কপোলার চার দশকের স্বপ্ন ‘মেগালোপলিস’

ফিচার ডেস্ক

ছবি: গুডনিউজ ফিলিপিনাস

‘আমি ভয় পাই, হয়তো খুব সিরিয়াস একটা বিষয় নিয়ে কোনো হতাশাজনক সিনেমা বানিয়ে ফেলব।’ ১৯৭৮ সালে ‘অ্যাপোক্যালিপস নাউ’ নির্মাণের সময় হলিউডের দাপুটে নির্মাতা ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার কথা এটি । কিন্তু তার শঙ্কাকে মিথ্যা করে দিয়ে সিনেমাটি কেবল ভালোই হয়নি, তৈরি করেছে ইতিহাস। ‘দ্য গডফাদার’ ট্রিলজি ও ‘ব্রাম স্টোকারস ড্রাকুলা’-র মতো সিনেমা দিয়ে তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। কপোলার বয়স এখন ৮৫ বছর, ক্যারিয়ারের এ প্রান্তে দাঁড়িয়ে তিনি যেন শেষবারের মতো বাজি রাখলেন। তার উৎকৃষ্ট প্রকাশ বহুল প্রতীক্ষিত সিনেমা মেগালোপলিস। 

কপোলা সায়েন্স ফিকশনধর্মী সিনেমা মেগালোপলিস প্রদর্শিত হলো কান চলচ্চিত্র উৎসবে। সিনেমার ব্যাপ্তি ছিল ২ ঘণ্টা ২০ মিনিট। ছোটখাটো জায়গা নিয়ে দর্শকের বিপত্তি থাকলেও অধিকাংশ দর্শকই তাকে ভাসিয়েছেন প্রশংসায়। দাঁড়িয়ে সম্মাননা জানানো হয় ৭ মিনিট। আপ্লুত কপোলা বলেন, ‘আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। এ মুহূর্তে ঠিক কেমন বোধ করছি, তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।’

প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে বাস্তবে রূপ নিল দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন, যা নিয়ে তিনি কাজ করে চলছেন চার দশক ধরে। দফায় দফায় লেখালেখির কাটছাঁট, নতুন প্রজেক্টের ব্যস্ততা কিংবা বিভিন্ন কারণে ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ায় এগােনো হয়নি। শেষ পর্যন্ত নিজের সম্পদ বিক্রি করে তহবিল তৈরি করেছেন তিনি। তার পরও হাল ছাড়েননি। সিনেমাটি নির্মাণ পরিস্থিতি অনেকটাই অ্যাপোক্যালিপস নাউয়ের সঙ্গে তুলনীয়। সে সিনেমার মতো এক্ষেত্রেও অনেক সময় চলে গেছে, অর্ধেক কাজ করে সরে গেছেন কেউ কেউ। নানা ইস্যুতে জটিল হয়ে পড়েছে পরিস্থিতি। 

কপোলা নিজে মেগালোপলিসকে স্বপ্নের পাণ্ডুলিপি বলে আখ্যা দিয়েছেন। অ্যাপোক্যালিপস নাউ নির্মাণের সময়ই মাথায় মেগালোপলিসের চিন্তা এসেছিল তার। গল্প আবর্তিত হয়েছে একজন স্থাপত্যবিদকে ঘিরে, যিনি অর্থনৈতিক সংকটে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া নিউইয়র্ক শহরের মেট্রোপলিটন হাব পুনর্নির্মাণে যুক্ত হন। সেখানে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় মেয়র। গল্পে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন শিয়া লাবেউফ, অব্রে প্লাজা, ডাস্টিন হফম্যান, জন ভয়েট, লরেন্স ফিশবার্ন। উঠে এসেছে রাজনীতি, বর্ণ, স্থাপত্য, দর্শন, ভালোবাসার মতো নানা অনুষঙ্গ। 

১৯৮২ সালে কপোলার সিনেমা ‘ওয়ান ফ্রম দ্য হার্ট’ বাণিজ্যিকভাবে ব্যর্থ হয়। সিনেমাটিতে তিনি নিজে বিনিয়োগ করেছিলেন। সে সময় তিনি একটা ট্রেলার তৈরি করেন বিদ্যমান প্রযুক্তিগত অগ্রগতি বোঝার জন্য। তখন থেকেই চলেছে আলোচনা ও প্রচেষ্টা। কপোলার সাউন্ড ডিজাইনার রিচার্ড বেগস বলেন, ‘আশির দশকেই তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত বলেছেন। তার চোখ তখনই ছিল অনেক দূরে। ২০০১ সালের দিকে বেশকিছু শুটও নেয়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তখনই ঘটে নাইন-ইলেভেনের ঘটনা। তারপর আরেক দফা ধাক্কা লাগে। কারণ তার ভাষ্য অনুসারে, গল্প আবর্তিত হয়েছে যাকে ঘিরে, সেখানকার অবস্থাই খারাপ থাকলে তো চলবে না। সেই থমকে যাওয়া কাজ ২০২২ সালে গিয়ে শুটিং শুরু হয়। কপোলার ব্যাপারে বলতে গিয়ে ব্রিটিশ পরিচালক মাইক ফ্রিগিস বলেন, ‘আমি বুঝতে পারি না, আসলে ফ্রান্সিসের এত শক্তি আসে কোথা থেকে। সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন কপোলা।’ 

তবে সিনেমার কাজ করার সময় কিছু কিছু বিষয় ছিল নজরে আনার মতো। এমনও সময় গেছে, যখন ১০ মিনিটে নেয়ার মতো সিনটা নিতেও অর্ধেক দিন চলে গেছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও গতি ছিল খুবই মন্থর। তার মধ্যে আবার শুটিংয়ের সময় তার স্ত্রী ইলিয়ানর অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘ সময় তিনি তার স্বামীর সঙ্গে সেটেই ছিলেন। সম্প্রতি মারা যান এ নারী। সবকিছুকে পাশ কাটিয়েই কানের আসরে দর্শককে মুগ্ধ করল তার চলচ্চিত্র। কেউ মনে করছেন, মেগালোপলিস ইতিহাস হয়ে থাকবে পিকাসোর গুয়ের্নিকা কিংবা আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্রের মতো। তবে কেউ সমালোচনা করেনি, তা নয়।

কোনোটাই কপোলার জন্য নতুন নয়। নানা বিশৃঙ্খলার পরও ১৯৭৯ সালে পাম ডি’অর জিতেছিলেন কপোলা। নিজের সৃষ্টিকর্মের জন্য সে সময় প্রায়ই তাকে নানাভাবে সমালোচনা শুনতে হয়েছে। কিন্তু বছর দশেক পরে সবাই টের পেয়েছে তার সৃষ্টির অনন্যতা। কপোলা যেন তার সময়ের চেয়ে এগিয়ে। মেগালোপোলিসের নিয়তিতে তেমনটা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তার চেয়ে বড় কথা, ফলাফল যা-ই হোক, কপোলা তার স্বপ্নকে মরতে দেননি। সব বিপত্তিকে পেরিয়ে তিনি স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। চলেছেন নিজের আঁকা পথে। যেমনটা ২০১০ সালে বলেছিলেন, ‘আমি যা চেয়েছি, করেছি। অন্যরা যা চেষ্টাও করেনি বলে আফসোস করে, আমি তা কাজে পরিণত করেছি। কারণ দিনশেষে আমরা সবাই মারা যাব। আর চেষ্টা না করার জন্য কেউ পুরস্কৃত হয় না।’

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন