প্রধানমন্ত্রীর দুই দিনের ভারত সফর

নয়াদিল্লিতে শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদি বৈঠক আজ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গতকাল নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানানো হয় ছবি: বাসস

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে দ্বিপক্ষীয় এক আনুষ্ঠানিক বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে আজ। নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউজে অনুষ্ঠেয় এ বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে ১০টির বেশি চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই ও নবায়ন হতে পারে। পরে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দুই নেতার প্রেস বিবৃতি প্রকাশ করা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দুই দেশের সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (সেপা) নিয়ে আলোচনা এগিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেয়া হতে পারে। এ চুক্তি সই হলে দুই দেশের বাণিজ্যে ভারসাম্য আসার পথ সুগম হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়া দ্বিপক্ষীয় ঋণচুক্তি বাস্তবায়নের গতি ত্বরান্বিত করা নিয়েও যৌথ ঘোষণা আসতে পারে। আলোচনা হতে পারে দুই দেশের মধ্যে কানেক্টিভিটি ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা নিয়েও। দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র  সম্প্রসারণের পাশাপাশি তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি, সীমান্ত হত্যা পুরোপুরি বন্ধের মতো বিষয়ও আলোচনায় স্থান পেতে পারে। এর আগে গত মে মাসে ঢাকা সফরে আসা ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয়মোহন কোয়াত্রার সঙ্গে আলোচনার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ভারত তিস্তার প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহী। এর ধারাবাহিকতায় ভারতের পক্ষ থেকে তিস্তার ব্যাপারে নতুন একটি প্রস্তাবও আসতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী এখন দুইদিনের এক রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে অবস্থান করছেন। শেখ হাসিনা ও তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট গতকাল বেলা ২টা ৩ মিনিটে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করে। প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে তাকে বিদায় জানান মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, তিন বাহিনী প্রধান ও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এরপর প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী ফ্লাইট নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দরে অবতরণ করে স্থানীয় অনুযায়ী বেলা সাড়ে ৩টায়। সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানান ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কীর্তিবর্ধন সিং। এ সময় ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাসহ দেশটির উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। 

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনা চলছিল গত এপ্রিল থেকেই। এরপর মে মাসে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয়মোহন কোয়াত্রা ঢাকায় এলে সফরের সময় ও আলোচ্যসূচি নিয়েও আলোচনা হয়। এরপর চলতি মাসে নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগদান করে দেশে ফিরে দ্বিপক্ষীয় সফরের বিষয়টি নিশ্চিত হয়। 

প্রধানমন্ত্রীর সফরের প্রথম দিনে গতকাল সন্ধ্যায় তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর। সাক্ষাৎ শেষে দুই দেশের অংশীদারত্বকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার ভূমিকার প্রশংসা করেন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

এক এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলে তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পেরে আমি আনন্দিত। ভারতে তার রাষ্ট্রীয় সফরের মধ্য দিয়ে আমাদের ঘনিষ্ঠ ও চিরস্থায়ী সম্পর্ক আরো গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে। বিশেষ এ অংশীদারত্বকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার দিকনির্দেশনামূলক ভূমিকার প্রশংসা জানাচ্ছি।’

এ বৈঠক সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘দুটি দেশেই নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। দুটি দেশে নতুন করে অংশীদারত্বটাকেও আরো কীভাবে এগিয়ে নেয়া যায়, সে বিষয়ে কথা হয়েছে। ড. জয়শঙ্কর বলেছেন, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক যে উচ্চতায় গেছে সেটিকে তারা আরো নতুন একটা অধ্যায়ে নিয়ে যেতে চান, বিশেষ করে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। তারা লজিস্টিকস, জ্বালানি ও কানেক্টিভিটি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আরো গভীরতর গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে চায়।’

তিনি আরো বলেন, ‘সাক্ষাৎ চলাকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে এ সম্পর্ক নতুন করে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে শুধু ভারতের সঙ্গে নয়; দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও একই সঙ্গে আমরা আমাদের কাজ করতে পারি। সেটি হলো আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারি এবং আমরা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা আছে দুইদিকে; সেগুলো আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শেষ করতে পারি। প্রধানমন্ত্রী যেসব ক্ষেত্রে আরো কাজ করার বিষয়ে আলোচনা করেছেন, সেগুলো হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ ও পাবলিক ডেলিভারি সিস্টেমকে কীভাবে উন্নত করা যায়। এছাড়া আমাদের দুই দেশের প্রকল্পগুলোকে দ্রুততার সঙ্গে এবং সহজতরভাবে নিষ্পত্তি কীভাবে করা যায়, সেই বিষয়ে তারা একমত হয়েছেন।’ 

মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, ‘বিমসটেকের ক্ষেত্রে নতুন ভূমিকা নেয়ার জন্য ড. জয়শঙ্কর প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন। আগামী সেপ্টেম্বরে থাইল্যান্ডে যে বিমসটেক সভা হবে, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি আশা করেছেন তিনি। তারা একমত হয়েছেন যে বিমসটেককে শক্তিশালী করলে আমাদের অর্থনৈতিক, ব্যবসা কানেক্টিভিটি, ডিজিটাইজেশন সব দিক থেকে বাংলাদেশ অনেক বেশি উপকৃত হবে।’

প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর দুই দেশের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকে যোগ দেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান উপস্থিত ছিলেন।

পরে ওই বৈঠক নিয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সালমান এফ রহমান বলেন, ‘আজকে কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজের (সিআইআই) সিইওদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দেখা হলো। বাংলাদেশ থেকে যে ব্যবসায়ীরা এসেছেন এফবিসিসিআইয়ের নেতৃত্বে, ওনাদের সঙ্গেও আলোচনা বিনিময় হয়েছে। সিআইআইয়ের সিইওরা প্রত্যেকেই জানিয়েছেন, তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চান। তারা বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা করতে চান। অনেকেই ব্যবসা করছেন। তারা ব্যবসাটা বাড়াতে চাচ্ছেন। সিআইআইয়ের তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে বলা হয়েছে যে বিভিন্ন খাতে তারা এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গে কাজ করতে চায়। প্রধানমন্ত্রী তাদের সবাইকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন প্রতিবেশীরাই সবার আগে। আমাদের যতগুলো প্রতিবেশী দেশ আছে সবগুলোকে তিনি প্রাধান্য দিতে চান। তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে আপনারা আসুন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করুন। আমাদের ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে, সেখানে তাদের বিনিয়োগ করার জন্য বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।’ 

এর আগে চলতি মাসেই নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর গতকাল শুরু হওয়া সফরটি নিশ্চিত হয় গত ১৪ জুন। সফরসূচি অনুযায়ী, আজ শীর্ষ দুই নেতা একান্ত বৈঠক করবেন। এছাড়া প্রতিনিধি পর্যায়ে আলোচনাও অনুষ্ঠিত হবে। 

প্রধানমন্ত্রী গতকাল দিল্লি পৌঁছানোর পর এক এক্স হ্যান্ডেলে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার রাষ্ট্রীয় সফরে নয়াদিল্লি পৌঁছেছেন। বিমানবন্দরে তাকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী কীর্তিবর্ধন সিং। বাংলাদেশ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ও বিশ্বস্ত প্রতিবেশী। তার এ সফর দ্বিপক্ষীয় অংশীদারত্বকে আরো জোরালো করে তোলার ক্ষেত্রে আরো উৎসাহব্যঞ্জক ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা করা যায়। 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আজ দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর ১০টিরও বেশি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে অন্তত ১০টি চুক্তি ও এমওইউ সই হতে পারে। চারটির মেয়াদ শেষে নবায়ন হওয়ার কথা রয়েছে। এসব চুক্তি ও এমওইউর মধ্যে রয়েছে জ্বালানি, সংযুক্তি, অর্থনীতিসহ সহযোগিতার নানা খাত।

আজ সকালে প্রধানমন্ত্রীকে নয়াদিল্লির ফোরকোর্টে রাষ্ট্রপতি ভবনে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা দেয়া হবে। সেখানে তিনি সশস্ত্র সালাম গ্রহণ ও গার্ড অব অনার পরিদর্শন করবেন। এছাড়া রাজঘাটে অবস্থিত মহাত্মা গান্ধীর সমাধিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এছাড়া প্রধানমন্ত্রী আজ বিকালে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখারের সঙ্গে তার সচিবালয়ে সাক্ষাৎ করবেন। এরপর পুনরায় ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে যাবেন তিনি। সেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে তার একান্ত সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

দুদিনের এ সফর শেষে প্রধানমন্ত্রীর আজ স্থানীয় সময় অনুযায়ী সন্ধ্যায় বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ ফ্লাইটযোগে ঢাকার উদ্দেশে নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দর ত্যাগ করার কথা রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন