম ও শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরেই রয়ে গেছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৪২ শতাংশে আর খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ১৫ শতাংশে। শহর এলাকায় খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৫৪ শতাংশ, খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ। গ্রামীণ এলাকায় খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৩৯ ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে ৯ দশমিক ২৬ শতাংশ। 

বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি নিয়ে ভীতির কোনো কারণ নেই বলে মনে করছেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এমএ মান্নান। বণিক বার্তাকে সম্প্রতি তিনি বলেন, ‘এক যুগ আগে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ শতাংশ। সেখান থেকে এখন তা ৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে শম্বুক গতিতে। একই সময়ে মানুষের আয়ও বেড়েছে। তাই মানুষ এটার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। গ্রামের লোকদের মধ্যেও এটা নিয়ে কোনো ভীতি দেখি না আমি। আর সরকার সুলভ মূল্যে এক কোটি কার্ডের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করছে। টিসিবি কম দামে পণ্য বিক্রি করছে। এসব পদক্ষেপ না থাকলে মূল্যস্ফীতি হয়তো ১৪-১৫ শতাংশে উঠে যেত। প্রবৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ে মূল্যস্ফীতি হয়; এটা মেনে নিতে হবে।’


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন