প্রধানমন্ত্রী চীন সফরে যাচ্ছেন আজ

দুই দেশের মধ্যে হতে পারে ২০-২২ সমঝোতা স্মারক সই

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চারদিনের সরকারি সফরে আজ চীন যাচ্ছেন। দেশটির প্রিমিয়ার অব দ্য স্টেট কাউন্সিল লি ছিয়াংয়ের আমন্ত্রণে যাওয়া এ সফরের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারত্ব থেকে কৌশলগত বিস্তৃত সহযোগিতা অংশীদারত্বে উন্নীত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ সময় দুই দেশের মধ্যে ২০-২২টির মতো সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। 

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি চার্টার্ড ফ্লাইট আজ বেলা ১১টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যাবে। বেইজিং সময় সন্ধ্যা ৬টায় বিমানটি বেইজিং ক্যাপিটাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের কথা রয়েছে। 

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর উপলক্ষে গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানান, চীনের প্রিমিয়ার অব দ্য স্টেট কাউন্সিল লি ছিয়াংয়ের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮-১১ জুলাই দেশটিতে সরকারি সফর করবেন। এ সময় তার সফরসঙ্গী হবেন অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী, তথ্য প্রতিমন্ত্রী, পররাষ্ট্র সচিব, অন্যান্য সচিবসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

চীন সফরে প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচি তুলে ধরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, আগামীকাল সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিন লিকুন সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। একই দিন প্রধানমন্ত্রী সাং-গ্রি-লা সার্কেলে অনুষ্ঠেয় একটি সম্মেলনে অংশ নেবেন। সম্মেলনটিতে অংশ নেয়ার জন্য বাংলাদেশ থেকে একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দলও চীন সফর করবে। ওইদিন রাতে তিনি বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত নৈশভোজে অংশ নেবেন।

সফরের তৃতীয় দিন ১০ জুলাই প্রধানমন্ত্রী গ্রেট হল অব দ্য পিপলে চীনের প্রিমিয়ার অব দ্য স্টেট কাউন্সিল লি ছিয়াংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। সাক্ষাতের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে একটি অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। একই স্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রিমিয়ার অব দ্য স্টেট কাউন্সিল দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলসহ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবে। এরপর দুই দেশের সরকারপ্রধানের উপস্থিতিতে ২০টির মতো সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে এবং কিছু প্রকল্প উদ্বোধনের ঘোষণা দেয়া হবে। অর্থনৈতিক ও ব্যাংক খাত, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, ডিজিটাল ইকোনমি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি খাতে সহায়তা, ষষ্ঠ ও নবম বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ নির্মাণ, বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্য রফতানি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পিপল টু পিপল কানেক্টিভিটি প্রভৃতি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য, আর্থিক সহায়তা এবং বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশ চীনের সহায়তা চাইবে।

ওইদিন বিকালে প্রধানমন্ত্রী গ্রেট হল অব দ্য পিপলে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। প্রধানমন্ত্রীর এ সফর উপলক্ষে বাংলাদেশ ও চীন একটি যৌথ বিবৃতি দেবে। পরদিন অর্থাৎ ১১ জুলাই বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন ত্যাগ করবেন। বেলা ২টায় তার ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে।

লিখিত বক্তব্য শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। চীন সফরে অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘চীন আমাদের বড় উন্নয়ন সহযোগী। গত কয়েক বছরে আমাদের অবকাঠামো উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। তাদের বিনিয়োগও আছে। দেশটির বিভিন্ন কোম্পানি এখানে অবকাঠামো গড়ে তুলতে কাজ করছে। আমাদের উন্নয়ন ইস্যুটাই প্রধান অগ্রাধিকার পাবে এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা অগ্রাধিকার পাবে। দুই দেশের মধ্যে ২০-২২টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হতে পারে।’

ঋণ চুক্তি এবং ঋণের পরিমাণ ও রিজার্ভের ক্ষেত্রে চীনের সহযোগিতা প্রসঙ্গে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সে রকম ঋণ চুক্তি নেই তালিকার মধ্যে। অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য আমাদের মধ্যে এমওইউ সই হবে।’ এ পর্যায়ে ঋণের পরিমাণ সম্পর্কে সাংবাদিকরা ধারণা চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘দেয়ার ইজ নো অ্যামাউন্ট। কারণ কোনো চুক্তি হচ্ছে না। অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য একটা এমওইউ হবে। সেই এমওইউর আলোকে ভবিষ্যতের চাহিদার ভিত্তিতে আমাদের প্রয়োজনের নিরিখে এবং আমাদের সমস্ত প্যারামিটার মিট হলে পরে তখন সেক্ষেত্রে ব্যাংকিং সেক্টর বা ইকোনমিক সেক্টরে কো-অপারেশন হবে। আর রিজার্ভের কথা বলছিলেন। আমাদের রিজার্ভ এখন ভালো হচ্ছে। রিজার্ভ ধীরে ধীরে বাড়ছে এবং এটি ক্রমেই বাড়তে থাকবে।’ 

দুই দেশের মধ্যে নতুন ধরনের একটা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘নানা দেশ নানা প্রস্তাব দেয়। সব প্রস্তাব আমরা সবসময় গ্রহণও করি না। আমাদের প্রয়োজনের নিরিখে এবং প্যারামিটার মিট করলে তখনই আমরা সেই সহায়তা গ্রহণ করি বা সেই প্রস্তাব গ্রহণ করি। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার পর আবার পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করতে চেয়েছিল। আরো অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আমাদের সহায়তা করতে চেয়েছিল, আমরা অনেক ক্ষেত্রে নিইনি। চীনের পক্ষ থেকে যেকোনো প্রস্তাব আমাদের জন্য অবশ্যই উৎসাহব্যঞ্জক। সেটি পরে ভেরিফাই করে আমরা পদক্ষেপ নেব। চীনকে আমাদের দক্ষিণাঞ্চলে বন্দর উন্নয়ন এবং সেখানকার উন্নয়নের জন্য আমরা চীনের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মধ্যে আছি। সেটি এবারো গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হবে। অতীতে যেসব চুক্তি হয়েছে, সেগুলো নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই ওয়ার্কিং লেভেলে আলোচনা হবে।’ 

চীনের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভে (জিডিআই) যোগদানের আলোচনা প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘মাল্টিল্যাটারাল ফোরামগুলো নিয়ে আমি এ মুহূর্তে কোনো বক্তব্য রাখতে চাই না। চীন বা অন্য দেশের পক্ষ থেকে যেসব ফোরামে আমাদের বিভিন্ন দেশ যোগ দেয়ার জন্য বলছে, সেটি নিয়ে আমি আজকে কথা বলতে চাই না। আমরা যেকোনো দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতায় বিশ্বাস করি।’

বাণিজ্য বৈষম্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য বৈষম্য অনেক বেশি। এ বৈষম্য মেটানোর জন্য আমরা যাতে আরো বেশি করে কৃষি ও অন্যান্য পণ্য রফতানি করতে পারি, এক্ষেত্রে অশুল্ক বাধাসহ অন্যান্য যে বাধা আছে সেগুলো যাতে তুলে নেয়া হয় এবং তাদের আমদানিকারকদের যাতে উৎসাহিত করা হয়, সেটি আমরা বলব।’

আওয়ামী লীগের সঙ্গে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে হওয়া সমঝোতা স্মারক প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির যে সমঝোতা স্মারক নবায়নের কথা রয়েছে সেটি এ সফরে হবে না। বরং পরে আওয়ামী লীগের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল, যার নেতৃত্ব দেবেন প্রেসিডিয়াম সদস্য, তারা চীনে যাবে। সে সময়ে এটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।’

তিস্তা নদীতে প্রকল্প নিয়ে চীন ও ভারতের আগ্রহ প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘দেখুন, তিস্তা নদী ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ নদী। এ যৌথ নদী ব্যবস্থাপনার জন্য ভারত একটি প্রস্তাব দিয়েছে। একই সঙ্গে ভারত একটি টেকনিক্যাল টিমও পাঠাবে, এ মর্মে আমাদের জানিয়েছে। সেখানে যৌথভাবে সমীক্ষা করে কী করা প্রয়োজন সেটি নির্ধারণ করবেন। যেহেতু দুই দেশের যৌথ নদী এবং যাদের সঙ্গে আমাদের যৌথ নদী, তাদের প্রস্তাব আছে, সুতরাং আমাদের প্রথমে সেই প্রস্তাব বিবেচনা করতে হবে স্বাভাবিকভাবেই। চীনও প্রস্তাব দিয়েছে, সেটি খুব ভালো। যেহেতু ভারত প্রস্তাব দিয়েছে আমরা মনে করি সেটি ভালো দিক, যেহেতু আমাদের দুই দেশের যৌথ নদী।’ 

কৌশলগত অংশীদারত্ব প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘২০১৬ সালের পর আমাদের সম্পর্ক অনেক উন্নত হয়েছে। ২০১৬ সালের পর আমাদের সম্পর্ক দ্বিতীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে বলে আমি মনে করি।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন