তিন দশকে পানির স্তর নেমেছে ৫০ মিটার

আরো ৩৩ গভীর নলকূপ বসাবে ওয়াসা, বাড়তে পারে পানির ব্যয়

ইয়াহইয়া নকিব

ছবি : বণিক বার্তা

রাজধানীতে দৈনিক পানির চাহিদা প্রায় ৩১৫ কোটি লিটার। এর মধ্যে ওয়াসা সরবরাহ করে প্রায় ২৯৮ কোটি লিটার। বাকি ১৭ কোটি লিটার পানির চাহিদা পূরণে রাজধানীতে আরো ৩৩টি গভীর নলকূপ বসাতে চায় ওয়াসা। যদিও ২০২১ সালের মধ্যে চাহিদার ৭০ শতাংশ পানি ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে সরবরাহের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল সংস্থাটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গভীর নলকূপের সংখ্যা বাড়ানো হলে পানির দাম বেড়ে যেতে পারে। এছাড়া আরো নিচে নেমে যাবে পানির স্তর। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত তিন দশকে পানির স্তর প্রায় ৫০ মিটার নিচে নেমেছে। এখন প্রতি বছর দুই-তিন মিটার নিচে নামছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে এ উৎস থেকে পানি তোলা কঠিন হয়ে পড়বে। আবার ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় ভূ-উপরিস্থ পানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

পরিকল্পনা কমিশনের সূত্রমতে, নগরীতে ১৭ কোটি লিটার পানির চাহিদা মেটাতে ১৪৫টি গভীর নলকূপ বসানোর প্রস্তাব দেয় ওয়াসা। এর মধ্যে ৮০টি গভীর নলকূপ স্থাপনে ৭৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২০ সালে একটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। এ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালে। কিন্তু আরো ৩৩টি নলকূপ অন্তর্ভুক্ত করে প্রকল্প সংশোধন করা হচ্ছে। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ছে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। এ প্রকল্পের অধীনে ৪৪৩টি গভীর নলকূপ প্রতিস্থাপনও করা হচ্ছে। পুনরায় চালু হচ্ছে ১৮০টি গভীর নলকূপ। নির্মাণ হবে ৩০০ পাম্পঘর। 

গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করায় প্রতিনিয়ত ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ভূগর্ভস্থ পানি বিভাগের ২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯৫ সালে ঢাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ৩২ মিটার নিচে। ২০০০ সালে তা ৪১ মিটার নিচে নেমে যায়। ২০০৫ সালে হয় ৫৪ মিটার এবং ২০১৫ সালে তা ৭১ মিটার নিচে নেমে যায়। পানির স্তর ৭৪ মিটার গভীরে নেমে যায় ২০২০ সালে। তেজগাঁও এলাকায় এটা ৭৭ মিটার পর্যন্ত নেমে গেছে। 

গবেষণায় পূর্বাভাস দেয়া হয়, ২০২৫ সালের মধ্যে পানির স্তর ৮০ মিটার নিচে নেমে যেতে পারে। আর ২০৩০ সালে তা ৮৫ ও ২০৩৫ সাল নাগাদ ১০০ মিটার নিচে নেমে যতে পারে। 

ভূগর্ভস্থ জলাধারে বালিকণার ফাঁকে ফাঁকে পানি জমে থাকে। এ পানি বৃষ্টিপাতসহ ভূপৃষ্ঠের নানা উৎস থেকে ভূগর্ভস্থ জলাধারে প্রবাহিত হয়। জলাধারগুলোয় বর্ষা মৌসুমে যে পরিমাণ পানি জমে, সেটাকেই সাধারণত রিচার্জ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অতিনির্ভরতার কারণে মাটির নিচে ঠিকমতো পানি ‘রিচার্জ’ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না বলে মনে করছেন পাউবোর ভূগর্ভস্থ পানি বিভাগের পরিচালক ড. আনোয়ার জাহিদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহর কংক্রিটের আচ্ছাদনে ঢেকে যাওয়ায় এবং খোলা মাটির অংশ কমে যাওয়ায় পানি রিচার্জ ঠিকমতো হচ্ছে না। আগে ঢাকার চারপাশ এলাকা থেকে ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানি রিচার্জ হতো। কিন্তু এখন ঢাকার পাশে প্রচুর শিল্প গড়ে উঠছে। এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিজেরাই পানি উত্তোলন করছে। ফলে এসব পানিও এখন আর রিচার্জ হতে পারছে না। আর প্রতি বছর পানির স্তর দু-তিন মিটার নিচে নামছে। এতে ওয়াসা আরো গভীরে তাদের নলকূপ বসাতে বাধ্য হচ্ছে। এতে পানির দাম বাড়বে। তাছাড়া ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পানিশূন্যতায় ভুগতে পারে।’

পাউবোর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৫ সালে ঢাকায় গভীর নলকূপের সংখ্যা ছিল ১৯৭। ২০০০ সালে হয় ৩০০টি। ৪২৩টিতে দাঁড়ায় ২০০৫ সালে। এরপর ২০১৫ সালে ৭৪০ ও ২০২০ সালে ৮০০টিতে দাঁড়ায়। ২০২৫ সালে দাঁড়াবে ৯০৬টিতে।

নদী গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ মনে করেন, নগরীর পার্শ্ববর্তী নদীর পানি ওয়াসার কারণেই দূষিত হয়। এ কারণে কাছাকাছি কোনো পানির উৎস পাওয়া যাচ্ছে না। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ওয়াসার সুয়ারেজের ড্রেনের পানি পরিশোধন না করেই নদীতে ফেলা হচ্ছে। ফলে ৪০ শতাংশ সারফেস ওয়াটার দূষণ হচ্ছে ওয়াসার কারণেই। তারা সুয়ারেজের মাত্র ১২-১৩ শতাংশ পানি পরিশোধন করছে। আবার নদীর দূষিত পানিও তাদের পরিশোধন করতে হচ্ছে। ওয়াসার এমন নীতির কারণে দূষণ বাড়ছে।’

মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘দাশেরকান্দির মতো ঢাকার ৮-১০টি পয়েন্টে সুয়ারেজের পানি শোধনের উদ্যোগ নিতে হবে ওয়াসাকে। আর কারখানার দূষণ এখনকার মতো চলতে থাকলে মেঘনার পানিও দূষিত হয়ে যাবে। তখন পানির নিরাপদ উৎস পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে। ওয়াসা নিজে দূষণ কমালেই ৪০ শতাংশ পানি দূষণ কমে যাবে।’ 

এদিকে ওয়াসার পক্ষ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ৭০ শতাংশ সারফেস ওয়াটার ব্যবহারের জন্য বেশ কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১৫ সালে নেয়া সায়েদাবাদ ফেজ-৩ প্রকল্পটি ২০২০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। এতে প্রতিদিন ২৩ কোটি লিটার পানি পাওয়া যেত। প্রকল্পটির ব্যয় শুরুতে ছিল ৩ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। এখন বেড়ে ৭ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা হয়েছে। কাজের অগ্রগতি ৫ শতাংশ। ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পটির। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পয়োবর্জ্য ও শিল্প দূষণের কারণে নদীবেষ্টিত হয়েও ঢাকায় পানি আনতে হচ্ছে পদ্মা-মেঘনা থেকে। মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে দূর থেকে পানি আনতে গিয়ে এবং মাটির গভীর থেকে পানি উত্তোলন করতে গিয়ে পানির দাম বেড়ে যাচ্ছে। ময়লার কারণে ঢাকার আশপাশের নদীর পানিও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। পানির স্তর নিচে নামছে উদ্বেগজনক হারে। সামনে এটা আরো ভোগান্তি সৃষ্টি করতে পারে।’

২০১৪ সালে পদ্মা থেকে পানি আনার জন্য নেয়া হয় পদ্মা-জশলদিয়া প্রকল্প। ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত এ প্রকল্প ২০১৯ সালে উৎপাদনে আসে। প্রতিদিন ৪৫ কোটি লিটার পানি পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও মিলছে ২৬ কোটি লিটার।

সার্বিক বিষয়ে ওযাসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম সহিদ উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০২১ সালে ৭০ শতাংশ সারফেস ওয়াটার ব্যহারের লক্ষ্য থাকলেও ২০২৪ সালে এসে তা বাস্তবায়ন না হওয়াটা দুঃখজনক। কবে এ লক্ষ্য পূরণ হবে তাও নিশ্চিত নয়।’ 

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘জমি অধিগ্রহণ ও পানির লাইন নির্মাণে রাস্তা কাটার অনুমতি না পাওয়ায় কাজ এগোনো যায়নি। অন্য সংস্থাগুলোর সহায়তা পাইনি আমরা। সবার সহায়তা না পেলে ঢাকাকে বাঁচানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। টাকার অভাবে লাইন করতে না পারায় পদ্মা থেকে পুরোদমে পানি আনা যাচ্ছে না। নারায়ণগঞ্জের গন্ধর্বপুর পানি শোধনাগার ২০২৫ সালের মধ্যে সম্পন্ন হয়ে গেলে ১৫০টি গভীর নলকূপ বন্ধ করে দেয়া যাবে। পর্যায়ক্রমে আমরা সেদিকে যাব। তবে সবার সহায়তা প্রয়োজন। নয়তো দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন শহরের মতো ঢাকায়ও পানি সংকট দেখা দিতে পারে ভবিষ্যতে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন