ঈদে মসলা বাজারের হালচাল

সুজিত সাহা

ছবি : সংগৃহীত

শবেবরাতের আগের দিন থেকেই অনেকটা আনুষ্ঠানিকভাবে রমজানের পণ্য বিকিকিনি শুরু হয়। রোজার নিত্য ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি ঈদকে কেন্দ্র করে থাকে মসলাপণ্য নিয়ে বাড়তি ভাবনা। রোজার পাশাপাশি ঈদের সময়ে প্রায় সপ্তাহব্যাপী খাবার আয়োজনে ড্রাই ফ্রুটসের পাশাপাশি মসলার ব্যবহার থাকে সবচেয়ে বেশি। খাবারের রকমভেদে একেক অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন খাবার তৈরিতে দেশী-বিদেশী নানান মসলার ব্যবহার করে বাঙালিরা।

মূলত ঈদের বাজার সদাইয়ের সময় খুচরা বাজারের পাশাপাশি পাইকারি বাজারেও চাপ পড়ে মসলাপণ্য ক্রয়ে। দেশীয় সাধারণ মসলা ছাড়াও আমদানীকৃত বিদেশী মসলার চাহিদা থাকে অনেক। বিদেশ থেকে আমদানি হওয়া সাধারণ মসলা ও আমদানীকৃত দামি মসলাও নির্দ্বিধায় কেনে সাধারণ মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে প্রায় সব শ্রেণীর মানুষ। যার কারণে ঈদের মসলার বাজারও থাকে কিছুটা অস্থিতিশীল। বিশেষত যেসব পণ্যের আমদানি সংকট কিংবা সরবরাহে ঘাটতি থাকে সেসব মসলার দাম ঈদকে সামনে রেখে বেড়ে যায়। ঈদুল ফিতরের সময়েই অধিকাংশ বাঙালি পরিবারে কোরবানির ঈদের আগাম মসলা সংগ্রহের প্রস্তুতি শুরু হয়। তবে এ সময়ে এসে মসলার ক্ষেত্রে দেশীয় মসলাকেই গুরুত্ব দেয় মানুষ।

শুকনো গরমমসলা পণ্যের মধ্যে মরিচ, হলুদ, ধনিয়া, কালিজিরা, মিষ্টি জিরা, তেজপাতা, সরিষা দেশে উৎপাদিত হয়। এছাড়া আমদানি করা হয় জিরা, দারচিনি, লবঙ্গ, গোলমরিচ, স্টার মসলা, রাঁধুনি, জায়ফল, জয়ত্রী ইত্যাদি। বাঙালি রান্নায় হলুদ-মরিচের পর সবচেয়ে বেশি মসলা হিসেবে ব্যবহার হয় ধনিয়ার। পরের ধাপে রয়েছে যথাক্রমে জিরা ও দারচিনি। এছাড়া ঈদের কিংবা যেকোনো সময়ের স্পেশাল রান্নায় ব্যবহার হয় এলাচ, গোলমরিচ, লবঙ্গ, কালিজিরা, সরিষা। বাকি মসলাগুলোর আর্থিক সংগতি অনুসারে ক্রয় করে ভোক্তারা।

চলতি বছর রোজার শুরুতে দেশে গরমমসলার বাজার ছিল চড়া। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় গরমমসলার দাম কেজিপ্রতি ২০ টাকা থেকে কয়েকশ টাকা পর্যন্ত বাড়তি বিক্রি হয়েছে রোজার শুরুতে। তবে রোজার মাঝামাঝিতে মসলার দাম কমে আসতে থাকে। দেশীয় উৎপাদন মৌসুমের কারণে মরিচ ও হলুদের দাম সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। তাছাড়া প্রধান গরমমসলা জিরার বাজার এক বছরের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ দামে বিক্রি হলেও সেটি এখন অর্ধেকে নেমে এসেছে। ডলারের সংকট ও এলসি সংকট কমে আসায় দারচিনিসহ অন্যান্য গরমমসলার বাজারও স্থিতিশীলতায় ফিরতে শুরু করেছে, যা ঈদের গরমমসলার বাজারে ভোক্তাদের স্বস্তি এনে দেবে। 

দেশে শুকনো মসলাপণ্যের অন্যতম জিরার দাম ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে। এক বছর আগেও প্রতি কেজি জিরা বিক্রি হতো ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে। তবে সর্বশেষ ছয় মাসে পণ্যটির দাম বাড়তে বাড়তে কেজিপ্রতি ১ হাজার ২০০ টাকায় গিয়ে ঠেকে। যদিও প্রায় এক মাস ধরে জিরার কেজিপ্রতি দাম অর্ধেক কমে ৬০০ টাকার মধ্যে চলে এসেছে। ঈদের বাজারে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকার মধ্যে ক্রয় করতে পারবে ভোক্তারা। এছাড়া সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় মরিচের দাম কেজিপ্রতি ৫০০ টাকা ছাড়িয়ে গেলেও বর্তমানে সেটি কমে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে লেনদেন হচ্ছে। হলুদের বাজারও বেড়ে কেজিপ্রতি ৩০০ টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছিল। বর্তমানে সেটি কমে ২২০ থেকে ২৩০ টাকার ঘরে নেমেছে। শতভাগ আমদানি হওয়া দারচিনির বাজার কয়েক মাস আগেও কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছিল ৪০০ টাকার বেশি দামে। বর্তমানে দাম কমে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে।  

মেথি বিক্রি হচ্ছে সর্বনিম্ন ১২০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৫০ টাকায়, কালিজিরা  ৩০০ টাকায়, এলাচ মানভেদে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার টাকায়, লবঙ্গ দেড় হাজার টাকায়, গোলমরিচ ৭৫০-৮০০ টাকায়, জয়ত্রী কেজিপ্রতি ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকায় (মানভেদে) এবং জায়ফল বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৬৫০-৬৬০ টাকার মধ্যে। অন্যদিকে প্রতি কেজি সরিষা ৬০-৭০ টাকায়, ধনিয়া বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৫০ টাকায়, তেজপাতা বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৫০ টাকায়, মিষ্টি জিরা ১৮০-২০০ টাকায়। 

পাইকারি মসলা ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদের বাজারে মসলাপণ্যের মধ্যে রোজার শুরুতেই হলুদ ও মরিচ সংগ্রহ করে ভোক্তারা। অধিকাংশ পরিবারে আস্ত হলুদ-মরিচ কিনে মেশিনে গুঁড়ো করা হয়। ফলে ঈদের আগে হলুদ-মরিচ সংগ্রহের তেমন একটা প্রয়োজন হয় না। তবে ঈদকে সামনে রেখে ভোক্তারা জিরা, দারচিনি, এলাচসহ দামি মসলাপণ্যই সবচেয়ে বেশি কেনে। মূলত বিভিন্ন পদের মাংস রান্না, বিরিয়ানি, চটপটিসহ ঝাল রান্নায় গরমমসলার ব্যবহার হয়। এছাড়া শুকনো খাদ্য ও মিষ্টিজাতীয় খাবার রান্নায় মসলার ব্যবহার করে মানুষ। এর মধ্যে পায়েস, ফিন্নি, জর্দা ভাত, সেমাই রান্নায় এলাচ, দারচিনির ব্যবহার হয়।

বর্তমানে দেশের বাজারে খুচরার পাশাপাশি পাইকারিতেও মসলাপণ্যের চাহিদা বেড়েছে। জানতে চাইলে দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স গুলিস্তান ফিডের স্বত্বাধিকারী

 মো. ওমর ফারুক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌রোজা ও ঈদের আগে মসলার চাহিদা বেশি থাকে। সব শ্রেণীর মানুষ এ সময়ে মসলা কেনে। প্রধান প্রধান মসলাপণ্যের পাশাপাশি দামি মসলাও ক্রয় করে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিত্তশালীরা। এ বছর রোজার শুরুতে মসলার দাম বাড়তি থাকলেও ঈদের আগে মসলার বাজার অনেকটা স্থিতিশীলতায় পৌঁছেছে।’

একসময় মসলা পিষে ব্যবহার করার প্রচলন ছিল। বর্তমানে কর্মব্যস্ত মানুষ মসলা কিনে বেটে ব্যবহার করার মতো সময় পায় না। এর পাশাপাশি জীবনকে সহজ করার জন্য বাজারে পাওয়া যায় নানা ইন্সট্যান্ট মসলা। এর মধ্যে নানা ব্র্যান্ড গুঁড়া মসলা এনেছে বাজারে। তবে গত কয়েক দশক থেকে রান্নাঘরের ভরসা রাঁধুনী। তাদের মূল কিছু মসলার মধ্যে আছে হলুদের গুঁড়া, মরিচের গুঁড়া, জিরা, ধনে গুঁড়া ও চিলি ফ্লেক। এছাড়া তারা এনেছে মাংস রান্নার মিক্সড মসলা। এর মধ্যে আছে চিকেন, বিফ, বিরিয়ানি মসলাসহ আরো অনেক কিছু। বাজারে রাঁধুনীর এই প্যাকেটজাত মসলাও জনপ্রিয় এবং ঈদের আগে অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশিই  বিক্রি হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন