রোজায় কমেছে রেমিট্যান্স

হুন্ডিতে অর্থ প্রেরণ বন্ধে ডলারের একক বিনিময় হার নির্ধারণ প্রয়োজন

ছবি : বণিক বার্তা

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতার অন্যতম চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স। সাধারণত প্রতি বছর রমজান ও ঈদ উদযাপনকে ঘিরে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে থাকে। যদিও এ বছর এর উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে—রেমিট্যান্স প্রবাহ না বেড়ে কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসীরা চলতি বছরের মার্চে ১৯৯ কোটি ৬৮ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। গত বছরের মার্চে যার পরিমাণ ছিল ২০২ কোটি ২৪ লাখ ডলার। এক বছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ১ দশমিক ২৬ শতাংশ। প্রবাসীরা দেশে মূলত ফরমাল চ্যানেলে কিংবা হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশমতে, বর্তমানে ব্যাংকগুলোয় ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ১১০ টাকা। তবে ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো ডলারপ্রতি ১২০ টাকারও বেশি দামে রেমিট্যান্স কিনেছে, যা কমে এখন দাঁড়িয়েছে ১১৫-১১৬ টাকায়। বিপরীতে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম ১২৪ বা ১২৫। খুচরা বাজারে ডলারের বিনিময় মূল্য বেশি পাওয়ায় অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলেই প্রবাসী আয় দেশে আসছে। প্রবাসীদের কাছে হুন্ডিতে রেমিট্যান্স পাঠানো বেশি আকর্ষণীয় এখন। অন্যদিকে কার্ব মার্কেটের বাইরেও একটি অনানুষ্ঠানিক ডলারের বাজার গড়ে উঠেছে। বিদেশে যাদের এজেন্ট আছে এবং সুনজরে আছে তাদের জন্য এটি একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছে। অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রাবাজার ব্যবস্থাপনায় আমাদের গলদ রয়েছে। এসব কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ ক্রমেই কমেছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ না বাড়লে একদিকে দেশের ডলার সংকট কাটবে না, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়বে না। এর অভিঘাত পড়বে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে। 

দেশে ডলার সংকটের মধ্যে আর্থিক হিসাব ও চলতি হিসাবে ঘাটতি হওয়ায় ২০২২ সালের জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ঋণ চায় বাংলাদেশ। গত বছরের ৩০ জানুয়ারি ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে সংস্থাটি। তবে ঋণ দেয়ার পাশাপাশি বেশকিছু শর্তও জুড়ে দেয়। এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ—নিট বৈদেশিক রিজার্ভ (এনআইআর) সংরক্ষণ। সংস্থাটির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিকেও এ শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, আইএমএফের শর্তানুসারে, মার্চের শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রকৃত রিজার্ভ থাকার কথা ১ হাজার ৯২৬ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু প্রকৃত রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের কম। রেমিট্যান্স প্রবাহ না বাড়ানো গেলে এ অবস্থা আরো নাজুক হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এ প্রবাহ বাড়াতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরো উদার হতে হবে, আন্তর্জাতিক ও খুচরা বাজারের মানদণ্ডে ডলারের দাম নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি হুন্ডি ব্যবসাকে শক্ত হাতে প্রতিহত করতে হবে। কেননা হুন্ডি ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে পুঁজি পাচারকারীরা হুন্ডির ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সর্বদা আনুষ্ঠানিক দামের চেয়ে বেশি টাকা প্রদানের চেষ্টা করবে। তাই এ প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। হুন্ডি ব্যবসা দমানো গেলে দেশ থেকে অর্থ পাচার কমে আসার সম্ভাবনাও রয়েছে।

২০২০-২১ অর্থবছরে বৈধ পথে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল, রিজার্ভও পৌঁছে গিয়েছিল সর্বোচ্চ ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে। এ প্রবৃদ্ধির কারণ করোনা মহামারীর সময় হুন্ডি ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। করোনা পরিস্থিতি স্তিমিত হয়ে যাওয়ায় পরের অর্থবছরে হুন্ডিতে রেমিট্যান্স পাঠানো আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তখন বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৫ শতাংশ হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৭০৭ কোটি বা ১৭ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে প্রবাসীরা ১৬ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৪২ শতাংশ। তবে যে পরিমাণ বাংলাদেশী বিদেশে গেছেন সে অনুপাতে রেমিট্যান্স বাড়েনি। বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে রেকর্ড ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫৩ বাংলাদেশী জীবিকার সন্ধানে অভিবাসী হয়েছেন। আগের বছর অভিবাসী বাংলাদেশীর সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩। অর্থাৎ গত দুই বছরে ২৪ লাখের বেশি বাংলাদেশী কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, প্রবাসীদের সংখ্যার অনুপাতে রেমিট্যান্স বাড়েনি। বিএমইটির তথ্যমতে, ১৯৭৬ থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশ থেকে মোট ১ কোটি ৫৯ লাখ ৮০ হাজার ২৯০ জন বাংলাদেশী বিভিন্ন কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই অভিবাসী হয়েছেন ৫৭ লাখ ৩২ হাজার ৪৬২ জন। কিন্তু প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরবে রেকর্ডসংখ্যক শ্রমিক অভিবাসী হলেও দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে দাঁড়িয়েছে এক-চতুর্থাংশে।

দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে শ্রমিকদের কাজের দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। এজন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠাতে হবে। শ্রমিকদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত সরকারের। এ প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে সনদ প্রদান করবে, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হবে। অনেক সময় দেখা যায়, প্রবাসীরা প্রশিক্ষিত না হওয়ায় প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ ও বেতন-ভাতা পান না। আবার পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে তারা আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে টাকা পাঠাতে পারেন না। তাদের এ বিষয়ে অবগত করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় প্রণোদনার ব্যবস্থাও করতে হবে। এনআরবি বন্ডের সুযোগ-সুবিধা এক্ষেত্রে বাড়ানো যেতে পারে। তবে হুন্ডি ব্যবসা প্রতিরোধ ও প্রবাসী আয় বাড়ানোর জন্য বৈদেশিক বিনিময় হারের নীতি কৌশল ও ব্যবস্থাপনা ঠিক করা অতি আবশ্যক। ব্যাংক বা মানি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর প্রতি প্রবাসীদের আগ্রহী করতে নানা ধরনের প্রণোদনা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। ব্যাংকিং সেবা বা মানি এক্সচেঞ্জ হাউজ প্রবাসীদের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি প্রবাসীদের দূতাবাস বা হাইকমিশনে পাসপোর্ট বা ভিসা নবায়নসহ অন্যান্য কাজের জটিলতা কমিয়ে আনতে হবে। সংশ্লিষ্ট দূতাবাসগুলো বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রবাসীদের উৎসাহিত করতে পারে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হলে আনুষ্ঠানিক মাধ্যমে তা দেশে আসা প্রযোজন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই এ বিষয়ে উদ্যোগী হবে এটিই প্রত্যাশা। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন