জাতীয় নদী সম্মেলনে বক্তারা

নদী ধ্বংস করে শিল্পায়ন চলছে জেলা-উপজেলায়ও

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

বিভাগীয় শহরের মতো বর্তমানে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে নদী ধ্বংস করে শিল্পায়ন চলছে। নদী দখলে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাও জড়িত। নদী মেরে ফেলার ক্ষেত্রে দায় আছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের। এ অবস্থায় প্রতি জেলায় সংকটপূর্ণ নদীর তালিকা তৈরি করে দখল ও দূষণ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। নদীসংক্রান্ত সব প্রকল্পে সম্পৃক্ত করতে হবে নদীপাড়ের মানুষদেরও।

রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে ‘জাতীয় নদী সম্মেলন ২০২৪’-এ বক্তারা এসব কথা বলেন। পরিবেশবাদী পাঁচ সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা), পানি অধিকার ফোরাম, রিভারাইন পিপল ও বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল দুই দিনব্যাপী এ সম্মেলন আয়োজন করে। গতকাল সম্মেলনের শেষ দিনে প্রধান অতিথি ছিলেন নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও ইমেরিটাস  অধ্যাপক আইনুন নিশাত।

সম্মেলনে বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘প্রতি জেলায় একটি করে সংকটপূর্ণ নদীর তালিকা তৈরি করে দূষণ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। আর নদী থেকে বালি উত্তোলনের রাজনৈতিক অর্থনীতি রয়েছে। ২০২১ সালে সোমেশ্বরী নদী ইজারা দেয়া হয় মাত্র ২৩৫ কোটি টাকায়। ২৫৬ জন ইজাদারের মাঝে এত অল্প টাকায় নদীটি দিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু নদীর মূল্য এর চেয়ে অনেক বেশি।’

তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক নদীর স্বাস্থ্যগত অবস্থা জানার জন্য হেলথ কার্ড করা প্রয়োজন। আর দেশের নদীগুলো মেরে ফেলার ক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটা দায় রয়েছে।’ নদী দখলকারীদের কেন নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হয়, সে প্রশ্নও তোলেন বেলার প্রধান নির্বাহী।

রিভারাইন পিপলের পরিচালক অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘নদীর সর্বনাশ করছে ভূমি মন্ত্রণালয়। জেলা প্রশাসকদের সম্মতিতে ব্যক্তিমালিকানায় চলে যাচ্ছে নদী। আর রেকর্ড সংশোধনের মামলা হলে নদীর মালিকানা ২০ বছরের জন্য ঝুলে যায়। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। এখানে বছরে ক্ষতি ১ লাখ কোটি টাকা। অথচ ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলে এ ক্ষতি এড়ানো সম্ভব। ভারত ২০১৪ সাল থেকে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে এখন আবার তিস্তায় অর্থায়নের কথা বলছে। এটা হতে পারে না।’

নদী সংগঠক রণজিৎ দত্ত বলেন, ‘পদ্মার দিকে তাকালে বুক শুকিয়ে যায়। মনে হয়, পদ্মা কী হারিয়ে যাবে? অন্যদিকে কীর্তনখোলায় অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যাচ্ছে। পাশেই কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি রয়েছে। তাই নদীতে এখন কোনো মাছ পাওয়া যায় না। ফলে আমাদের অঞ্চলে ধানও নেই, মাছও নেই।’

খুলনা অঞ্চলের নদীর বিষয়ে সাংবাদিক গৌরাঙ্গ নন্দী বলেন, ‘এখান ১৫টি নদী প্রায় মরে গেছে। নদীকে বেঁধে ফেলা হয়েছে। সুন্দরবনের পাড়ে মাটি ফেলায় সুন্দরবনে আগুন লাগছে।’

নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান সারোয়ার মাহমুদ বলেন, ‘নদীর সংখ্যা ও সংজ্ঞা নিয়ে হয়তো বিতর্ক আছে। তবে নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই আমাদের নদী রক্ষা করতে হবে। নদীকে দূষণ ও দখলমুক্ত করাই আমাদের প্রধান কাজ। তাই সবাই মিলে আসুন আন্দোলন গড়ে তুলি।’ 

এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, ‘ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। নদীসংক্রান্ত সব প্রকল্পে নদীপাড়ের মানুষদের সম্পৃক্ত করতে হবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাও নদী দখলে জড়িত। দখলের শহুরে মডেল এখন জেলা-উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ছে।’

নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘নদী রক্ষা করেই শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে নদী ধ্বংস করে এসব করা হচ্ছে। নদী রক্ষার যুদ্ধে শুরু হয়েছে। এ যুদ্ধে জয়লাভ করতে হবে। ঢাকার চারপাশের নদী উদ্ধার করতে গিয়ে দেখেছি শক্তিশালী ব্যক্তিরা দখলে জড়িত। সোমেশ্বরী নদীর ছবি দেখে আমার চোখে পানি এসেছিল। তখন এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক আমি পানিসম্পদমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলি। সেখানে অবৈধ বালি উত্তোলন আমরা বন্ধ করতে পেরেছিলাম।’

সভাপতির বক্তব্যে আইনুন নিশাত বলেন, ‘পদ্মা সেতুর প্রভাব নিয়ে এখনো আমরা নিশ্চিত নই। নদীর বৈশিষ্ট্য হলো নদী ভাঙবে। যদি না ভাঙে, বুঝতে হবে সমস্যা আছে। নদী বৃদ্ধ হয়ে গেলে ভাঙনের শক্তি হারিয়ে ফেলে। আর স্থানীয়দের মতামত ছাড়া নদীপাড়ে প্রকল্প করা হলে ক্ষতিপূরণে বৈশ্বিক তহবিল পওয়া যাবে না।’ 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন