কেনাকাটায় মূল্য ছাড় ক্রেডিট কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ে

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : সংগৃহীত

ঈদে নতুন জমা কিনছেন, নির্ধারিত মূল্য তো পরিশোধ করতেই হবে। মূল্যের ওপর যদি কিছু ছাড় পান ক্ষতি কী? নির্ধারিত মূল্যের ওপর ১০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় এনে দিতে পারে ‘ক্রেডিট কার্ড’। দৈনন্দিন কেনাকাটার জন্য গ্রোসারি স্টোরে গেলে সেখানেও মিলবে ১০-৩০ শতাংশ ছাড়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাজারে এ ছাড়টুকুও কম কিসে? 

ঈদের ছুটিতে ভ্রমণে যেতে চান? দেশ-বিদেশে ভ্রমণেও আপনার সঙ্গী হতে পারে ক্রেডিট কার্ড। মূল্যছাড় ছাড়াও নগদ অর্থ বহনের ঝুঁকি শূন্যে নামিয়ে আনবে পকেটে থাকা এ ‘প্লাস্টিক মানি’। টাকা থেকে ডলার কিংবা অন্য কোনো মুদ্রায় রূপান্তরের যে ঝামেলা সেটি থেকেও মুক্তি মিলবে ক্রেডিট কার্ডে। উড়োজাহাজের টিকিট ক্রয় কিংবা পাঁচ তারকা হেটেলে রাতযাপন থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়ায়ও মিলবে আকর্ষণীয় ডিসকাউন্ট সুবিধা। এ সুবিধা নিতে পারবেন আপনিও। এর আগে দেখে নিন আপনার ব্যাগে আছে কোন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড। জেনে নিন, আপনার কার্ডে কোন শোরুমে মিলবে কত শতাংশ ছাড়।

গ্রাহকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘লংকাবাংলার’র ক্রেডিট কার্ড। ঈদ উপলক্ষে বিপুল ছাড় উপভোগ করছেন গ্রাহকরা। এর মধ্যে রয়েছে লাইফস্টাইলের অর্ধশতাধিক ব্যান্ডের শোরুমে ছাড় ও ক্যাশব্যাক। যেমন লংকাবাংলার গ্রাহকরা আড়ংয়ে কেনাকাটায় পাচ্ছেন ২৫ শতাংশ ক্যাশব্যাক। আবার ইয়েলোর শোরুমে ক্যাশব্যাক মিলছে ১৫ শতাংশ। এছাড়া লংকাবাংলার ক্রেডিট কার্ডে সেলর, কে ক্রাফট, আমব্রেলায় ১০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় পাওয়া যাবে। ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকস, জুয়েলারি, ফার্নিচার, বিউটি কেয়ার, এয়ার টিকিট, ই-কমার্সসহ বিভিন্ন খাতের পণ্য ও সেবায় মিলছে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়।

দেশে জনপ্রিয়তার দিক থেকে শীর্ষস্থানে রয়েছে ভিসা ব্র্যান্ডের ক্রেডিট কার্ড। মোট লেনদেনের প্রায় ৭০ শতাংশই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এ কার্ড নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। দেশের ব্যাংকগুলোর ইস্যু করা অন্য ক্রেডিট কার্ডগুলো হলো মাস্টারকার্ড, এমেক্স, ডিনারস, জেসিবি, কিউক্যাশ ও ইউনিয়নপে। দেশের প্রায় ৪০টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ইস্যু করা হয়েছে মোট ২৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৭৭টি ক্রেডিট কার্ড। অর্থনীতির আকার, জনসংখ্যার পরিমাণ, ক্রয়ক্ষমতা ও মধ্যবিত্তের সংখ্যা বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা খুবই কম বলে মনে করছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, দেশে ক্রেডিট কার্ডের বাজারের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বিশেষ এ কার্ড ইস্যুর ক্ষেত্রে নানা শর্ত, প্রতিবন্ধকতা ও ব্যবহারকারীদের অনভিজ্ঞতা এর বাজার সংকুচিত করে রেখেছে।

দেশে ৪০টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করলেও বাজারে সবার কার্ড জনপ্রিয়তা পায়নি। ক্রেডিট কার্ড বাজারের বড় অংশই ৫-৭টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবসায় এগিয়ে থাকা ব্যাংকগুলো হলো সিটি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক।  বিদেশী স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। তবে অন্য ব্যাংকগুলোও নিজেদের ক্রেডিট কার্ডকে জনপ্রিয় করে তুলতে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করছে। দেশের নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) মধ্যে ক্রেডিট কার্ড রয়েছে কেবল লংকাবাংলা ফাইন্যান্স পিএলসি। ক্রেডিট কার্ডের বাজারে এ প্রতিষ্ঠানের অবস্থান শীর্ষ পাঁচের মধ্যে রয়েছে।

সিটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকরা দেশের ৩০০ শোরুমে ১০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় পাচ্ছেন বলে জানান ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন। তিনি জানান, দেশের বাজারে সিটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। মোট ক্রেডিট কার্ডের এক-তৃতীয়াংশ আমাদের গ্রাহক। এ কারণে আমাদের অফারের আওতাও অনেক বেশি। প্রতিবারের মতো আমরা এবারো রমজান ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গ্রাহকদের জন্য বিশেষ অফার এনেছি। এবার প্রায় সব ক্যাটাগরিতেই এ অফার দিচ্ছি। এর মধ্যে প্রধান ক্যাটাগরিগুলো হলো ইফতার ও ডিনার বা এককথায় ডাইনিং; তারপর ট্রাভেল, গ্রোসারি, লাইফস্টাইল, জুয়েলারি, অনলাইন শপিং। অফারগুলোর মধ্যে আছে সেভিংস অফার, ক্যাশব্যাক, এক্সিলারেটেড মেম্বারশিপ রিওয়ার্ড পয়েন্ট, বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি নানা কিছু। 

ক্রেডিট কার্ডের সুদহার নিয়ে বাজারে কিছুটা বিশৃঙ্খলা ছিল। গ্রাহকের কাছ থেকে কোনো কোনো ব্যাংক ৩০ শতাংশেরও বেশি সুদ আদায় করত। এ অবস্থায় ক্রেডিট কার্ডের সর্বোচ্চ সুদ ও সার্ভিস ফি নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে ক্রেডিট কার্ডের সর্বোচ্চ সুদ বেঁধে দেয়া হয় ২০ শতাংশ। ওই প্রজ্ঞাপনের পর দেশের সব ব্যাংকই ক্রেডিট কার্ডের সুদহার কমিয়ে এনেছে। এতে গ্রাহকের মধ্যে কার্ডভিত্তিক ঋণ সেবাটির জনপ্রিয়তাও বাড়ছে।

দেশের ১৬ বছরের ঊর্ধ্বের যেকোনো নাগরিক ক্রেডিট কার্ড সেবা নিতে পারেন। তবে তার নির্দিষ্ট আয়ের ব্যবস্থা থাকতে হয়। পরিবারের অন্য কেউ উপার্জনক্ষম হলেও তার বিপরীতে কার্ড দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। আর এ কার্ডের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা ঋণ নেয়া যায়। কার্ডের ব্যবহার সহজ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংযুক্ত করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি।

ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে গ্রাহকরা নির্দিষ্ট পরিমাণ কেনাকাটা ও ঋণ নিতে পারেন। দেশে ইস্যু করা দ্বৈত মুদ্রার ক্রেডিট কার্ড বিদেশেও ব্যবহার করা যায়। এ কারণে টাকার পাশাপাশি ডলারেও ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বাড়ছে। দেশে-বিদেশে কার্ড ব্যবহার করে হোটেল বুকিং, থাকা-খাওয়া, ভ্রমণ, বিমান ভাড়া, রেস্তোরাঁ ও কেনাকাটার বিল পরিশোধে মিলছে নানা ছাড় ও পয়েন্ট জেতার সুযোগ। ক্রেডিট কার্ডে নেয়া ঋণের বিপরীতে ৪৫ দিন পর্যন্ত কোনো সুদ পরিশোধ করতে হয় না।

অবকাঠামো সুবিধা না থাকায় বাংলাদেশে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীদের বড় অংশই এখনো রাজধানী ও বিভাগীয় শহরগুলোয় সীমাবদ্ধ। তবে ব্যাংকগুলো এখন জেলা শহরগুলোয়ও এ কার্ড ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। জেলা শহরগুলোর মার্কেট ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় যদিও এখনো পিওএস মেশিনে বিল পরিশোধের সুযোগ খুবই কম। এটিকে ক্রেডিট কার্ডের বাজার সম্প্রসারণের অন্তরায় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে দেশের অভ্যন্তরে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ২ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকার লেনদেন হয়। এ লেনদেনের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪৯ শতাংশই হয়েছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কেনাকাটায়। রিটেইল আউটলেট সার্ভিসেস, ইউটিলিটি বিল, কাপড়, ওষুধসহ বিভিন্ন ধরনের কেনাকাটায়ও ব্যবহৃত হয়েছে ক্রেডিট কার্ড। প্লাস্টিকের এ কার্ড ব্যবহার করে গ্রাহকরা বিপদের সময় এটিএম বুথ থেকে নগদ টাকাও তুলছেন। পাশাপাশি ভ্রমণের সময় ভাড়া ও সেবার মাশুলও পরিশোধ করছেন। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে গত ডিসেম্বরে বিদেশে ৫৭৯ কোটি টাকা ব্যয় করেছেন গ্রাহকরা।

ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হক জানান, রমজান ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গ্রাহকদের প্রয়োজন ও পছন্দের কেনাকাটা মাথায় রেখে আমরা বিভিন্ন রকম অফারের ব্যবস্থা করেছি। দেশের সেরা তারকা হোটেলসহ অন্যান্য স্বনামধন্য রেস্টুরেন্টে ইফতার ও সাহরিতে একটি কিনলে সর্বোচ্চ পাঁচটি পর্যন্ত বাফেট খাবার গ্রহণের ব্যবস্থা রাখা হয়। নামিদামি লাইফস্টাইল, ফ্যাশন, ফুটওয়্যার, ইলেকট্রনিকস, ফার্নিচার, জুয়েলারি, গ্রোসারি, ফুড ব্র্যান্ডসহ সরাসরি ও অনলাইন কেনাকাটায় আকর্ষণীয় ছাড়, ক্যাশব্যাক ও কেনাকাটায় বিনাসুদে মাসিক কিস্তিতে পরিশোধের সুবিধাও রাখা হয়েছে।

ক্রেডিট কার্ডের পাশাপাশি কেনাকাটায় মূল্য ছাড় ও ক্যাশব্যাক সুবিধা দিচ্ছে বিকাশ, নগদ, রকেট, উপায়ের মতো মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসও (এমএফএস)। কেনাকাটার পর বিল পরিশোধের আগে এ বিষয়ে জেনে নিতে পারেন আউটলেটগুলোয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন